ঢাকা, শুক্রবার, ২৫ আশ্বিন ১৪৩২, ১০ অক্টোবর ২০২৫, ১৭ রবিউস সানি ১৪৪৭

অর্থনীতি-ব্যবসা

হাতবদলে সবজির দাম ৪ গুণ

নিউজ ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯:০৫, অক্টোবর ১০, ২০২৫
হাতবদলে সবজির দাম ৪ গুণ

কৃষক থেকে রাজধানীর খুচরা বাজারে পৌঁছতে পৌঁছতে সবজির দাম বেড়ে প্রায় চার গুণ হয়ে যাচ্ছে। ঘন ঘন হাতবদল, চাঁদাবাজি ও বাজার তদারকির দুর্বলতায় কৃষক থেকে দামের এই পার্থক্য তৈরি হচ্ছে।

এতে কৃষকরা ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না, ভোক্তাদেরও কিনতে হচ্ছে চড়া দামে। খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এ সমস্যা সমাধানে কৃষি বিপণনকে অনলাইন ও অফলাইন দুটিতেই শক্তিশালী করাসহ বাজারব্যবস্থাকে সুদৃঢ় করতে হবে।

দেশের অন্যতম বড় সবজির মোকাম বগুড়ার মহাস্থান বাজারে কৃষকরা বেগুন মানভেদে ২৭ থেকে ৪০ টাকা এবং শিম ৩৫ থেকে ৪০ টাকা কেজিতে বিক্রি করছেন। অথচ কৃষকদের কাছ থেকে স্বল্প দামে কেনা এসব সবজি ঢাকার খুচরা বাজারে চার থেকে পাঁচ গুণ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।

রাজধানীর বাজারে সবজির দাম এখন আকাশছোঁয়া। হাতেগোনা কয়েকটি সবজি ছাড়া বেশির ভাগ সবজির দাম কেজিপ্রতি শতের ঘরে।

সবজির অত্যধিক দামের কারণে ক্রেতারা তাদের আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের হিসাব মেলাতে পারছে না। ক্রেতারা বলেছে, কিছু দিন আগেও যে সবজি ছিল ৭০ থেকে ৮০ টাকা কেজি, এখন তা ১২০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে সাধারণ মানুষের কষ্ট আরো বাড়বে।

হাতবদলে সবজির দাম ৪ গুণবাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত বুধবার ও বৃহস্পতিবার রাজধানীর মহাখালী কাঁচাবাজার, বাড্ডা, রামপুরা ও জোয়ারসাহারা খুচরা বাজারে মানভেদে প্রতি কেজি বেগুন ১০০ থেকে ১৮০ টাকা দরে বিক্রি হয়।

অথচ এই দুই দিনে বগুড়ার মহাস্থান হাটে কৃষকরা পাইকারিতে প্রতি  কেজি বেগুন মানভেদে ২৭ থেকে ৪০ টাকায় বিক্রি করেন। পাবনার বাজারে বেগুন ৬০ থেকে ৭০ টাকা, মেহেরপুর বাজারে ৭০ টাকা ও নরসিংদীর বাজারে ৭০ থেকে ১০০ টাকা কেজি।
রাজধানীর বাজারে শীতের আগাম সবজি শিম প্রতি কেজি ১৬০ থেকে ২০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। যদিও মহাস্থান হাটে কৃষকরা পাইকারিতে শিম বিক্রি করছেন মানভেদে ৩৫ থেকে ৪০ টাকা কেজি করে। রাজধানীর খুচরা বাজারে প্রতি কেজি করলা ১০০ থেকে ১২০ টাকা।

এসব করলা বগুড়ার কৃষক পর্যায়ে প্রতি কেজি ৩২ থেকে ৩৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। নরসিংদী, পাবনা ও মেহেরপুরের পাইকারি বাজারে এসব করলা ৫০ থেকে ৬৫ টাকা।

রাজধানীতে খুচরায় বরবটি ১০০ থেকে ১২০ টাকা কেজি। বগুড়ার মহাস্থান হাটে কৃষকরা বরবটি ৩০ থেকে ৩২ টাকায় বিক্রি করছেন। নরসিংদী, পাবনা ও মেহেরপুরের বিভিন্ন পাইকারি বাজারে বরবটি ৫০ থেকে ৭৫ টাকা। রাজধানীর খুচরা বাজারে পটোল বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ টাকায়। বগুড়ার কৃষক পর্যায়ে পটোলের কেজি ২০ থেকে ২৫ টাকা। রাজধানীর খুচরা বাজারে প্রতি কেজি ঝিঙা ৯০ থেকে ১০০ টাকা। বগুড়ায় কৃষকরা পাইকারিতে প্রতি কেজি ঝিঙা ৩০ থেকে ৩৬ টাকায় বিক্রি করছেন।

