ঢাকা, রবিবার, ২১ বৈশাখ ১৪৩১, ০৫ মে ২০২৪, ২৫ শাওয়াল ১৪৪৫

ফিচার

মাংস খসে পড়া সন্তানের মুখে মায়ের নিরাপত্তার কথা

মুক্তিযুদ্ধ ও কুমিল্লার একটি গ্রাম

মোস্তফা হোসেইন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৩৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১১, ২০১০
মুক্তিযুদ্ধ ও কুমিল্লার একটি গ্রাম

মাটির দেয়ালঘেরা ঘর। ১৮ হাত লম্বা।

এক ইঞ্চি জায়গাও নেই শুকনো। চাক চাক রক্ত। পুরো এক দেড় ইঞ্চি তো হবেই। কোলের ছোট শিশুটিকে শোয়ানোর মতো সামান্য জায়গাও নেই খালি।   হাত দিয়ে রক্ত ঠেলে একটু জায়গা করে নিলেন মা। তারপর একটা কাঁথা বিছিয়ে সেখানে শুইয়ে দিলেন কোলের শিশু জামালকে। বীভৎস্য দৃশ্য দেখে দেখে ঘুম চলে গেছে সখিনা খাতুনের।

তাকালেন দরজার দিকে। রক্তের নিচে চাপা পড়ে আছে তার সন্তান। দুই ঊরু থেকে মাংস উধাও হয়ে গেছে। হাঁটুর নিচেও মাসলসহ হাড্ডি আলাদা। একটি স্পি­ন্টার ভেদ করে গেছে বুক।
 
মৃত সন্তানকে আগলে রেখে রাত কাটাবেন এক মা। রাতের গভীরে মনে হলো তিনি নিঃসঙ্গ। তার সামনে শুয়ে থাকা কিশোরটি তার সন্তান হলেও ওটা এখন লাশ। জামালউদ্দিন জীবিত হলেও সে ঘুমোচ্ছে কাঁথায় শুয়ে। কোলের শিশু সে। নিজে আহত না হলেও সারা গায়ে তার মৃতদের রক্ত। মনে হতে থাকে দিনের বেলার দৃশ্য, বীভৎস সব চিত্র।
 
আশ্বিন মাসের একদিন। বেলা তখন ১১টা। খবর পাওয়া গেল চান্দলা যুদ্ধে নিহত পাকিস্তানি সৈন্যদের লাশ কামতানা নদী দিয়ে কালামুড়ার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার চান্দলা ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর বড় ঘাঁটি। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা সুযোগ পেলেই মন্দবাগ দিয়ে ঢুকে পড়ে পশ্চিমে। অথচ এই গ্রামেও আছে পাকিস্তানিদের ক্যাম্প। বিচ্ছুদের ওদিকে পরোয়া নেই।

সেবারও তেমনি একটি বেপরোয়া যুদ্ধ সংঘটিত হলো, যার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সুবেদার ওহাব। চান্দলার পূর্বদিকে সাজঘর ছক্কার মার পুলের এখানেই হলো যুদ্ধটা। পাখির মতোই মরেছে পাকিস্তানিরা। মুক্তিযুদ্ধের এত বড় সাফল্য সে সময় সত্যিই বেশ আনন্দের ছিল। কিন্তু সখিনা খাতুন জানতেন না এরপর কী ঘটতে পারে। কিন্তু সখিনার ছেলে মতিউর বলছিল, ‘মা গো ইতানে দেশটারে শেষ কইরা লাইব। মাগো আমরা বুঝি আর বাঁচতাম পারতাম না’।

পরদিন সকালবেলা পাকিস্তানিরা তাদের লাশ নিয়ে সরে যাচ্ছিল। কিন্তু ওদের কভারিং দেওয়ার জন্য এল পাকিস্তানি বাহিনীর যুদ্ধবিমান। হয়তো বা বিমানগুলো তেমন মারমুখো হতো না, হয়তো বা ওরা নিশ্চিত ভাবত, মন্দবাগ গ্রামটি নিরাপদ ওদের জন্য। আচমকা মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ হলেও গ্রামের দক্ষিণ প্রান্তে বাজারে আছে পাকিস্তানের ক্যাম্প। হয়তো পাকিস্তানিদের সেই চিন্তায়ও বাধা পড়ল। উত্তর পাড়া থেকেই পেলো বাধা। সুবেদার ওহাবের বন্দুক গর্জে উঠল পাকিস্তান বাহিনীর বিমানের দিকে।

