ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

অর্থনীতি-ব্যবসা

অবাধে আমদানি হচ্ছে ভেজাল ও নিম্নমানের বিটুমিন

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৩৭ ঘণ্টা, মে ১৮, ২০২১
অবাধে আমদানি হচ্ছে ভেজাল ও নিম্নমানের বিটুমিন

ঢাকা: একরকম অবাধেই দেশে আমদানি করা হচ্ছে নিম্নমানের ও ভেজাল বিটুমিন। মিথ্যা কাস্টমস ঘোষণায় কোনোরকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই দেশের বাজারে ঢুকছে সড়ক অবকাঠামো নির্মাণে অতি গুরুত্বপূর্ণ এই উপাদান।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমদানি করা বিটুমিন বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট (বিএসটিআই), বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এবং ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের (ইআরএল) মান যাচাইকরণ পরীক্ষা পার করেই খালাস দেওয়া উচিত।

দেশে প্রতিবছর পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ লাখ টন বিটুমিনের প্রয়োজন হয়। তবে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ইআরএল স্থানীয়ভাবে ৬০ থেকে ৭০ হাজার টন বিটুমিন উৎপাদন করে, যা চাহিদার মাত্র ১৩ থেকে ১৫ শতাংশ। ফলে বাড়তি চাহিদার প্রায় পুরোটাই বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়।

এই খাতের আমদানি নির্ভরতার সুযোগ নিয়ে এক শ্রেণির আমদানিকারক ও ঠিকাদার সিন্ডিকেট মিলে দেশে আনছে ভেজাল ও নিম্নমানের বিটুমিন। বিটুমিন আমদানিতে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা এবং কাস্টমস থেকে বিটুমিন খালাসের পূর্বে এর গুণগত মান যাচাইকরণ পরীক্ষার ব্যবস্থা না থাকার পুরো সুবিধা নিচ্ছে এই সিন্ডিকেট। এক শ্রেণির অসাধু কাস্টমস কর্মকর্তাদের এমন সিন্ডিকেটের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগও রয়েছে।

বিটুমিন আমদানি করার বিভিন্ন ফাঁকফোকরের কথা জানাতে গিয়ে সম্প্রতি খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ সগীর আহমেদ সম্প্রতি বলেন, (বিটুমিন আমদানিতে) ডিউটি (কর) একই, ডিউটির মধ্যে কোনো ফারাক নাই। কিন্তু গুণগত মানে ফোকর আছে। সেখানে ৫০০ ডলারের (বিটুমিন) আছে, ২০০ ডলারের আছে, ২৫০ ডলারের আছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়কের স্থায়ীত্বের জন্য ৬০/৭০ গ্রেডের বিটুমিন ব্যবহার করতে হয়। ২০১৫ সালে উন্নতমানে এই গ্রেডের বিটুমিন ব্যবহারের নির্দেশনা দিয়ে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। কিন্তু অধিক লাভের আশায় মাঠ পর্যায়ে এই গ্রেড ব্যতীত অন্তত আরও চারটি নিম্ন গ্রেডের বিটুমিন সড়কে ব্যবহার করা হয়। এসব বিটুমিনে মেশানো হয় গিলনোসাইডের মতো রাসায়নিক ও মাটি।

সড়ক অবকাঠামো ও বিটুমিন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিম্নমানের এমন বিটুমিন আমদানি ও সড়কে ব্যবহার করার ফলে টিকছে না পাকা সড়ক। কোনো সড়কের মেয়াদকাল দুই থেকে তিন বছর হলেও বছর ঘুরতে না ঘুরতেই বেহাল দশা হয় কোটি কোটি টাকায় নির্মিত সড়কগুলো। নিম্নমানের হওয়ায় এসব বিটুমিনের ‘এলাস্টিসিটি’ বা পাথর ধরে রাখার স্থিতিস্থাপকতা কমে যাওয়ায় সামান্য বর্ষাতেই সড়কের পাথর আলগা হয়ে যায়।

