ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

ফিচার

মীর মশাররফের বাস্তুভিটায় উথলে ওঠে বিষাদসিন্ধু

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ ও শরীফ বিশ্বাস | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০১৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০১৪
মীর মশাররফের বাস্তুভিটায় উথলে ওঠে বিষাদসিন্ধু

কুষ্টিয়া থেকে ফিরে: মহাসড়ক পার হওয়ার সময় চোখে পড়বে বিশাল আকারের রোড সাইন। কুষ্টিয়া-রাজবাড়ী মহাসড়কের পাশে বাংলা-ইংরেজি অক্ষরে বড় করে সাহিত্যিক মীর মশাররফ হোসেনের বাস্তুভিটায় যাবার পথনির্দেশ করা হয়েছে।


 
রো্ড সাইনটি দেখে অনেকের মতো আমারও মনে সন্তুষ্টি জেগেছে---যথার্থই হয়েছে সাহিত্যিকের মূল্যায়ন। কিন্তু কুমারখালী উপজেলায় লাহিনীপাড়া গ্রামের দক্ষিণে বাঁক নিয়ে চারশ’ মিটার এগিয়ে মীর মশাররফ হোসেনের বাস্তুভিটায় গেলে যে কারোরই মন ব্যথায় ভরে উঠবে।
 
সাহিত্যিকের আঙ্গিনা দেখতে এসে ভক্তরা বরাবরই আকুলতা প্রকাশ করেন। ‘তোমাকে জীবিত থাকতে তো নয়ই, পরলোকে যাওয়ার পরও সঠিক মর্যাদাটুকু দিতে পারি নি। বসতভিটাও রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছি আমরা। বাংলা সাহিত্যের মুকুটহীন সম্রাট, তুমি আমাদের ক্ষমা করো’- এমনিভাবেই সাহিত্যিকের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা ভক্তদের।
 
আঠারো শতকের এ সাহিত্যিকের সৃষ্টিকর্ম ‘বিষাদসিদ্ধু’ দেশের সীমানা অতিক্রম করেছিল। আর তাই তো লেখকের বাস্তুভিটার বর্তমান করুণ দশা দেখে হতাশ হন ভিনদেশিরাও। স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার’র গভর্নর অরুন্ধতী ভট্টাচার্য ২০১২ সালে সপরিবারে এসেছিলেন মীর মশাররফ হোসেনের বসতভিটা দেখতে। মন্তব্য বইয়ে তিনি লিখে গেছেন: ‘জীবনের একটি স্বপ্ন পূরণ হল। এই অভিজ্ঞতার জন্য ধন্যবাদ। ’

1_97

লিখিত বক্তব্যে অভিজ্ঞতার সুখ-দুঃখের পার্থক্য না করলেও এই সাহিত্যিকের প্রতি অবহেলা দেখে কষ্ট পাওয়ার কথা জানিয়েছেন কবির পঞ্চম পুরুষ মীর মাহবুব-উল আরিফের কাছে। তিনি মীর মশাররফ হোসেন পাঠাগারের দেখভাল করে থাকেন।
 
সাহিত্যিক মীর মশাররফ হোসেনের বসতভিটাটি অনেক আগেই বেদখল হয়ে গেছে। ১৯৭২ সালে স্থানীয়রা মূল বাড়ির জায়গাটির কিছু অংশ উদ্ধার করে সেখানে স্থাপন করেছেন মীর মশাররফ হোসেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। আর ১৯৯৫ সালে বিদ্যালয়টির মাঠের এক কোণে স্থাপন করা হয় মীর মশাররফ হোসেন উচ্চ বিদ্যালয়।
 
একই মাঠের পশ্চিম-উত্তর কোণে কবির বসতঘর এক সময় চলে যায় অবৈধ দখলদারদের কবলে। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! পাঠাগার স্থাপনের জন্য জেলা পরিষদকে অর্থের বিনিময়ে সাহিত্যিকের ভিটা কিনে নিতে হয়। তারপর ১৯৯২ সালে তৎকালীন জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহীর তত্ত্বাবধানে গড়ে ওঠে মীর মশাররফ হোসেন পাঠাগার।
 
৯ ফ্রেব্রুয়ারি রোববার বিকেলে পৌঁছাই স্কুল চত্বরে। সঙ্গে বাংলানিউজের কুষ্টিয়া প্রতিনিধি শরীফ বিশ্বাস। স্কুল ঘিরে উঠেছে তিন ফুট উঁচু ইটের দেয়াল। মূল ফটকের বাইরে রয়েছে তিনটি চায়ের দোকান। ফটক পেরুতেই মাঠের মাঝে চোখে পড়ে বেশ কয়েকটি ত্রিকোণাকৃতি স্তম্ভ।

