ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

ঋণ প্রদানের অনিয়মে মুখ থুবড়ে পড়েছে ব্যাংকিং সেক্টর

মো. মহিউদ্দিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫০২ ঘণ্টা, মার্চ ২৯, ২০১৭
ঋণ প্রদানের অনিয়মে মুখ থুবড়ে পড়েছে ব্যাংকিং সেক্টর বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী রশিদ আহমদ চৌধুরী

চট্টগ্রাম: ঋণ প্রদানে অনিয়মের কারণেই ব্যাংক সেক্টর মুখ থুবড়ে পড়েছে মন্তব্য করে ঋণ খেলাপিদের শৃঙ্খলায় আনতে জরুরি ভিত্তিতে কঠোর আইন প্রণয়ন প্রয়োজন বলে মনে করছেন বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী রশিদ আহমদ চৌধুরী।

তিনি বলেন, সরকার ব্যাংক সেক্টরকে শৃঙ্খলায় আনার চেষ্টা করছে। কিন্তু বিদ্যমান আইনে তা সম্ভব হবে না।

কারণ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিলে খেলাপিরা উচ্চ আদালতে গিয়ে স্থগিতাদেশ নিয়ে আসছে। ফলে ব্যাংকের টাকা না দিয়ে সহজে পার পেয়ে যান।

ঋণ খেলাপিরা ব্যাংকের টাকা দেওয়ার বিষয়ে কোন চাপ মনে করে না। আমি মনে করি অর্থ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত কমিটির এমন কিছু আইন করা প্রয়োজন যা কঠোর হবে এবং ব্যাংকের টাকা উদ্ধার সহজ হবে।

পেশায় শিক্ষক প্রকৌশলী রশিদ আহমদ চৌধুরী মুখোমুখি হয়েছেন বাংলানিউজের। এসময় তিনি ব্যাংকিং খাতের বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেন। বর্তমানে এ খাতের সমস্যা-সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলার পাশাপাশি কমার্স ব্যাংকের বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তুলে ধরেন।

খেলাপি ঋণ নিয়ে অন্যান্য ব্যাংকের মতো কমার্স ব্যাংকেরও একই অবস্থা জানিয়ে তিনি বলেন, আগে ব্যাংকটি বিশৃঙ্খল অবস্থায় ছিল। এখন অনেকটা শৃঙ্খলায় আনতে সক্ষম হয়েছি। আশা করছি সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় নিয়ে আসতে পারবো।

এসএমই খাতকে উৎসাহিত করতে সহজ শর্তে ঋণ দিচ্ছেন জানিয়ে তিনি বলেন, একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পে ঋণ দিচ্ছি। এছাড়া ৪ লাখ পর্যন্ত ক্ষুদ্র ঋণও দেওয়া হচ্ছে। ব্যক্তিগতি ঋণও দেওয়া হচ্ছে।

এসএমই খাতে নারী উদ্যোক্তারা সহজে ঋণ পায় না এমন অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, সহজে পায় না বলতে দীর্ঘদিন ধরে অনিয়ম চলে এসেছে। ফলে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এখনো সমস্যা থাকতে পারে। তাই সিদ্ধান্ত নিতে সমস্যা হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে আমরা আরও সহজ করবো।

এ খাতে বিভিন্ন অনিয়মের কথা বলতে গিয়ে চিটাগং ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি (সিআইইউ)’র ব্যবস্থাপনা ও ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) বিভাগের চেয়াম্যান বলেন, কাজ করতে গিয়ে দেখছি আগে যেসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে তা পরিপক্ক ছিল না। ফলে গুছিয়ে আনতে একটু সময় লাগছে। তবে পর্যায়ক্রমে আমরা অনেক সহজ করবো।

ব্যক্তিগত ঋণ ৪ লাখ টাকার বেশি দেওয়া এখনি সম্ভব নয় জানিয়ে তিনি বলেন, মানুষের চাহিদা আছে তবে আমরা চেষ্টা করবো বাড়ানোর জন্য।

বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে যে হারে ব্যাংক বাড়ছে সে তুলনায় টাকা ইউটিলাইজ হচ্ছে কিনা বা এসব ব্যাংক টিকে থাকতে পারবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, নিঃসন্দেহে বলা যায় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক তৎপরতা বাড়ছে। না হলে এতগুলো ব্যাংক কিভাবে সারভাইভ করছে।

তিনি বলেন, দেশে যদি অর্থনৈতিক তৎপরতা স্তিমিত হয়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয় তাহলে আমার ধারণা তখন মার্জার অ্যান্ড ইক্যুজেশনের মাধ্যমে সমন্বয় করা হবে।  

এক সময় চট্টগ্রাম ব্যবসা বাণিজ্যে তৎপর ছিল, লেনদেন হতো প্রচুর, বর্তমানে অনেক ব্যাংকের শাখা লোকসানে রয়েছে- এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে কমার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যান বলেন, বাংলাদেশের ব্যাংকের বিধিবদ্ধ নিয়মের কারণে আগের মতো এখন আর সহজে ঋণ দিতে পারছে না।

ব্যাংক গ্যারান্টি দেওয়ার ক্ষেত্রেও অনিয়ম ছিল। কারণ গ্যারান্টি নেওয়ার সময় এমনভাবে নিয়েছে যে এখন ইউটিলাইজ করতে পারছে না। ঋণ খেলাপির কারণে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ঋণ দেওয়ায় অনেক রকমের অনিয়ম ছিল বলেই মুখ থুবড়ে পড়েছে ব্যাংকিং সেক্টর।

