ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

ফিচার

জন্মোৎসবে সংবর্ধিত গবেষক গোলাম মুরশিদ

হোসাইন মোহাম্মদ সাগর, ফিচার রিপোর্টার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩০৫ ঘণ্টা, মার্চ ২০, ২০১৯
জন্মোৎসবে সংবর্ধিত গবেষক গোলাম মুরশিদ ছবি: বাংলানিউজ

ঢাকা: তিনি অসুস্থ। মঞ্চে ওঠার পরও ইনহেলার নিলেন দু’বার। তবুও তাকে নিয়ে বাকিদের কথা শুনছেন খুব মনোযোগ দিয়ে। বন্ধু, শুভানুধ্যায়ী, প্রিয়জনরা তাকে নিয়ে অনেক কথা বলছেন। অবশ্য তার মতে সেগুলো অপপ্রচার।

তিনি কথা বলতে এলেন। সেসব কথার উত্তর দিলেন খুব ছোট্ট করে।

বললেন, ‘আমাকে নিয়ে অনেক কথা শুনলেন, তবে সেগুলো আমার কাছে আমার অপপ্রচার বলে মনে হয়েছে। আমি অতি সাধারণ একজন মানুষ। আমাকে নিয়ে এই যে আয়োজন, আমি তারও অনুপযোগী। ’

আগামী ৮ এপ্রিল তিনি পেরোবেন জীবনের ৮০টি বসন্ত। আর এ উপলক্ষ্যে মঙ্গলবার (১৯ মার্চ) বিকেলে বাংলা একাডেমির আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হলো লেখক, অধ্যাপক, গবেষক গোলাম মুরশিদের ৮০তম জন্মোৎসব ও সংবর্ধনা অনুষ্ঠান। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশ চর্চা পাঠচক্র ও প্রকাশনা সংস্থা কথাপ্রকাশ এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী, একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী।

শুরুতেই গোলাম মুরশিদকে নিবেদন করে খালি গলায় রবীন্দ্রনাথের ‘সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে’ ও তবলার সঙ্গতে ‘তোমারে করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা’ গান দুটি পরিবেশন করেন শিল্পী লাইসা আহমদ লিসা। এরপর স্বাগত বক্তব্য দেন অধ্যাপক স্বরোচিষ সরকার। এসময় তিনি লেখকের কর্মময় জীবনের বর্ণনা তুলে ধরে তাকে ‘বঙ্গবিদ্যাবিশারদ’ উপাধি দেওয়ার আহ্বান জানান।

অনুষ্ঠানে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন কথা প্রকাশের সত্ত্বাধিকারী জসিম উদ্দিন। অধ্যাপক গবেষক গোলাম মুরশিদকে উত্তরীয় পরিয়ে দেন কথা সাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক। লেখকের হাতে সম্মাননা সূচক ক্রেস্ট তুলে দেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, ছয় দশকের পরিচয় তার সঙ্গে। এই সময়ের ভেতর তার মধ্যে অনেক পরিবর্তন লক্ষ্য করেছি। তবে তার গবেষণাসত্ত্বার কোন পরিবর্তন হয়নি। তার গবেষণায় যে নিষ্ঠা ও পরিশ্রম দেখতে পাই তা অনন্য এবং এই নিষ্ঠা ও অর্ন্তদৃষ্টি দিয়ে তিনি দৃষ্টান্তমূলক উদাহরণ রেখেছেন। নজরুল, মাইকেল মধুসূদন থেকে শুরু করে বাঙালি নারীর ইতিহাস নিয়ে তিনি চমৎকার গবেষণা করেছেন। গবেষণাসহ সকল ক্ষেত্রেই তিনি নতুন পথ দেখিয়েছেন, নতুন পথের আশা জাগিয়েছেন। তিনি একজন বিরল গবেষক।

বন্ধুবর শামসুজ্জামান খান স্মৃতিচারণ করে বলেন, গোলাম মুরশিদ এমন একজন গবেষক, যাকে নিয়ে গর্ব করা যায়। আমরা গর্ব করে বলতে পারি- আমাদের একজন গোলাম মুরশিদ আছে।

