আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলনের অন্যতম প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে ইরানের পরিচিতি আছে। কিন্তু সাম্প্রতিক জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ফিলিস্তিন-সংক্রান্ত প্রস্তাবে ইরান ভোটদানে বিরত ছিল।
প্রেক্ষাপট: জাতিসংঘের ভোটাভুটি
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গত ১২ সেপ্টেম্বর ফিলিস্তিনকে পূর্ণ সদস্যপদ প্রদানের প্রস্তাবটি উত্থাপন করে সৌদি আরব ও ফ্রান্স। এই খসড়া প্রস্তাবটি ‘নিউইয়র্ক ঘোষণা’ নামে পরিচিত। এতে ফিলিস্তিন প্রশ্নের শান্তিপূর্ণ সমাধান ও দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের মাধ্যমে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সমর্থন জানানো হয়। প্রস্তাবটির পক্ষে ১৪২ ভোট পড়ে। যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল, আর্জেন্টিনা, হাঙ্গেরিসহ ১০টি দেশ এর বিরোধিতা করে। ইরান, ইরাক, আফগানিস্তান, তিউনিসিয়া, ভেনেজুয়েলা, বলিভিয়া, ভুটান, ইরিত্রিয়াসহ ১২টি দেশ ভোটাভুটিতে অনুপস্থিত ছিল। প্রস্তাব গ্রহণের সময় যুক্তরাজ্য, কানাডা, ফ্রান্স, বেলজিয়াম ও অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার ঘোষণা দেয়।
‘নিউইয়র্ক ঘোষণা’র সাত পাতার এই দলিলটি মূলত জুলাই মাসে জাতিসংঘে সৌদি আরব ও ফ্রান্সের আয়োজিত আন্তর্জাতিক এক সম্মেলনের ফল। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল ওই সম্মেলন বর্জন করেছিল। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু একদিন আগে ঘোষণা করেছিলেন, ’ফিলিস্তিন রাষ্ট্র কখনো প্রতিষ্ঠিত হবে না। ’
নিউইয়র্ক ঘোষণা: মূল বিষয়বস্তু
গাজার বেসামরিক জনগণের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের হামলা, অবকাঠামো ধ্বংস, অবরোধ ও অনাহার নীতির নিন্দার পাশাপাশি, হামাসের ৭ অক্টোবরের আক্রমণসহ কিছু পদক্ষেপেরও নিন্দা করা হয়েছে, যা ইরানের আপত্তির অন্যতম কারণ। এ ছাড়া, গাজায় অস্থায়ী আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী মিশন স্থাপনের প্রস্তাব, যাতে আরব ও ইউরোপীয় দেশগুলো অংশ নেবে, ইসরায়েলি বাহিনীর উপস্থিতি বন্ধ করবে এবং নিরাপত্তা দায়িত্ব ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের হাতে হস্তান্তর সহজ করবে।
ইরানের আপত্তির কারণ
জাতিসংঘে ‘দুই রাষ্ট্র সমাধান’ প্রস্তাব করা হয়েছিল—যেখানে ইসরায়েলকেও বৈধ রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার কথা বলা হয়। কিন্তু ইরান মনে করে, ইহুদিবাদী ইসরায়েল ফিলিস্তিনের ভূমি দখলকারী। ইসরায়েলকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার অর্থ ফিলিস্তিনিদের রক্তের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা। মূলত এ কারণে ইরান এই ভোটাভুটিতে অংশ নেয়নি।
ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধে দৃঢ় সমর্থনের পাশাপাশি ইরান মনে করে, স্থায়ী শান্তি কেবল ইসরায়েলি দখলদারির অবসান ও একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই আসতে পারে। এর ভিত্তি হবে মুসলিম, ইহুদি ও খ্রিস্টান অধিবাসীদের সর্বজনীন গণভোট, যা ইরান ২০১৯ সালের প্রস্তাব (এস/২০১৯/৮৬২)-এও উত্থাপন করেছিল।
ইরানের ভোট না দেওয়ার পেছনে আরও কয়েকটি কূটনৈতিক ব্যাখ্যা
ইরানের অবস্থান হলো, ফিলিস্তিনি জাতির ঐতিহাসিক ও অবিচ্ছেদ্য অধিকার স্বীকৃতি ছাড়া টেকসই ও প্রকৃত শান্তি সম্ভব নয়। গত চার দশকে তেহরান বহুবার বলেছে, তথাকথিত দ্বিরাষ্ট্র সমাধান বর্তমান পরিস্থিতিতে শুধু সংকটের অবসান ঘটাতে ব্যর্থ নয়, বরং মূল কারণগুলোকে উপেক্ষা করে দখলদারিত্ব বজায় রাখে। ইরান মনে করে, এটি আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী জাতিগুলোর আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের পরিপন্থী।