‘ব্যাংকের কাজ হলো টাকা নেওয়া এবং দেওয়া। মাঝখানে ব্যাংক ব্যবসা করে। ঋণ দিতে না পারাও একটা সমস্যা, ড্র ব্যাংক। বিধিবদ্ধ নিয়মের কারণে এখন কঠিন হয়ে গেছে। ’

খেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যাংক মামলা করলেও টাকা উদ্ধারের সম্ভাবনা ক্ষীণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, মামলা করলে খেলাপিরা আদালত থেকে স্টে অর্ডার নিয়ে আসে। আর এটাই ব্যাংকগুলোকে স্থবির করে রেখেছে।

‘প্রক্রিয়া করে বিচারের আওতায় এনে খেলাপিদের কাছ থেকে টাকা উদ্ধার, সিকিউরিটি এনকেস করে বিচার ব্যবস্থাকে যতই ত্বরান্বিত করা যাবে ততই খেলাপি ঋণ উদ্ধার সহজ হবে। আমার মনে হয় অর্থনৈতিক তৎপরতা আবার বাড়বে। প্রকৃত ব্যবসায়ীদের ঋণের অভাব হবে না। ’

ব্যাংক গ্যারান্টি হিসেবে জায়গা-জমি দেওয়া হলেও অনেকাংশে জমির দাম কমেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ১ কোটি টাকার জমি এখন ৫০ লাখ টাকা হয়েছে। আবার বিক্রিও হচ্ছে না। অন্যদিকে একই দলিল দিয়ে একাধিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে। ফলে ব্যাংকগুলো টাকা উদ্ধার করতে পারছে না। জালিয়াতির বিষয়গুলো বিচারের আওতায় আনা গেলে ব্যাংক শৃঙ্খলায় ফিরে আসবে।

চট্টগ্রামে প্রধান কার্যালয় থাকা উচিত:

বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে চট্টগ্রামে অন্তত কয়েকটি ব্যাংকের হেড অফিস থাকা উচিত বলে মনে করেন বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক লিমিটেড’র চেয়ারম্যান প্রকৌশলী রশিদ আহমদ চৌধুরী।

তিনি বলেন, এখানে প্রধান কার্যালয় থাকলে ত্বরি‍ৎ সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। মানুষ দ্রুত সমাধান পাবে। তাহলে ব্যবসার গতিও বাড়বে।  

প্রকৃত ব্যবসায়ীদের জন্য কমার্স ব্যাংকের দুয়ার খোলা জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা তাদের পেট্রোনাইজ করতে চাই।

চট্টগ্রামের চেয়ারম্যান হিসেবে এখানকার ব্যাংকের উন্নয়নে তার ভূমিকা সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন, আমি অবশ্যই চট্টগ্রামের দিকে নজর দেব। এখানে কমার্স ব্যাংকের ৬টি শাখা আছে। নতুন আরও ১০টি শাখা চালুর অনুমতি চেয়েছি। এখান থেকে চট্টগ্রামে কয়েকটি শাখা চালু করে তৎপরতা বাড়ানোর চেষ্টা করবো।

কমার্স ব্যাংকের চট্টগ্রামের বেশ কিছু শাখা লাভজনক অবস্থায় আছে জানিয়ে তিনি বলেন, সংস্কারের কারণে অবস্থার উন্নয়ন হয়েছে। এজন্য কর্মকর্তাদের উৎসাহিত করা হয়েছে, ইনসেনটিভ দেওয়া হয়েছে, প্রমোশন দেওয়া হয়েছে। ফলে তারাও ব্যবসা বাড়াচ্ছে।

কমার্স ব্যাংকে বর্তমান অবস্থা থেকে উন্নতির দিকে নিয়ে যেতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রতি সপ্তাহে মিটিং করছি। আমাদের সমস্যা ও সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি। এক্ষেত্রে সবার সহযোগিতা পাচ্ছি। আশা করি কমার্স ব্যাংক ঘুরে দাঁড়াবে।

রশিদ আহমদ চৌধুরী:

প্রায় দুই দশক পাঠানটুলি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং পৌরসভার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছিলেন কলকাতা সেন্ট জেবিয়ার্স কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করা সালেহ আহমদ চৌধুরী। নগরীর আগ্রাবাদকে বাণিজ্যিক এলাকায় রূপান্তর করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি।

পারিবারিক জায়গায় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা গড়ে তুলতে উদ্যোগী হয়ে সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনায় হাত দিয়েছিলেন। সরকারি কার্যভবন, জাতিতাত্ত্বিক যাদুঘরসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা তাদের পারিবারিক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। সেই সালেহ আহমদ চৌধুরীর সন্তান প্রকৌশলী রশিদ আহমদ চৌধুরী।

২০০১ সালে ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটিতে যোগ দিয়ে বর্তমানে ব্যবস্থাপনা ও ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) বিভাগের চেয়াম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ১৯৯২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্যান ডিয়েগোস্থ ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে এমবিএ এবং ১৯৮৯ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ম্যানুফ্যাকচারিং প্রকৌশলে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।

১৯৮২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কলেজ অব ইস্টার্ন উথাহ থেকে মাইনিং প্রযু্িক্ত ও ফলিত বিজ্ঞান শাস্ত্রে এসোসিয়েট ডিগ্রি অর্জনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন কর্পোরেট হাউসে কাজ করেছেন। প্রায় ১৬ বছর অধ্যাপনা পেশায় নিয়োজিত প্রকৌশলী চৌধুরীর দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সাময়িকীতে ব্যবস্থাপনা, বিপণন, স্টক মার্কেট বিষয়ে প্রায় ১৫টি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।

ঘুরে দাঁড়াবে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক

বাংলাদেশ সময়: ১১০২ ঘণ্টা, মার্চ ২৯, ২০১৭

এমইউ/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।