ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ মে ২০২৪, ০০ জিলকদ ১৪৪৫

ফিচার

হারিয়ে যাচ্ছে সুরসম্রাট শচীন দেব বর্মণের বাড়ি

গোলাম কিবরিয়া, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৪৯ ঘণ্টা, মার্চ ৯, ২০১২
হারিয়ে যাচ্ছে সুরসম্রাট শচীন দেব বর্মণের বাড়ি

সুরসম্রাট শচীন দেব বর্মণের বহু  স্মৃতিবিজড়িত কুমিল্লা শহরের পূর্ব চর্থার বাড়িটি হারিয়ে যেতে বসেছে। অযত্নে-অবহেলায় ভুতুড়ে বাড়িতে পরিণত হয়েছে।

উপমহাদেশের অন্যতম সঙ্গীত গুরু শচীন দেব বর্মণের বাড়িতে গড়ে উঠেছে হাঁস-মুরগির ফার্ম।

পরিত্যক্ত, ভগ্ন ও জঙ্গলাকীর্ণ এ বাড়িটির বহিঃদেয়ালে এখন শুধুমাত্র একটি স্মৃতিফলক শোভা পাচ্ছে। স্থানীয় নজরুল পরিষদ ১৯৮৩ সালে শচীন দেব বর্মণের স্মৃতিবিজড়িত এ বাড়িতে তার স্মৃতি অম্লান রাখার উদ্দেশ্যে এ ফলকটি স্থাপন করেছিল।

এ বাড়িতে কবি নজরুলের সঙ্গে শচীন দেব বর্মণের সঙ্গীত চর্চা এবং প্রাণবন্ত আড্ডার স্মৃতিকে জাগরুক করে রাখার জন্যই নজরুল পরিষদ এ উদ্যোগ নেয়। স্মৃতিফলকে লেখা রয়েছে, ‘শচীন দেব বর্মণের সঙ্গে কাজী নজরুল ইসলাম এ বাড়িতে সঙ্গীত চর্চা করতেন। ’

সুর-সঙ্গীতে সমৃদ্ধ তীর্থস্থান কুমিল্লা। এ জেলার এককালের বাঁশের বাঁশির সুরের মুর্ছনা, একতারা দোতারার ঝংকার, ঢোল-খোল ও তবলার প্রাণ মাতানো ধ্বনি, জারী- সারী গান, বাউল, কীর্তন, কবি গান, যাত্রা, লোক সঙ্গীতের মন মাতানো সুরের মুর্ছনা আজ বিলীন প্রায়।

এ জেলার বেশ ক’জন সঙ্গীতজ্ঞ দেশ-বিদেশে শ্রদ্ধা ও ভালবাসার জায়গা জুড়ে রয়েছেন। এদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ শচীন দেব বর্মণ।

সঙ্গীত জগতের সমুজ্জ্বল রত্ন শচীন দেব বর্মণ জন্মগ্রহণ করেন ১৯০৫ সালে কুমিল্লা শহরে। বাবা নবদ্বীপ দেব বর্মণ ছিলেন ত্রিপুরা রাজ্যের সিংহাসনের দাবিদার। নবদ্বীপ বর্মণের সিংহাসনের এ দাবি প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

ত্রিপুরা রাজ্যের মহারাজা পদে অধিষ্ঠিত হন তার সৎ ভাই মহারাজা বীরচন্দ্র মানিক্য বাহাদুর। সিংহাসনের দাবিদার নবদ্বীপ কুমার দেব বর্মণকে হত্যা করার জন্য বীরচন্দ্র মানিক্য বাহাদুর ষড়যন্ত্র শুরু করলে রাজবাড়ির অধিকর্তা কৈলাস সিংহের পরামর্শে মহারাজ নবদ্বীপ কুমার বর্মণ সপরিবারে কুমিল্ল শহরে চলে আসেন।

কৈলাস সিংহ রচনা করেছিলেন বিখ্যাত রাজমালা গ্রন্থ। প্রখ্যাত এ লেখক কৈলাস সিংহের পরামর্শে নবদ্বীপ কুমার বর্মণ কুমিল্লা শহরে এসে পূর্ব চর্থায় একটি বাড়ি নির্মাণ করেন। নির্মিত এ বাড়িটিতে রাজবাড়ির আদল না থাকলেও এর নির্মাণ শৈলী ছিল চমৎকার।


এ বাড়িতে সপরিবারে বসবাস শুরু করেন নবদ্বীপ কুমার দেব বর্মণ। সঙ্গীতের প্রতি তার ছেলেমেয়েদের ছিল প্রবল আগ্রহ এবং অনুরাগ। নবদ্বীপ কুমার দেব বর্মণের ছেলে কুমার শচীন দেব বর্মণ বাল্যকালেই সঙ্গীতের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েন।