ইরানের মতে, ফিলিস্তিনে ইহুদিবাদী প্রকল্প আসলে পশ্চিম এশিয়ায় এক ঔপনিবেশিক পরিকল্পনার অংশ, যা ভূমি দখল, নিয়মতান্ত্রিক বৈষম্য (আপার্টহেইড) ও সহিংসতার মাধ্যমে ন্যায়সঙ্গত শান্তিকে দুর্বল করেছে। তেহরান বারবার বলেছে, সংকটের দায় সমানভাবে দখলদার ও দখলকৃত জনগণের ওপর চাপানো হলো প্রকৃত বাস্তবতার বিকৃতি। এই ভিত্তিতে ইরান জাতিসংঘে ফিলিস্তিন সংকট সমাধানের জন্য এক প্রস্তাব জমা রেখেছে—একটি জাতীয় গণভোট, যেখানে ফিলিস্তিনের মূল অধিবাসী মুসলিম, খ্রিস্টান ও ইহুদিরা অংশ নেবে।
ইরানের যুক্তি ও কূটনৈতিক ব্যাখ্যা
জাতিসংঘ মহাসচিবকে পাঠানো ব্যাখ্যায় ইরান বলেছে, ফ্রান্স–সৌদি প্রস্তাবিত এই খসড়া বাস্তব সমস্যার মূল কারণ তুলে ধরেনি, কার্যকর সমাধান দেয়নি, বরং দখলদার ইসরায়েলকে আড়াল করেছে।
সংকটের দায় ভাগাভাগি
দলিলে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যেন ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনিরা সমানভাবে দায়ী। অথচ ইসরায়েল পশ্চিমা শক্তি, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় দীর্ঘদিন ধরে দখল, গণহত্যা ও বৈষম্য চালিয়ে আসছে।
৭ অক্টোবরের ব্যাখ্যা
ঘোষণায় ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ সংগঠনগুলো ‘আল আকসা তুফান’ অভিযানকে সংকটের সূচনা বলা হয়েছে। অথচ ইরানের মতে, এটি ৮০ বছরের দখল ও সহিংসতার পরিণতি।
আত্মরক্ষার অধিকার উপেক্ষা
দলিলটি ফিলিস্তিনিদের বৈধ আত্মরক্ষার অধিকারকে বাদ দিয়েছে এবং তাদের প্রতিরোধ আন্দোলনকে নিন্দা করেছে, অথচ ইসরায়েলের গণহত্যামূলক প্রতিশোধকে আড়াল করেছে।
প্রতিরোধ গোষ্ঠীর নিরস্ত্রীকরণ দাবি
এটি ফিলিস্তিনিদের পুরোপুরি অরক্ষিত করে দেবে।
অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ
ঘোষণাটি ফিলিস্তিনের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক কাঠামো নিয়ে মতামত দিয়েছে, যা ইরানের মতে, এক ধরনের হস্তক্ষেপ।
অঞ্চলীয় নিরাপত্তা উপেক্ষা
এতে পারমাণবিক ও গণবিধ্বংসী অস্ত্রমুক্ত মধ্যপ্রাচ্য গঠনের প্রসঙ্গ বাদ দেওয়া হয়েছে। ইরান মনে করে, এটি টেকসই শান্তির অপরিহার্য উপাদান।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতার দৃষ্টিভঙ্গি
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা সাইয়্যেদ আলী খামেনি ২০১১ সালে ফিলিস্তিনি ইন্তিফাদা সম্মেলনে বলেছিলেন, “আমাদের দাবি সমগ্র ফিলিস্তিনের মুক্তি, শুধু একটি অংশ নয়। দ্বি-রাষ্ট্র পরিকল্পনা মানে ইহুদিবাদীদের দাবির কাছে আত্মসমর্পণ। এতে ফিলিস্তিনিদের অধিকার, বিশেষ করে শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনের অধিকার অস্বীকার হয়। ১৯৪৮-এর ভূমিতে বসবাসরত ফিলিস্তিনিদের অধিকার হুমকির মুখে পড়ে। এটি মুসলিম উম্মাহর দেহে ক্যান্সার টিউমারের মতোই থেকে যাবে। ”
তাঁর প্রস্তাবিত পরিকল্পনাটি চার দফা
১. শরণার্থীদের স্বদেশে প্রত্যাবর্তন
২. মুসলিম, খ্রিস্টান ও ইহুদিদের অংশগ্রহণে গণভোট
৩. সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্তে সরকার গঠন
৪. এই নির্বাচিত সরকার পরবর্তীতে অন্যান্য বাসিন্দাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে।
কূটনৈতিক কৌশল নাকি নীতিগত পরিবর্তন?
জাতিসংঘে ফিলিস্তিনের পক্ষে ইরান ভোট দেয়নি—এটি নিঃসন্দেহে আলোচিত ঘটনা। তবে এটি ইরানের নীতির পরিবর্তন নয়। বরং বলা যায়, ইরান তার কূটনৈতিক স্বার্থ, অর্থনৈতিক বাস্তবতা এবং আঞ্চলিক কৌশল বিবেচনা করে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফিলিস্তিন ইস্যুতে ইরানের সমর্থন কেবল ভোটে সীমাবদ্ধ নয়; বরং প্রতিরোধ আন্দোলনের প্রতি দীর্ঘমেয়াদি সহায়তায় প্রতিফলিত। সুতরাং, জাতিসংঘে ভোট না দেওয়াকে নীতিগত পরিবর্তন না ভেবে কূটনৈতিক কৌশল হিসেবে দেখা অধিক যুক্তিসঙ্গত।
ইরান বলেছে, যেকোনো সমাধান যদি অন্যায়, বৈষম্য, আপার্টহেইড এবং ফিলিস্তিনিদের মৌলিক অধিকার অস্বীকারের ওপর দাঁড়ায়, তবে তা টেকসই হবে না। বরং এটি সংকট ও অস্থিতিশীলতা বাড়াবে। এই কারণে ইরান ভোটে অংশ নেয়নি। ইরান জাতিসংঘকে বলেছে, ফিলিস্তিনি জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে স্বীকৃতি দিতে হবে, জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি বন্ধ করতে হবে এবং ফিলিস্তিন সমাজের প্রতিটি অংশকে সমানভাবে ভবিষ্যত নির্ধারণে অংশগ্রহণের সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।
এমজেএফ