বাংলাদেশের সড়কে বিটুমিনের নামে একধরনের আবর্জনা ব্যবহার করা হচ্ছে বলেই মনে করেন ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেনকোলজির (আইইউটি) সহযোগী অধ্যাপক ও বিটুমিন বিশেষজ্ঞ ড. নাজমুস সাকিব। তিনি বলেন, উৎপাদন থেকে আমদানি পর্যন্ত, অসাধু ব্যবসায়ীরা নানাভাবে আমদানি করা বিটুমিনের গুণগতমান নষ্ট করে। মুনাফার কৌশলে, বিক্রি হচ্ছে হাতে হাতে। আর প্রতিবারই মিশছে পরিত্যক্ত তেল, তেলজাতীয় ক্ষতিকর রাসায়নিক ও অন্যান্য ভেজাল। আর অনেক ক্ষেত্রে আমদানি করা বিটুমিনের উৎসও অজানা থাকে। আমরা মূলত আমাদের সড়কগুলোতে আবর্জনা ব্যবহার করছি।

যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, আমদানিকারকদের একটা প্রবণতা হচ্ছে যে, আন্তর্জাতিকভাবে যেসব দেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আছে তাদের কাছ থেকে সস্তায় নিম্নমানের বিটুমিন আমদানি করা। কেউ কেউ আবার ভালো মানের বিটুমিন আমদানি করলেও সেগুলো প্রয়োগের পূর্বে প্রতিবার হাত বদলের সময় ভেজাল মিশ্রিত হচ্ছে। বিটুমিন কোথায় কী ধরনের বৈজ্ঞানিক পরিবেশে ও তাপমাত্রায় রাখা হবে অথবা কী বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পরিবহণ করা হবে; সেসব নিয়মনীতিও মানার বালাই দেখা যায় না।

সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা যায়, বিটুমিনের তাপমাত্রা ধরে রাখতে জাহাজে তোলার সময় একবার উত্তপ্ত (হিট) করা হয়। জাহাজ থেকে নামানোর পর আরও একবার এবং ড্রামে ভরার সময় আবারও হিট দেওয়া হয়। তবে অবৈজ্ঞানিক উপায়ে এভাবে হিট দেওয়ার কারণে প্রতিবারই নষ্ট হয় বিটুমিনের গুণগত মান।

এছাড়াও বিটুমিন সংরক্ষণের ক্ষেত্রেও কোন যত্নের বালাই নেই। খরচ কমাতে ড্রামভর্তি বিটুমিন বন্দরে আনার পর যত্রতত্রভাবে শেডেই রেখে দেওয়া হয়, কখনও বা সরাসরি খোলা আকাশের নিচে। চট্টগ্রাম গুদাম মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আলী বলেন, আমদানিকারকরা সেকেন্ড পার্টির কাছে বিক্রি করে, সেকেন্ড পার্টির কাছ থেকে থার্ড পার্টির কাছে যেতে পারে। আর গো-ডাউনে রাখলে পার্টিদের কস্টিং (খরচ) কমে যায়। গো-ডাউনে থাকলে মাল থাকবে ভালো আর খোলা মাঠে থাকলে মনে করেন রোদের মধ্যে মাল গলে-ঢলে পড়ে যেতে পারে।

জানা যায়, বিটুমিনের মান কমে গেলে সেটি অনেকটা ধূসর রং ধারণ করে। তবে বিটুমিনকে কালো দেখানোর জন্য এতে মেশানো হয় গিলনোসাইড। আর বিটুমিনের ঘনত্ব দেখাতে মেশানো হয় মাটি। শুধু বিটুমিনে ভেজাল মেশানোর জন্যই দেশের বিভিন্ন স্থানে আট থেকে ১০টি কারখানা রয়েছে বলে তথ্য পাওয়া যায়।

যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে সঠিক মানের বিটুমিন নিশ্চিতে মাধ্যমে দেশিয় সম্পদ অপচয় রোধ করতে হলে চাই সুনির্দিষ্ট বিটুমিন আমদানি নীতিমালা। একই সাথে বন্দরে আসা বিটুমিনের হতে হবে যথাযথ বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা। শুধু বিএসটিআই, বুয়েট এবং ইআরএল মতো প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষায় উতরে যাওয়া বিটুমিনকেই খালাসের অনুমতি দিতে হবে। এমনটা করলে আমদানিকারকেরা নিম্নমানের বিটুমিন আমদানি থেকে সরে আসবেন বলেও মতামত তাদের।

বাংলাদেশ সময়: ১০৩২ ঘণ্টা, মে ১৮, ২০২১
এসএইচএস/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।