ঢাকা, শনিবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

হালদা হয়ে উঠেছে ডলফিনের অনিরাপদ আবাসস্থল

মিনহাজুল ইসলাম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৩৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৩, ২০২১
হালদা হয়ে উঠেছে ডলফিনের অনিরাপদ আবাসস্থল ছবি: বাংলানিউজ

চট্টগ্রাম: প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র হালদা নদী থেকে গত ৫ দিনের ব্যবধানে ২টি মৃত ডলফিল উদ্ধার করা হয়েছে। এ নিয়ে গত ৪ বছরে কেবল হালদা থেকেই মৃত ডলফিন উদ্ধারের ঘটনা ঘটেছে ৩১টি।

বারবার এমন ঘটনায় মনে করা হচ্ছে, ডলফিনের জন্য অনিরাপদ আবাসস্থল হয়ে উঠেছে হালদা।

হালদা গবেষকরা বলছেন, অবৈধ মাছ শিকারীদের জাল ডলফিনের মৃত্যু বাড়ার কারণ।

এ অবস্থা চলতে থাকলে ডলফিনশূন্য হবে হালদা।

২০১৮ সালের নভেম্বর থেকে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ইউএনডিপির সহযোগিতায় গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট ফ্যাসিলিটি ও বনবিভাগের পরিচালিত এক জরিপের তথ্যানুযায়ী, হালদায় ৪৫টি ডলফিনের অস্তিত্ব পাওয়া পাওয়া যায়। হালদা নদীর মোহনা থেকে সাত্তার ঘাট পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার এলাকাকে ডলফিনের হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।  

জরিপের সুপারিশে, জরুরি উদ্যোগের মাধ্যমে ডলফিনের সংখ্যা দীর্ঘমেয়াদে সংরক্ষণ করা যাবে উল্লেখ করা হলেও, দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ না নেওয়ার ফলে সেই ৪৫টি ডলফিনের মধ্য থেকে মৃত্যু হয়েছে ২৪টির।  

এভাবে ডলফিনের মৃত্যু হতে থাকলে আগামী ২০২২ সালের মধ্যে হালদা ডলফিনশূন্য হওয়া শঙ্কা প্রকাশ করছেন গবেষকরা।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হালদা রিসার্চ কেন্দ্রের তথ্যমতে, হালদা নদীতে ২০১৮ সালের এক জরিপে ১৬৭টি গাঙ্গেয় ডলফিনের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। দুই বছর পর ২০২০ সালে আরও একটি জরিপ চালিয়ে প্রায় ১২৭টি ডলফিনের অস্তিত্ব পায় এই গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি। অর্থাৎ ২ বছরের ব্যবধানে ৪০টি ডলফিনের হদিস পায়নি প্রতিষ্ঠানটি।

তথ্যমতে, ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২১ সালের ১২ অক্টোবর পর্যন্ত হালদা নদী থেকে ৩১টি মৃত ডলফিন উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়া কর্ণফুলী নদী থেকে গত দুই মাসের মধ্যে ২টি মৃত ডলফিন উদ্ধার করা হয়েছে। সব মিলিয়ে গত চার বছরে চট্টগ্রামের এই দুই নদী থেকে ৩৩টি ডলফিন মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) তাদের লাল তালিকায় গাঙ্গেয় ডলফিনকে বিপন্ন হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ২০১২ সালের বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনের তফসিল-১ অনুসারে এই প্রজাতিটি সংরক্ষিত। গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-পদ্মা-মেঘনা-হালদা-কর্ণফুলী নদীতে এই বিপন্ন গাঙ্গেয় ডলফিনের বিচরণ ক্ষেত্র।

এদিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হালদা রিচার্সের ডলফিনের মৃত্যুর পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের ৪ অক্টোবর পর্যন্ত হালদা নদীতেই ডলফিন মারা গেছে ৩১টি। যার মধ্যে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি ২০১৮ পর্যন্ত হালদায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাজ চলার সময়ে ডলফিন মারা যায় ১৮টি। এর পর থেকে চলতি মাস পর্যন্ত ডলফিন মারা গেছে ১৩টি। মূলত গত তিন বছরে হালদা নদীতে বালুমহল ইজারা, ড্রেজার চালিত নৌযান চলাচল বন্ধ, পাওয়ার প্লান্ট থাকার কারণে ডলফিনের মৃত্যু কম হয়েছে। তবে মারা যাওয়া ৩১টি ডলফিনের মধ্যে একটি ডলফিন কেবল চর্বি সংগ্রহের জন্য হত্যা করা হয়েছে। বাকিগুলো নদীর বাস্তুসংস্থান সংকটের কারণে মারা গেছে বলে জানায় প্রতিষ্ঠানটি।