রাজধানীতে ঢেঁড়সের কেজি ৮০ থেকে ১০০ টাকা। মহাস্থান হাটে কৃষকরা এটি ২০ থেকে ২৫ টাকায় বিক্রি করছেন। রাজধানীর বাজারে মিষ্টি কুমড়াও চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে। প্রতি কেজি মিষ্টিকুমড়া ৫৫ থেকে ৬০ টাকা। বগুড়ার কৃষক পর্যায়ে এটি প্রতি কেজি ১৭ থেকে ২০ টাকা। লম্বা লাউ রাজধানীর খুচরা বাজারে আকারভেদে প্রতি পিস ৭০ থেকে ৮০ টাকা। মহাস্থান হাটে প্রতি পিস লম্বা লাউ ১৫ থেকে ২৫ টাকা এবং পাবনা ও মেহেরপুরের বিভিন্ন বাজারে ৩০ থেকে ৪২ টাকা।

একাধিক হাতবদলে সবজির দাম বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে রাজধানীর কারওয়ান বাজারের সবজি বিক্রেতা মো. হাবিব বলেন, ‘কৃষকরা প্রথমে সবজি তাঁদের স্থানীয় বাজারগুলোতে নিয়ে আসেন। স্থানীয় বাজারগুলোতে ফড়িয়া বা পাইকারদের সিন্ডিকেট থাকে। তারা সবাই মিলে একটা দাম নির্ধারণ করে দেয়। সেই দামে কৃষকদের থেকে মণ হিসেবে তারা কিনে নেয়। পরে ট্রাক বা পিকআপে করে রাজধানীতে আসে সবজি। রাজধানীতেও কয়েক হাতবদল হয়ে খুচরা বিক্রেতাদের হাতে যায়। এভাবে কয়েকটি হাতবদলে মূলত সবজির দাম বাড়ে। ’ তিনি বলেন, ‘কৃষকদের সঙ্গে যদি সরাসরি রাজধানীর বিক্রেতাদের যোগাযোগ থাকত, তাহলে হাতবদল কমে পণ্যের দামও অনেক কমে যেত। এতে কৃষক ও ভোক্তা উভয়ই লাভবান হতো। ’

মহাস্থান হাটের সবজি বিক্রেতা বাঘোপাড়া এলাকার কৃষক শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘এ বছর টানা বৃষ্টির কারণে সবজির উৎপাদন কম হয়েছে। আমরা কৃষকরা পণ্যের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছি না। আমাদের খবর সরকারও রাখে না, কৃষি অফিসও রাখে না। এত টাকা খরচ করে সবজির উপযুক্ত দাম না পেলে আমাদের সংসার চলবে কিভাবে। ’

কৃষকদের ভাষ্য, মধ্যস্বত্বভোগী বা ব্যবসায়ীরা প্রতি কেজি সবজিতে ১৫ টাকা থেকে ২০ টাকা লাভ করেন। এ ছাড়া প্রতি পিস লম্বা লাউয়ে কমপক্ষে ১৫ থেকে ২৫ টাকা পর্যন্ত লাভ করে থকেন। খুচরা পর্যায়ে বাজার ও জায়গাভেদে এর প্রভাব দ্বিগুণ থেকে চার গুণ।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বগুড়ার উপ-পরিচালক কৃষিবিদ সোহেল মো. শামসুদ্দিন ফিরোজ জানান, প্রান্তিক কৃষকরা প্রায় সব সময় বঞ্চিত হচ্ছেন। উৎপাদন ও পরামর্শ প্রদানের লক্ষ্যে কৃষি অধিদপ্তর যেমন ‘কৃষক গ্রুপ’ করেছে, তেমনি কৃষকদের ন্যায্যমূল্য পাইয়ে দিতে ‘কৃষি বিপণন’কে  গ্রুপ করা প্রয়োজন। কৃষি বিপণনকে অনলাইন ও অফলাইন  দুটিতেই শক্তিশালী করাসহ বাজারব্যবস্থাকে সুদৃঢ় করতে হবে।