ছবি: বাংলানিউজবাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘বিবর্তনমূলক বাংলা অভিধান’ প্রকাশের সময়কার স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, বাংলা একাডেমির গবেষণাতে তিনি আধুনিকতার ছাপ এঁকেছিলেন। লন্ডনে বসে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে তিনি সকল ভুল-ত্রুটি ধরিয়ে দিয়েছিলেন। বাংলা একাডেমিকে আধুনিক গবেষণা ও প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে তিনি উচ্চমানে পৌঁছে দিয়ে গেছেন।

হাবীবুল্লাহ সিরাজী বলেন, মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনী পাঠের মধ্য দিয়ে তার সাথে আমার পরিচয়। তার লেখায় মধুসূদন ও নজরুলকে ভিন্নভাবে জানার সুযোগ হয়েছে। জীবনকে জীবন ও যুদ্ধকে যুদ্ধের সঙ্গে সমান্তরালে নিয়ে তিনি কাজ করেছেন।

ভীষ্মদেব চৌধুরী বলেন, গোলাম মুরশিদের লেখায় তার ব্যক্তিত্ববোধের ছাপ পাওয়া যায়। এ বিরল গুণটি সবার মধ্যে থাকে না। নানা দিক ও প্রান্ত নিয়ে তিনি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন এবং করছেন।

এরপর অনুভূতি প্রকাশ করতে এসে গোলাম মুরশিদ বলেন, আমি সর্ব বিষয়ে সর্বজ্ঞানী নয়। তবে মোটামুটি একটু ধারণা রাখি কিছু বিষয়ে। আমি খুব সাধারণ এবং সাধারণ মানুষের উপযোগী করেই লিখতে চাই। সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অনেক ভালোবাসা পেয়েছি। তারা অনুরাগ ভরে আমার বইগুলো পড়েছেন। আমার মনে কোনো ক্ষোভ নেই। প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি পেয়েছি কিনা তাতে দুঃখ নেই। পাঠকের কাছ থেকে স্বীকৃতি পেয়েছি, এটাই অনেক।

তিনি বলেন, আমি কাজকে জীবন, জীবনকে কাজ বলে মনে করি। পরিশ্রম এবং অধ্যাবসায় করি। বিধাতা আমাকে কম মেধা দিয়েছেন। যতটুকু দিয়েছেন ততটুকুকে ঘষে-মেজে উজ্জ্বল করেছি। অধ্যবসায় দিয়েই যা পাওয়ার পেয়েছি। আর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কাজ করতে চাই।

আগামীর লেখা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি রবীন্দ্রনাথের আদর্শ নারী, বাংলা গানের ইতিহাস ও বাঙালি স্থাপত্যকলা নিয়ে লিখতে চাই। উপন্যাস লিখতে চাই, আত্মজীবনী লিখতে চাই। কাজের মধ্য দিয়েই জীবনকে উপভোগ করতে চাই।

সবশেষে বন্ধু গোলাম মুরশিদের সঙ্গে নানা স্মৃতিচারণ করে হাসান আজিজুল হক বলেন, জীবনে বন্ধু অনেক পাওয়া যায়। তবে গুটিকয়েক বন্ধু আছে যাদের ভ্রাতৃতুল্য বললেও কম বলা হয়। মুরশিদ এমনই একজন। সে একজন প্রথম শ্রেণির, প্রধান গবেষক ও জীবনী লেখক। তিনি কথা কম বলেন, উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন খুব কম। কিন্তু তার মতো কোমল হৃদয়ের মানুষ খুব কমই আছেন। আর শুধু গবেষক নয়, আরো বহু বিষয়ে তার বিশেষত্ব আছে। তার বইগুলো শুধুমাত্র আনন্দ দেওয়ার জন্য বা সুখপাঠ্য নয়, তা শিক্ষনীয় বটে। কেননা তাতে অতিকথন নেই, মিথ্যা কথন নেই, আবার অতি প্রশংসাও নেই।

অনুষ্ঠানে কথাপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত ‘গোলাম মুরশিদ সংবর্ধনা গ্রন্থ’ এবং তার লেখা ‘শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়। শেষে দেখানো হয় ড. গোলাম মুরশিদের উপর গবেষক, শিক্ষক, লেখক মাহফুজা হিলালী নির্মিত ১৫ মিনিটের ডকুমেন্টারি ‘সত্য সন্ধানী’। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন বিধান চন্দ্র পাল ও ডালিয়া দাস।

বাংলাদেশ সময়: ২৩০৪ ঘণ্টা, মার্চ ১৯, ২০১৯
এইচএমএস/এমএইচএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।