এদিকে, গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট ফ্যাসিলিটি ও বনবিভাগের পরিচালিত জরিপে ডলফিনের মৃত্যুর পেছনে তিনটি কারণ চিহ্নিত করা হয়। মাছ ধরার জাল, শিল্পকারখানার দূষণ ও যান্ত্রিক নৌযান। এসব বন্ধে বনবিভাগ ও মৎস্য অধিদফতরের সমন্বয়ে যৌথ টহলের ব্যবস্থার সুপারিশ করা হয়। তা আজও বাস্তবায়ন করা যায়নি। মার্চে হালদা নদীকে বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ ঘোষণার প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে।  

হালদা নদী নিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্প্রতি পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন প্রাণীবিদ্যা বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী ও চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজের জীব বিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড. মো. সফিকুল ইসলাম।  

তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ডলফিন পানিতে বসবাসকারী স্তন্যপায়ী প্রাণী। মানুষের মতোই ডলফিন ফুসফুসের সাহায্যে শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়, বাচ্চা জন্ম দেয় এবং নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বাচ্চা দুধ পান করে। বাংলাদেশে সাত প্রজাতির ডলফিন পাওয়া যায় (IUCN-Bangladesh-2015)। যার মধ্যে গাঙ্গেয় ডলফিন (Platanista gangetica) মিঠাপানির নদীর প্রধান ডলফিন। এটি বর্তমানে বিপন্ন প্রজাতির প্রাণী। পদ্মা- ব্রহ্মপুত্র- মেঘনা এবং সাঙ্গু- কর্ণফুলী-হালদা ও অন্যান্য কিছু নদীতে পাওয়া যায়। সম্প্রতি হালদা নদীর পাঁচটি পয়েন্ট (নাজিরহাট থেকে মদুনাঘাট পর্যন্ত) থেকে পানি সংগ্রহ করে নিজস্ব ল্যাবে পরীক্ষা করে ১১টি প্যারামিটারে পানির গুণগতমান আদর্শ মানের মধ্যে পেয়েছি যা মাছ, ডলফিন এবং অন্যান্য জলজ প্রাণী বসবাসের উপযোগী। এছাড়া হালদা নদী থেকে সর্বশেষ প্রাপ্ত মৃত ডলফিনের গায়ে কোনো আঘাতের চিহ্ন ছিল না। হালদা নদীতে ডলফিন মৃত্যুর অন্যতম কারণ হচ্ছে অবৈধভাবে মাছ ধরার জন্য ব্যবহৃত জাল বিশেষ করে কারেন্ট জালে আটকা পড়ে ডলফিনের মৃত্যু হচ্ছে। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন ও অন্যান্য কিছু কারণ সম্পৃক্ত।  

তিনি আরও বলেন, ডলফিনের জন্য বাসযোগ্য করতে হলে হালদা নদীতে অবৈধ ভাবে যে কোনো ধরনের জাল দিয়ে মাছ ধরা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করতে হবে। নদীতে অতিরিক্ত ইঞ্জিন চালিত নৌযান চলাচল বন্ধ করতে হবে। হালদা ও শাখা খালে বিষ দিয়ে মাছ মারা বন্ধ করতে হবে। হালদা নদী ও এর শাখা খালগুলোকে দূষণমুক্ত রাখতে হবে। ডলফিন শুমারি করে ডলফিন ডাটাবেজ তৈরি করতে হবে। ডলফিন সংরক্ষণে আলাদা বিশেষজ্ঞ মনিটরিং টিম গঠন করতে হবে। কমিউনিটি বেইজড ডলফিন ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রাম গ্রহণ করতে হবে যেখানে বনবিভাগের পাশাপাশি স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করতে হবে। ডলফিনের পরিবেশগত গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে স্থানীয় জেলে ও জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। নদীতে যে কোন প্লাস্টিক সামগ্রী ফেলা বন্ধ করতে হবে এবং সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১১৩৮ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৩, ২০২১
এমআই/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।