এ বিষয়ে ভোক্তার স্বার্থ সংরক্ষণে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ভলান্টারি কনজিউমারস ট্রেনিং অ্যান্ড অ্যাওয়ারনেস সোসাইটির (ভোক্তা) নির্বাহী পরিচালক মো. খলিলুর রহমান সজল বলেন, ‘কৃষকের উৎপাদিত পণ্য রাজধানীর মানুষ চড়া দামে কিনলেও সেই ফসলের ন্যায্যমূল্য তারা পাচ্ছে না। মাঝখানে ফুলেফেঁপে উঠছে অদৃশ্য এক অতি শক্তিশালী গোষ্ঠী, যারা বাজারে মধ্যস্বত্বভোগী হিসেবে পরিচিত। ’

তিনি বলেন, ‘ঢাকার বাজারে যে সবজি ৮০ থেকে ১০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে, একই সবজি কৃষককে তাঁদের স্থানীয় বাজারে ব্যাপারীদের কাছে বিক্রি করতে হচ্ছে মাত্র ২০ থেকে ২৫ টাকায়। এমন বৈষম্যের পরিসংখ্যান শুধু চোখে দেখা নয়, গবেষণাও প্রমাণ করেছে। সবজি ও শস্যের ক্ষেত্রে মধ্যস্বত্বভোগীদের লাভের হার ৫০ থেকে ৬৫ শতাংশ। অর্থাৎ কৃষক শ্রম ও খরচের মূল্যই পাচ্ছেন না। অথচ শহরের ভোক্তা অতিরিক্ত মূল্যে পণ্য কিনতে বাধ্য হচ্ছে। এই বৈষম্যের জন্য প্রথমেই দায়ী বাজারব্যবস্থার কাঠামোগত দুর্বলতা। কৃষক থেকে ভোক্তার হাতে পণ্য পৌঁছানোর চেইনটি দীর্ঘ ও জটিল। ’

খলিলুর রহমান সজল আরো বলেন, ‘আমাদের বর্তমান বাজারব্যবস্থার বাস্তবতায় কোনো পণ্য কৃষকের কাছ থেকে ব্যাপারী ও পাইকারি আড়তদার হয়ে খুচরা বিক্রেতার কাছে যায় এবং তা পরিশেষে ভোক্তার হাতে পৌঁছায়। বাজারের প্রতিটি ধাপে কৃষকের ন্যায্য প্রাপ্য কেটে নেওয়া হয়। ব্যাপারী বা পাইকারি আড়তদাররা কৃষক ও ভোক্তার মাঝে মধ্যস্বত্বভোগী হিসেবে উচ্চমূল্য ধার্য করে এবং কৃষকের পণ্য কম দামে ক্রয় করে শহরের বাজারে অতিরিক্ত দামে বিক্রি করে। কৃষকের আয় অর্ধেকেরও কম থাকে, আর মধ্যস্বত্বভোগীরা আড়াই থেকে তিন গুণ লাভের সুযোগ পায়। পরিবহন ও সংরক্ষণ অবকাঠামোর অভাবও কৃষকের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তিতে অন্তরায় হিসেবে কাজ করে। ’

কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম খান বলেন, ‘আমাদের বিপণনব্যবস্থায় প্রধান সমস্যা হচ্ছে একদিকে কৃষক তাঁর ন্যায্য দাম পান না, অন্যদিকে ভোক্তাদের অতিরিক্ত দাম দিয়ে ভোগ্য পণ্য কিনতে হয়। মূলত বর্তমান বাজারব্যবস্থার কারণে কৃষক ও ভোক্তা উভয়ই ঠকছে, লাভবান হচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীরা। এখন বাজারব্যবস্থাকে যদি কৃষকের অনুকূলে নেওয়া যায়, তাহলে কৃষক ও ভোক্তা উভয়ই লাভবান হবে। যেহেতু মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য থাকবে না, আমাদের কৃষকও ন্যায্য দাম পাবেন এবং ভোক্তারাও ন্যায্য দামে পণ্যসামগ্রী কিনতে পারবে। ’ 

[প্রতিবেদনে তথ্য দিয়েছেন কালের কণ্ঠের নিজস্ব প্রতিবেদক (বগুড়া), নরসিংদী, মেহেরপুর ও পাবনা প্রতিনিধি]

সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।