2_3777

স্তম্ভগুলোতে মার্বেল পাথরে খোদাই রয়েছে মীর মশাররফ হোসেনের বিভিন্ন বইয়ের বিখ্যাত উক্তিসমুহ। কিন্তু সেই মার্বেল পাথরের খোদাইও জীর্ণ। অনেক আগেই পাথর-চূর্ণ উঠে বিকৃত হয়ে গেছে সে সব অমর বাণী। পূর্ণাঙ্গ রূপে পড়া কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। অন্তত যিনি এর সঙ্গে পরিচিত নন, তার পক্ষেতো নয়ই।
 
প্রথম স্তম্ভটিতে রয়েছে : স্বাধীনতার সূর্য একবার অস্তমিত হইলে পুণরুদয় হওয়া বড়ই ভাগ্যের কথা-বিষাদসিন্ধু। ”
 
কিন্তু বিখ্যাত উক্তিটির রঙ চটে গিয়ে এমন দাঁড়িয়েছে, “স্বাধী..ত.. সুয. ..বার অস্তমিত হইলে পুণরদয় হওয়া বড়হ. ভাগে.. কথা.. বিষাদ সিন্ধু। ’ আবার ‘ত’ বর্ণের একাংশ উঠে গিয়ে অনেকটা ‘এ’ আকৃতি ধারণ করেছে। ”
 
এই বিকৃতি দেখে যে কেউ বেদনাকাতর হয়ে পড়বেন, শেষ বিকেলে আমার মনেও জমে মেঘ। ফটক পার হতেই হাতের ডানে পড়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়। আর সোজা পশ্চিম প্রান্তে মাধ্যমিক বিদ্যালয়টি। ২০১০ সালে মাঠটির উত্তর-পশ্চিম কোণে দক্ষিণমুখি করে একই কমপ্লেক্সে পাঠাগার কাম অডিটোরিয়াম স্থাপন করা হয়েছে।

_683
 
পাঠাগার কাম অডিটোরিয়ামটিতে প্রবেশ করার পর হতাশা আরো চেপে বসে। সেখানে মীর মশাররফ হোসেনের রচিত কোনো বই নেই। ১৯৯২ সালে স্থাপিত পাঠাগারটির জন্য দু’দফায় বরাদ্দ করা দেড় লাখ টাকার বই আসে।
 
কথা হয় মীর আরিফের সঙ্গে। তিনিই জানিয়েছিলেন, অরুন্ধতী ভট্টাচার্যের হতাশার কথা। এবার বললেন, দ্বিতীয় দফায় আসা এক লাখ টাকার বই ডিসির বাংলোতে শোভা পাচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে।
 
প্রথম দফায় জাতীয় গণগ্রন্থাগার থেকে দেওয়া ৫০ হাজার টাকার বই পড়ে আছে মীর মশাররফ হোসেন উচ্চ বিদ্যালয়ের ‘দখলে’। শিক্ষক কমনরুমে রাখায় ওই বইগুলো শিক্ষার্থীরা ইচ্ছা থাকলেও পড়তে পারছে না।
 
অন্যদিকে অনেকদিন ধরে তার রচিত বইগুলোর নতুন সংস্করণ না হওয়ায় কোনো কপি আর বাজারে নেই। ইচ্ছা থাকলেও কেউ কিনতে পারছে না বলে জানান আরিফ।
 
আরিফের সঙ্গে জমে ওঠে এই মশাররফ ভক্তের গল্প। ঝরে পড়ে শুধু না পাওয়ার ক্ষোভ আর বেদনা।
 
গত বছর বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক সামসুজ্জামান খানের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন তিনি। মহাপরিচালক জানিয়েছেন, একজনকে ভূমিকা লিখতে দেওয়া হয়েছে, পাওয়া গেলেই নতুন করে বই ছাপা হবে। । সেই ভূমিকা লেখা এখনো হয়তো শেষ হয় নি!

ic_4_1
 
অডিটোরিয়াম বেশি বড় নয়, ঘুরে দেখছিলাম। কবির ব্যবহৃত আরাম-কেদারা, বেতের তৈরি যুদ্ধাস্ত্র-ঢাল, বদনা, কাঠের টুলে হাতড়ে বেড়াচ্ছিলাম বাংলা সাহিত্যের এ দিকপালকে। রয়েছে একটা পালকিও। দেওয়ালে সাঁটা রয়েছে দেশি বিদেশি কবি, সাহিত্যিক ও মনিষীর ছবি। দেয়ালে ফ্রেমে বাধাঁনো কবির নিজ হাতে লেখা পাণ্ডুলিপির অংশ বিশেষ। ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে হলেও, নিয়ম ভাঙলাম না।
 
পুরো ঘরটিতে বেশ ক’টি চেয়ার, বই রাখার জন্য একটি শেলফ। আর কবির হাতের রোপিত আমগাছের ধ্বংসাবশেষ সংরক্ষণ করা হয়েছে।
 
