ঢাকা, মঙ্গলবার, ৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ২১ মে ২০২৪, ১২ জিলকদ ১৪৪৫

ফিচার

ঐতিহ্য ও প্রাণের পটচিত্র-মুখোশ-আলপনা

আতাউর রহমান রাইহান, ফিচার রিপোর্টার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬১৯ ঘণ্টা, এপ্রিল ১১, ২০১৫
ঐতিহ্য ও প্রাণের পটচিত্র-মুখোশ-আলপনা ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: প্রায় পচিঁশ বছর আগে ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে চালু হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। সেই থেকে শুরু।

কালের পরিক্রমায় এটি রূপ নিয়েছে জাতীয় শোভাযাত্রায়।

এরপর সময়ের পালে হাওয়ার অনেক বদল ঘটলেও, এ শোভাযাত্রাই মানুষের আগ্রহের মূল কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। বাহারি নকশার সরা বা পট, টেরাকোটার তৈরি জিনিস, মুখোশ, মাটির পুতুল, কাগজের পাখি ইত্যাদি লোকজ সংস্কৃতি প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে প্রতিবারের শোভাযাত্রা।

রাজা-রানি, রাক্ষস, হাতি, বাঘ, পেঁচা, খরগোশ ও টেপা পুতুলসহ দেশীয় মোটিফে তৈরি বিচিত্র সব মুখোশ থাকে শোভাযাত্রায়। এছাড়া মাছ, জোড়া পায়রা, ছাগল, কাকতাড়ুয়া, বাঘ, ঘোড়ার আদলে বানানো হয় আমাদের লোকাচারের নানা কাঠামো। চারুকলাসহ নগরীর বিভিন্ন সড়ক সেজে ওঠে বর্ণিল আলপনায়।

এ নিয়ে জয়নুল গ্যালারির সামনে কথা হয় চারুকলা ইনস্টিটিউটের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী অনিন্দ্যর সঙ্গে।

অনিন্দ্য জানালেন, মাটির তৈজসপত্রের প্রাচীন ঐতিহ্যের সঙ্গে মিল রেখেই এসব আঁকা হয়। আবহমান বাংলার লোকায়ত জীবনে গৃহস্থালি কাজ ছাড়াও গৃহশোভা বাড়াতে ব্যবহৃত হয়ে আসছে মাটির সরা।

আরও জানান, সনাতন ধর্মে লক্ষ্মী ও দুর্গার সরায় ধর্মবিশ্বাসের রূপ আঁকা হতো। আগে ঢাকা ও ফরিদপুরে অঞ্চলে এ লোকাচার সীমাবদ্ধ থাকলেও, পরবর্তীতে কলকাতা ও চব্বিশ পরগনায় লক্ষ্মী, দুর্গা ছাড়াও রাধাকৃষ্ণের সরা দেখা যায়। লক্ষ্মীর উদ্ভব বাংলাদেশেই। শরতের আকাশভরা পূর্ণিমায় লক্ষ্মীর পূজা হয়। এর পটশৈলী, ছবি অঙ্কন ও আচাররীতি সবকিছুতেই আদি লোকজ ও দেশজ পরিচয় সুস্পষ্ট। লক্ষ্মীর সরায় বাহারি নকশায় ফুটে ওঠে ধানের শীষ, কলমি ও পেঁচা।

এছাড়া আমাদের লোকজ শিল্পশৈলীতে মুখোশও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের ব্যক্তি চরিত্রকে অন্য এক সত্ত্বায় রূপ দেয় মুখোশ। আদিম সমাজে অশরীরী আধিভৌতিক জগতের সঙ্গে ব্যক্তির সংযোগ ঘটাতে মুখোশের ব্যবহার হতো। প্রচলিত রয়েছে- ভাবমূর্তি, ঈশ্বর, জীবিত এবং মৃত মানুষের যোগসূত্র ঘটাতে মুখোশ রহস্য ও গুপ্তবিদ্যার হাতিয়ার। বাংলাদেশের ঢাকা, ময়মনসিংহ ও দিনাজপুরে মুখোশের প্রচলন ছিল।

এমনকি মুখোশ নৃত্য বলে বাংলাদেশে লোকনৃত্যের একটি স্বতন্ত্র ধারা রয়েছে। আদিকাল থেকেই ধর্মীয় রীতি, উৎসব, পার্বন থেকে শুরু করে আত্মরক্ষায় মুখোশের ব্যবহার হয়ে আসছে। মাটি, কাঠ, কাগজ ও প্লাস্টিক দিয়ে বানানো হয় মুখোশ।

চারুকলায় বৈশাখী শোভাযাত্রার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত শিক্ষার্থী আফিফ জানান, আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ হিসেবেই শোভাযাত্রায় মুখোশ ব্যবহার হয়ে থাকে। তবে কেবল বাংলাদেশে নয়, পৃথিবীর সর্বত্রই রয়েছে মুখোশের ব্যবহার। ফ্রান্স ও স্পেনে খ্রিস্টপূর্ব কুড়ি হাজার বছর আগে মুখোশের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে।

তবে ধর্মাশ্রয়ী মুখোশ যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে ধর্মবিযুক্ত মুখোশও। সবমিলিয়ে চারুকলার বর্ষবরণে মুখোশ একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। এছাড়া চৈত্রসংক্রান্তির গাজন, কালী, কাত্যায়নী, গঙ্গা, দুর্গা, লক্ষ্মী ও সরস্বতী পূজায় দেবীর মুখোশ ব্যবহার করা হয়।

পহেলা বৈশাখে চারুকলাসহ নগরীর বিভিন্ন সড়কের অন্যতম আকর্ষণ হলো আলপনা।

আলপনা নিয়ে শিক্ষার্থী আফিফ বলেন, আমাদের গ্রামীণ ঐতিহ্যের নানা উপলক্ষে হাড়ি, সরা, কুলা, পিড়ি, উঠান ও ঘরের মেঝেতে আলপনা আঁকতে দেখা যায়। সব ধর্মের লোকজনই ফুল, পদ্ম,  লতাপাতা, নৌকা, ধানের ছড়া, মাছ, ময়ুর, হাতি ইত্যাদি এঁকে থাকেন।

তিনি আরও বলেন, একসময় কৃষিভিত্তিক গ্রাম বাংলায় ষষ্ঠীব্রতে সন্তান কামনা করে দেয়াল আলপনা আঁকা হতো। বাংলাদেশের মুসলিম বিয়ের অনুষ্ঠানে আলপনা আঁকার রেওয়াজ এখনও রয়েছে। সাঁওতাল পল্লীতে শস্য ওঠার আগে-পরে দরজার পাশে আলপনা দেখা যায়।

আদিবাসী অঞ্চলে উৎসব বা সংক্রান্তির দিনে আলপনা করা হয়। খামারে ধান উঠলে বা যতদিন ধান থাকবে, ততদিন প্রতি বৃহস্পতিবার গৃহবধূদের আলপনা দেওয়ার রীতি রয়েছে।   

বাংলাদেশ সময়: ০৬২২ ঘণ্টা, এপ্রিল ১১, ২০১৫
এসএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।