প্রথম থেকেই বাংলার লোক সঙ্গীত ও পল্লী সঙ্গীতের প্রতি তার ঝোঁক ছিল বেশি। পরে অন্ধ গায়ক কৃষ্ণ চন্দ্র দে (কানা কৃষ্ণ), শ্যাম লাল ক্ষেত্রী, হোসেন রায়, সুধীর চন্দ্র সান্ন্যাল ও ধূর্জটি প্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের কাছে নিষ্ঠার সঙ্গে তালিম নেন সঙ্গীতে।

এ সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব ১৯৩০ সালে মাত্র ২৫ বছর বয়সে গানের সুর রচনা করা শুরু করেন। ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত সঙ্গীত এবং ভারতীয় মার্গ সঙ্গীতের সংমিশনে তিনি নিজস্ব ঘরানার সুর রচনা করেন। যা ছিল অভিনব। তিনি ভারতের গণনাট্য সমিতির বাংলা লোক সঙ্গীত বিভাগের সভাপতি নির্বাচিত হন।

রাগ প্রধান বাংলা গানে কুমার শচীন দেব বর্মণের অবদান অবিস্মরণীয়। তার অসাধারণ সঙ্গীত সাধনায় খ্যাতি এ উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। তিনি বোম্বে (মুম্বাই) চলচ্চিত্র জগতে শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালকের মর্যাদা লাভ করেন। ভারত সরকার তাকে পদ্মশ্রী খেতাবে ভূষিত করেন।

১৯৬৯ সালে ‘আরাধনা‘ হিন্দি ছবিতে শ্রেষ্ঠ নেপথ্য গায়ক হিসেবে তিনি ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। তার স্ত্রী মীরাদেবীও এ উপমহাদেশের অন্যতম সুগায়িকা এবং দক্ষ গীতিকার ছিলেন। স্ত্রীর রচিত বহুগান শচীন দেব বর্মণ গেয়েছেন।

শচীন দেব বর্মণের একমাত্র ছেলে রাহুল দেব বর্মণ  মুম্বাই চলচিত্রে প্রখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে জায়গা করে নিয়েছেন।
শচীন দেব বর্মণ মূলতঃ ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের আগেই কলকাতা ও মুম্বাইয়ে একজন নিষ্ঠাবান গায়ক ও অনন্য সুরের সৃষ্টিকর্তা হিসেবে আপন অবস্থান সৃষ্টি করে নিয়েছিলেন।

উপমহাদেশ জুড়ে ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তা ও খ্যাতি অর্জনের পরও শচীন একাধিকবার কুমিল্লায় এসেছিলেন। মিলিত হয়েছিলেন কৈশরের বন্ধুদের সঙ্গে। সুরেন দাস, কুলেন্দু দাস, সুখেন্দু ক্ষেত্রী, দীলিপ সিংহ রায় প্রমুখ সঙ্গীত ব্যক্তিত্বের সঙ্গে ছিল শচীনের ঘনিষ্ঠতা।

শচীন দেব বর্মণের স্মৃতিবিজড়িত পৈত্রিক ভিটা দেশ বিভাগের পর কিছুদিন মিলিটারি গোডাউন হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তারপর এ বাড়িটিতে স্থাপিত হয় পশু চিকিৎসা কেন্দ্র। পরবর্তীতে বাড়ির খালি জায়গায় স্থাপিত হয়েছে সরকারি হাঁস-মুরগির খামার।

বাড়িটির সামনে সরকারি হাঁস-মুরগির খামারের অফিস স্থাপিত হবার কারণে শচীন দেব বর্মণের বাড়িটি আড়ালে পড়ে গেছে। সৃষ্টি হয়েছে ঝোঁপ-জঙ্গল। দিনের পর দিন এ বাড়িটির ইট-বালু খসে পড়ছে।

কালের বিবর্তনে আযত্ন-অবহেলায় কুমিল্লার বুক থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে শচীন বর্মণের এ স্মৃতিটিও। অথচ এ বাড়িটিকে যথাযথ সংরক্ষণ করে পর্যটকদের জন্য একটি আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা যায়। জেলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এ অমূল্য নিদর্শন রক্ষায় সরকারের কোন উদ্যোগ এ যাবত দেখা যায়নি বা এ বিষয়ে জেলার সংস্কৃতিসেবীরাও মাঠে নেমে আসেননি।

তবে বর্তমান সরকারের আমলে স্থানীয় সংসদ সদস্য আকম বাহাউদ্দিন বাহার ও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এটিকে সংস্কার ও সংরক্ষণ করার উদ্যোগ নেয়ার কথা বলা হলেও এ পর্যন্ত কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

সঙ্গীতানুরাগী সবারই প্রত্যাশা- উপমহাদেশের প্রখ্যাত সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব কুমার শচীন দেব বর্মণের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটিকে ঘিরে একটি জাদুঘর ও সঙ্গীত গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করার।

বাংলাদেশ সময় : ১৭২৭ ঘণ্টা, মার্চ ০৯, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।