ঢাকা, শনিবার, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১৮ মে ২০২৪, ০৯ জিলকদ ১৪৪৫

ফিচার

ছিন্নমূল শিশু

স্টেশনবাসী তিন টোকাই শিশুর কষ্টের গল্প

জান্নাতুল ফেরদৌসী, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১৪৯ ঘণ্টা, মার্চ ৩১, ২০১৫
স্টেশনবাসী তিন টোকাই শিশুর কষ্টের গল্প ছবি: কাশেম হারুন / বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: ‘আমার অবুঝ বয়সে মা মারা যাওনের পর বাপ বিয়া করছিলো। সৎ মা ঠিক মতোন খাওন দিত না।

পড়তে (লেখাপড়া) চাইছি পড়তেও দেয় নাই। তাই টোকাই হইছি। ’

কথাগুলো বলছিল খিলক্ষেত থেকে আসা বিমানবন্দর রেল স্টেশনের ক্ষুদে টোকাই হৃদয়। নীলফামারী থেকে এসেছে সুমন। পাশ থেকে সে বলে উঠল ‘আর আমার বাপ মা খাওন চাইলে কইতো ঘর থাইক্যা বার হইয়া যা। রাগ কইরা একদিন বাইর (বের) হইয়া ট্রেনে উইঠা এইহানে চইল্যা আইছি। ’

‘আমার বাপ তো আমারে মাইরা ঘর থাইক্যা বার কইরা দিয়া আর খোঁজই নেয় নাই। কয়দিন খালার বাড়ি থাকনের পর অভাবে ঢাকা চইল্যা আইছি’ -- বলল নরসিংদী থেকে আসা আরেকজন। নাম শাহ আলম।

সোমবার মধ্যরাতে সরেজমিনে ঘুরে দেখার সময় রেল স্টেশনে দেখা মেলে ওদের। তিন জায়গা থেকে এসে স্টেশনে পরিচয় হয় তিনজনের। এখন ওরা বন্ধু। সারাদিন পরিত্যক্ত বোতল কুড়িয়ে তিন বন্ধু ব্যস্ত হয়ে আনসার ক্যাম্পে ডাল আর ভাত আনতে যাচ্ছিল। কথা বলতে চাইলে উৎসাহ নিয়ে নিজেদের কথা বলতে শুরু করে ওরা।

ক্যাম্প থেকে পাওয়া ভাত খেয়ে পেট ভরে কিনা জানতে চাইলে সুমনের সহজ সরল উত্তর, ‘হ ভরে। তয় ডালের সাথে সবজি থাকলে খাইতে মজা লাগে। কপাল ভালো থাকলে মাঝে মাঝে সবজি পাওয়া যায়। ’

এই কথা বলতে বলতে হৃদয় ও শাহ আলম দৌড় দিলো একটু সামনে রেল লাইনে পড়ে থাকা বোতলের দিকে। তিনটি বোতল কুড়িয়ে এনে আবার দৌড়ে এলো।

সারাদিন বোতল কুড়িয়ে কত টাকা আয় হয় জানত চাইলে সুমন বলে, ‘ ২৫ টাকা কেজি কইরা বেচি। দুই দিন ধইরা বোতল টোকাইলে এক বস্তা হয়। তহন ১শ, ১শ ২০ টেকার মত বেচা হয়। ’

‘মাঝে মাঝে মাইনষের মালও টাইনা দেই। তয় কুলিরা দেখলে মারে। তাই মাল টানার কাজ বেশি করতে পরিনা। ’ --বলছিল হৃদয়।

রূঢ় বাস্তবতার সাথে এই শিশুবয়সে কঠিন যুদ্ধ করে চলছে এরা।   ওদের কথা শোনার কেউ নেই। দিনের বেলা কোথাও শুলে তাড়া করে স্টেশনে মোতায়েন পুলিশ। রাতের বেলা ঘুমালে মশা, নানা পোকার যন্ত্রণায় ঘুমানো যায় না। একটু কথা বলার সুযোগ পেয়ে প্রতিদিনের কষ্টের কথা গড়গড় করে বলে যাচ্ছিল সুমন।
সে আরও বলছিল, ‘শান্তি মতন ঘুমাইতেই পারি না। আর ঘুমাইলে তো চোর আইসা শার্ট-প্যান্ট খুইলা লইয়া যায় গা, পকেটের টাকা চুরি কইরা লইয়া যায়গা। দেহেন না আমার গায়ে শার্ট নাই। ’

‘হ। আমার পকেটে তো ৫ টেকাও রাখন যায়না। চুরি করে স্টেশনের চোরেরা। ’ বলল শাহ আলম।

বড় হয়ে কি হতে চায় ওরা। জানতে চাইলাম ওদের কাছে।   শাহ আলম বলে ‘আমি বাসে হেলপারি করুম। ’ ওর কথা কেড়ে নিয়ে সুমন বলে ‘আমি পলল মার্কেট (পলওয়েল মার্কেট) দোকান করুম। ’

তবে এদের মধ্যে একটু বড় আর বুদ্ধিমান হৃদয় বলে অন্যকথা। ‘আমার কিছু হওনের ইচ্ছা নাই। তয় লেখা পড়া করনের ইচ্ছা হয় খুব। ’

একথা বলার পর ওর চোখের দিকে তাকানো গেল না। এইটুকু কি পাওয়ার অধিকার রাখে না ওরা?

ওদের সাথে কথা বলতে বলতে পাশে এসে দাঁড়ায় বয়স্ক মতন এক লোক। খানিকটা অভিযোগের সুরে বলন, ‘আপনারা লেখালেখি কইরা হেগো লাইগা কিছু করেন। সারাদিন এইখানে ওইখানে পইড়া থাকে। পুলিশের গুঁতা, কুলিদের লাথি খাইয়া জীবন যায় ওদের। সরকার জানি (যেন) ওদের দিকে একটু নজর দেয়। ’

বয়স্ক লোকটির কথায় ব্যঙ্গ করে শাহ আলম বলে ওঠে ‘ঘোড়ার ডিম দিব সরকার। আমরা রাস্তায় বড় হইতাছি, রাস্তায়ই থাকতে অইবো। পেটের কষ্ট সহ্য করতে হইবো। কেউ কিচ্ছু  দিব না আমগো। ‘

কথাগুলো বলেই আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ভাত আনতে ছোটে ওরা।

স্টেশন, বাজারে এমন অসংখ্য ছেলেমেয়ে রয়েছে যাদেরকে আমরা টোকাই বলে ডাকি। এদের অতীত নেই। নেই ভবিষ্যৎ। রয়েছে শুধু ক্ষুধায় ভরা বর্তমান। হতদরিদ্র ও ছিন্নমূল এসব শিশু কি আমাদের রাষ্ট্রের চোখে পড়ে না?

বাংলাদেশ সময়: ০১৪০ ঘণ্টা, মার্চ ৩১, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।