বাধা পেয়ে ওরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। খানিক নীরব থেকে আবারো আসে বিমান।   বিমান থেকে মুহর্মুহু বোমা ফেলতে থাকে মন্দবাগ গ্রামে। এমন সময় মোহাম্মদ আলী খলিফার ঘরে সবাই এসে জড়ো হতে থাকে। উদ্দেশ্য মাটির ঘরে হয়তো বোমা আঘাত হানতে পারবে না। কিংবা গুলি হলে মাটির ঘর ভেদ করে মানুষের গায়ে লাগবে না। অনেক মানুষ তখন ওই ঘরটায়। সখিনা খাতুন কোলের গিয়াসউদ্দিনকে আকড়ে ধরেন। ডাকেন মতিউর রহমান ও কামালউদ্দিনকে। ঘরের মানুষ দোয়া-দরুদ পড়ছে। কান ফেটে যাওয়ার মতো অবস্থা তখন। বাড়ির বিভিন্ন জায়গায় বোমা পড়ছে। গাছে পড়ে গাছগুলো ভেঙ্গে পড়ছে। সেই বোমার একটা যদি এসে পড়ে ঘরের ভিতর তাহলে নিশ্চিত মৃত্যু। এমন অস্বাভাবিক অবস্থায় সবাই বেঁচে থেকেও যেন মরে আছে।

বেলা তখন অর্ধেক হবে। হঠাৎ একটা বোমা এসে পড়ল মোহাম্মদ আলী খলিফার ঘরে। মনে হলো কিয়ামত হয়ে গেছে। ধোঁয়ায় ছেয়ে গেছে ঘরের ভেতর। রাতের অন্ধকার যেন। চিৎকার আর্তনাদ শুরু হলো মুহূর্তে। এ চিৎকারের শব্দ শোনা যায় না। অনুভব করা যায়। বোমার শব্দে সবাই শ্রবণশক্তি হারিয়ে ফেলেছে ইতোমধ্যে।

সখিনা খাতুন ছিলেন পেছনের দরজার কাছে। ওই দরজাটা যে কীভাবে খোলা হলো তার মনে নেই। কোলের শিশুটাকে নিয়েই তিনি ঘরের উত্তর পাশের কাঁঠালগাছের গোড়ায় গিয়ে বসে পড়েন। মনে হতে থাকে দুনিয়াটা যেন ঘুরতে শুরু করেছে। চোখেমুখে কিছু দেখতে পারছিলেন না তিনি। বসে বসে মাথা থাপ্পড় মারছিলেন আর আল্লাহকে ডাকছিলেন। ঘরে যে এতগুলো মানুষ, সেখানে যে তার সন্তানও রয়েছে সেই কথাও তিনি ভুলে গেলেন। আতঙ্কিত মেয়ে জোহরা দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে সখিনা খাতুনকে। তার মনে হতে থাকে, তাকে ভেঙ্গে পড়লে চলবে না। তিনি ওঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করেন। কানে বাজে মেয়ের চিৎকার। বলে, ‘মাগো সব শেষ অইয়া গেছে । উডানে চাও। ’ সখিনা খাতুন স্থির থাকতে পারেন না আর। এক হাতে মেয়েটাকে আরেক হাতে কোলে ধরেছেন ছেলেটাকে। টেনে নিয়ে যান উঠানের দিকে। মাঝ উঠানে গিয়ে বসে পড়েন সখিনা। কী বীভৎস চেহারা হয়ে গেছে কৈশোর-উত্তীর্ণ তার সন্তানের। মতিউর রহমান তার নাম। উরু থেকে মাংস টুকরো হয়ে বের হয়ে গেছে। হাঁটুর নিচেও মাংস নেই। বুক থেকে কলকল করে রক্ত বের হচ্ছে। তখনো ছেলেটার কথা বন্ধ হয়নি। মাকে ডাকছে ‘মা সইরা যাও। আবারো বোমা পড়ব। গুলি করব। দেশটা তামা কইরা ফালাইব ইতানে (ওরা)। ’ একটা চিৎকার দিয়ে বসে পড়েন সখিনা বেগম।

জোহরা বলে, মাগো ঘরে আইও। সখিনা খাতুন তখন প্রায় উন্মাদ। দৌড়ে চলেন ঘরের ভেতরে। অন্তত ২৫-৩০ জন মানুষ। রক্তে ভাসছে তারা। জবাই করার পর যেমন করে মৃত্যুন্মুখ পশু, তেমনি করছে কেউ কেউ। জবাই করা মুরগির মতো তড়পাচ্ছে তারই ছেলে ৯ বছরের শিশু জামালউদ্দিন। কী করবেন মা? জোহরা কাঁপছে কবুতরের বাচ্চার মতো। ডাকছে তার ভাইকে। এগিয়ে যেতে পারছে না তার কাছে। ভয় পাচ্ছে নিশ্চয়ই।

