ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা। কাঙ্ক্ষিত আয় নেই।
বাড়ছে রাজস্ব ঘাটতি। এতে ক্রমেই কমছে কর-জিডিপি অনুপাত। অথচ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফ বসে আছে শর্তের খড়্গ নিয়ে। ঋণের শর্ত হিসেবে কর-জিডিপি অনুপাত বাড়ানোর বদলে বরং কমছে।
এমন পরস্থিতির মধ্যে সংস্থাটির কর্মকর্তারা বাংলাদেশ সফরে আসছেন। সামনে আসন্ন বৈঠকে তাদের জবাবদিহিতার মুখে পড়তে হবে এনবিআরকে। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, ব্যর্থতার কারণ চিহ্নিত না করে সামনের দিনে রাজস্ব আদায় বাড়ানোর কৌশল তুলে ধরাই গুরুত্বপূর্ণ। এনবিআর সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
তথ্য-উপাত্ত বলছে, ২০২০ সালে করোনাকালীন দেশের অর্থনীতির গতি ছিল স্থবির। তখন কর-জিডিপি অনুপাত ছিল ৭ শতাংশ। তবে ২০২৫ সালে এই অনুপাত দাঁড়িয়েছে ৬.৬ শতাংশে। এক বছর আগেও কর-জিডিপি অনুপাত ছিল ৭.৬ শতাংশ। এক দশক আগেও কর-জিডিপি অনুপাত দুই অঙ্কের ঘরে ওঠানামা করেছে; কিন্তু টেকসই হয়নি।
বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত নিয়ে বিগত সময়েও অসন্তোষ প্রকাশ করেছিল উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাটি। এ অবস্থায় আইএমএফকে সন্তুষ্ট করতে প্রস্তুতি নিচ্ছে এনবিআর।
বাংলাদেশকে অনুমোদন করা ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের ষষ্ঠ কিস্তি ছাড়ের আগে এ অক্টোবরে ঢাকা সফরে আসবে আইএমএফের পরবর্তী মিশন। তারিখ ঘোষণা না হলেও এই মিশন সামনে রেখে সংস্থাটির শর্ত পূরণের কর্মপরিকল্পনা চূড়ান্ত করতে এনবিআর কর্মকর্তারা তাদের কৌশল সাজাচ্ছেন। প্রতিদিনই নীতি নির্ধারণে লম্বা সময় ধরে বৈঠক করছেন কর্মকর্তারা।
এনবিআর সূত্র জানায়, আইএমএফের শর্ত মেনেই চলতি অর্থবছরের বাজেটে বেশি শুল্ক-কর বসানো হয়েছে। এতে কর-জিডিপি অনুপাত ০.৫০ শতাংশ বাড়বে। এখন ঋণের শর্তের আলোকে আয়কর, শুল্ক ও ভ্যাট খাতে কিভাবে বিশাল অঙ্কের রাজস্ব আদায় করা হবে, তার রোডম্যাপ তৈরি করা হচ্ছে।
তথ্য বলছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তিন লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করেছিল এনবিআর। চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরে সংস্থাটিকে চার লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। তবে চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসেও আয়ে ছয় হাজার ৫৭৭ কোটি টাকা পিছিয়ে আছে এনবিআর।
এনবিআরের সদস্য (করনীতি) ব্যারিস্টার মুতাসিম বিল্লাহ ফারুকী বলেন, ‘আইএমএফের সঙ্গে আমরা কোনো চুক্তি করিনি। কর-জিডিপি অনুপাত বাড়াতে তাদের কিছু পরামর্শ আছে, সেগুলো যাচাই করে যেটা বাস্তবসম্মত সেটা গ্রহণ করব। সুনির্দিষ্টভাবে এখনো কিছু করা হয়নি। তাদের অনেক পরামর্শের সঙ্গে আমরা একমত। এখনো অনেক কিছু চিন্তা-ভাবনা করা দরকার। শিল্পকে এগিয়ে নিতে আমরা করনীতি প্রণয়ন করি। সে জায়গাটা আমরা পরিষ্কার করতে চাই। ’
তবে আইএমএফ মিশনের সামনে আগামীর কি রূপরেখা তুলে ধরবে এনবিআর—জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংস্থাটির একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ‘গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতির গতি ফিরে আসেনি। অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে বিনিয়োগ করতে উৎসাহ দেখাচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা। রাজস্ব আদায় বাড়াতে একটা নির্বাচিত ও স্থিতিশীল সরকার প্রয়োজন। আইএমএফ বিষয়টা বোঝে। ’
তিনি আরো বলেন, ‘আয়কর, কাস্টমস ও ভ্যাট অনুবিভাগে ব্যবসা সহজীকরণ, আদায় ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স, বকেয়া আদায়, মামলা জট কমানো, করদাতাদের ভোগান্তি হ্রাস, দ্রুত সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আইএমএফের পরামর্শে এনবিআর ভেঙে দুটি বিভাগ প্রতিষ্ঠার কাজও করেছে সরকার। আইএমএফ যা চেয়েছিল, তা আমরা পুরোপুরি করতে পারিনি। এ বিষয়ে তাদের বুঝিয়ে সন্তুষ্ট করতে হবে। ’
জানা গেছে, ২০২৬ সাল পর্যন্ত মোট সাত কিস্তিতে অনুমোদিত আইএমএফের ঋণ ছাড়ে এনবিআর, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন দপ্তরের জন্য শর্ত রয়েছে ৩৮টি। এসব শর্ত ও সংস্কার প্রস্তাবের একটি দৃশ্যমান অগ্রগতি না হলে ঋণ ছাড় পিছিয়ে যেতে পারে। তাই ষষ্ঠ কিস্তির আগে শর্ত মানার ব্যাপারে সংশ্লিষ্টরা প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (র্যাপিড) চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘আইএমএফ জানে কোন প্রেক্ষাপটে আমাদের কর-জিডিপি অনুপাত কমেছে। পটপরিবর্তন-পরবর্তী সময়ে যথেষ্ট রাজস্ব আদায় করা সম্ভব হয়নি। এখন এনবিআর যদি রাজস্ব আদায় করতে না পারার কারণ ব্যাখ্যা করে তাহলে হবে না। সামনের দিনে কী করবে তা তুলে ধরতে হবে। রাজস্ব আদায় বাড়াতে প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি কৌশল। এনবিআরও একা মধ্যমেয়াদি কৌশল প্রণয়ন করেছে। সেটাকে খতিয়ে দেখতে হবে, এভাবে এগিয়ে গেলে লক্ষ্য অর্জন করা যাবে কি না। ’
সূত্র: কালের কণ্ঠ