পাঠাড়ার কাম অডিটোরিয়ামটির বারান্দায় এলাম। শেষ বিকেলের সূর্য টকটকে লাল। সামনের মাঠে গ্রামের ছেলেরা ক্রিকেট খেলায় ব্যস্ত। বারান্দায় বসে যারা খেলা দেখছিল, তাদের মধ্যে রয়েছে মীর মশাররফ হোসেন উচ্চ বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র শুভ আহমেদ।
 
শুভর পাশে আসন নিলাম। কথা বলি মীর মশাররফ হোসেন নিয়ে। সাহিত্যিক সর্ম্পকে তার কাছে জানতে চাইলে সে বললো: ‘আমি কিছু জানি না। ’ সত্যি মনটা খারাপ হয়।
 
আবারো আশা নিয়ে জিজ্ঞেস করি, পাঠাগার কাম অডিটোরিয়ামটিতে সে কখনও প্রবেশ করেছে কি-না। শুভ’র জবাব: সেখানে মীর মশাররফ হোসেন এবং তার স্ত্রীর ছবি আছে। আরও বড় বড় মানুষের ছবি আছে। পাটি ও বেতের ঢাল রয়েছে সেখানে।
 
স্কুলেও মীর মশাররফ হোসেন সম্পর্কে কিছুই শোনে নি বলে জানায় শুভ। আর কথা এগোয় না শুভ’র সঙ্গে।
 
প্রায় দুই যুগ আগে আমি নবম শ্রেণির ছাত্র ছিলাম। বাংলা বইয়ে পাঠ ছিলো মীর মশাররফ হোসেন’র লেখা ‘রাষ্ট্রনীতি ও স্বাধীনতা’ প্রবন্ধটি। প্রবন্ধটি এখনো আমাকে ভাবায়।

_5_7017
 
এরপরের সময়গুলোতেও পাঠ্যসূচিতে ছিলেন মীর মশাররফ হোসেন। নাটক জমিদার দর্পণ, অমর কাব্য বিষাদসিন্ধুসহ বেশ কিছু নাটক আর প্রবন্ধ কিশোর মনকে করে তুলতো রাজনীতি সচেতন আর যোগাতো শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই করার সাহস।  
 
কিন্তু নতুন পাঠ্যসূচিতে বাংলার এই কালজয়ী সাহিত্যিকের লেখা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে অনেক স্তর থেকে। এরই সঙ্গে তার স্মৃতিও মুছে যেতে শুরু করেছে। পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি নিজ বসতবাড়ি থেকেও নির্বাসনে সাহিত্যিক মীর মশাররফ হোসেন।
 
জন্মস্থান লাহিনীপাড়ার নতুন প্রজন্ম এমনকি মীর মশাররফ হোসেন উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও জানে না তার অমর সাহিত্য গাথা। জানে না বাংলা সাহিত্যের স্বর্ণযুগের সেই সব বীরত্বগাথা, সেই সব সাহসী শব্দের অলংকার।
 
পঞ্চম বংশধর মীর আরিফ জানান, মীর মশাররফ হোসেন’র বসতবাড়িটি ছিলো ৩২ বিঘা জমির ওপর। কিন্তু এখন মাত্র তিন বিঘা জমি দখলে রয়েছে। অন্যগুলো অবৈধ দখলদারদের কবলে। অনেকে জমি ফেরত দিতে চান। তবে বিনিময়মূল্য দাবি করছেন। অর্থ সংকটের কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না।
 
আরিফ আরও জানান, মীর মশাররফ হোসেন রচিত ৭৪টি পাণ্ডুলিপির সন্ধান পাওয়া গেছে এ পর্যন্ত। এসবের মধ্যে বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে ৩২টি । ‘ভাই ভাই এইতো চাই, ফাঁস কাগজসহ ৪২টি পাণ্ডুলিপি এখনও রয়েছে অপ্রকাশিত।
 
১৮৪৭ সালের ১৩ নভেম্বর জেলায় কুষ্টিয়া জেলার (তৎকালীণ অবিভক্ত নদীয়া জেলায়) কুমারখালীর লাহিনীপাড়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এই সাহিত্যিক। আর ১৯১১ সালের ১৯ ডিসেম্বর অবিভক্ত ফরিদপুর জেলার পদমদী-নবাববাড়িতে (বর্তমান রাজবাড়ি জেলায়) পরলোকগমন করেন।
 
অন্ধকার নেমে আসে মীর মশাররফ হোসেন স্কুল মাঠে। বিষাদের সিন্ধু বুকে চেপেই পা বাড়াই অযত্নে-অবহেলায় পড়ে থাকা তার বাস্তুভিটার ফটকের পথে...।
 
বাংলাদেশ সময়: ০০২০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
welcome-ad