সখিনা খাতুন দ্রুত এক কলস পানি ঢেলে দেন জামালউদ্দিনের গায়ে। কিন্তু তাতেও থামছে না তার অস্থিরতা। মায়ের মন মানে না কোনোমতেই। জড়িয়ে ধরেন জামালউদ্দিনকে। শুইয়ে দিতে চেষ্টা করেন মাটিতে, যেখানে রক্তের পুরুত্ব বেড়েই চলেছে। ছেলেটা একবারের জন্যও কথা বলল না। নিথর হয়ে যেতে থাকল। চোখ বুজে গেল। কিছুণের মধ্যেই আরো নিথর হয়ে এলো তার দেহ। বোঝা গেলো আর ডেকেও লাভ হবে না। সখিনার জামালউদ্দিন চিরদিনের জন্য চলে গেছে।

তাকালেন ঘরের অন্যদের দিকে। নবাব মিয়াটা পড়ে আছে ঘরের মাঝখানে। বোমার আঘাতে ছিন্ন হওয়া ঘরের চাল ভেদ করে যে রোদ এসেছে সেই রোদের ছোঁয়া লেগেছে তার গায়ে। সখিনা খাতুনের ফুপুর সংসার এই ঘরেই যেন শেষ হয়ে গেছে। আলিমও ছিল তার সন্তান। ধরটা আলাদা হয়ে গেছে বোমার আঘাতে। ইদুর গায়েও বোমা পড়েছে (বেঁচে গেছে সে)। সখিনা খাতুনের পাশের বাড়ির ওয়াহেদ, তার ভাই, পরু,  মনিয়ন্দের দুই শিশু (নাম মনে নেই)। মরে গেল ওরা। রহিমা, রায়হান, ইবরাহিম, সুলতান, আব্দুল আলীম এমন তেরজন মারাত্মক আহত হয়েছিলেন। বিকেল নাগাদ মৃতদের সরিয়ে নেয় তাদের নিকটজনরা। আহতরাও স্থানান্তরিত হলো ভারতের হাসপাতালে।

মতিউর রহমানসহ বেঁচে থাকা অনেককেই আত্মীয়-স্বজন মিলে ভারতে নিয়ে যায় চিকিৎসার জন্য। পথে- কোনাবন (ভারত) বাজারের কাছে গাড়িতে উঠানোর সময়ই মারা যায় মতিউর। তাকে গ্রামে ফিরিয়ে আনা হয় পরের দিন।
 
আত্মীয়স্বজন আসে মতিউরদের দাফন করতে। গ্রামেই দাফন করা হয় মোহাম্মদ আলী খলিফার দুই ছেলেকে। বাকী আটজনের নিকটজনরা নিয়ে যায় তাদের। দাফন করা হয় বিভিন্ন জায়গায়।

সংযোজন
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা উপজেলার মন্দবাগ গ্রামে মোহাম্মদ আলী খলিফার ঘরে তার স্ত্রীর সঙ্গে কথা হতেই চোখ পড়ে ঘরের বেড়ায়। বেশ উঁচুতে ঝুলে আছে একটি ছবি। গুনা দিয়ে পেঁচানো। মোহাম্মদ আলী বাজার থেকে কিনে এনেছিলেন য্দ্ধু শুরুর সময়। যুদ্ধ শুরু হলে মানুষ বলেছে এটা টানিয়ে রাখলে নাকি পাঞ্জাবি (পাকিস্তানি বাহিনী) বাড়িতে আগুন দেবে না। তাই টানিয়ে রেখেছিলেন।

মোহাম্মদ আলীর ঘরটায় বোমা পড়লেও আগুন লাগেনি। অত থেকে যায় সেই ছবি। বাবার কেনা ছবি। তাই ছেলেরা আজো সযতে রেখে দিয়েছেন।

সখিনা খাতুনকে বলা হয়,  এটা আইয়ুব খানের ছবি, যারা তাকে সন্তানহারা করেছে। নড়েচড়ে ওঠেন সখিনা খাতুন। চেয়ে থাকেন ছবিটার দিকে। মনে হয়, ছবিটা বুঝি তিনি নতুন দেখছেন। ধুলাবালির আস্তর ছেড়ে যেন ছবিটা জীবন্ত হয়ে উঠছে তার কাছে। সখিনা খাতুন কি সেই ঘাতকদের ঘৃণা করেন?

বাংলাদেশ সময় ২১০৫, ডিসেম্বর ১১, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।