ঢাকা, সোমবার, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

শিক্ষক থেকে নিপীড়ক, মৃত্যুতে খেসারত

রমেন দাশগুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪৫৬ ঘণ্টা, মার্চ ২৯, ২০১৭
শিক্ষক থেকে নিপীড়ক, মৃত্যুতে খেসারত  চবি ছাত্র আলাউদ্দিন আলাওল

চট্টগ্রাম: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আলাউদ্দিন ছিলেন প্রতিবেশি ইয়াসমিন আক্তার রুম্পার গৃহশিক্ষক।  পড়াতে গিয়ে একসময় রূম্পার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন আলাউদ্দিন।  রুম্পার বিয়ে হয়ে যায়।  আর আলাউদ্দিনের সঙ্গে সেই সম্পর্ক একসময় রুম্পার কাছে তিক্ততায় পরিণত হয়।  শিক্ষক, ভালবাসার মানুষ আলাউদ্দিন এসময় রুম্পার কাছে ধরা দেয় চরম নিপীড়ক হয়ে। 

ব্ল্যাকমেইলিংয়ের শিকার হতে হতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে রুম্পা।   আর আলাউদ্দিনকে জীবন দিয়ে নিপীড়নের খেসারত দিতে হয় রুম্পার স্বামীর কাছে।

 

টানা ছয়দিন অনুসন্ধান চালিয়ে নগরীর বায়েজিদ বোস্তামি থানার ওসি মোহাম্মদ মহসিনের নেতৃত্বে একদল পুলিশ আলাউদ্দিন হত্যার নেপথ্যের লৌমহর্ষক কাহিনী তুলে আনতে সক্ষম হয়েছেন।   গ্রেফতার করেছেন রুম্পা ও তার স্বামী ইকবালসহ চারজনকে।

আলাউদ্দিন আলাওল (২৪) চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র। ২২ মার্চ রাতে বায়েজিদের শহীদনগর এলাকায় একটি বাসার বাথরুম থেকে আলাউদ্দিনের হাত-পা বাঁধা মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।

আলাউদ্দিন হত্যার রহস্য উন্মোচনের জন্য চবি ক্যাম্পাসে মানববন্ধন-মিছিল হয়েছে।  

পড়াতে গিয়ে সম্পর্ক

রুম্পা হাটহাজারী থানার ১১ নম্বর ফতেপুর ইউনিয়নের সিএনজি অটোরিকশা চালক মো.হারুনের মেয়ে।   ২০০৭ সালে রূম্পা ছিল অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী।   আর ওই বছর আলাউদ্দিন রুম্পাকে পড়ানো শুরু করেন, তিনি তখন এইচএসসির ছাত্র।     

রুম্পা পুলিশকে জানায়, আলাউদ্দিনকে ‍রুম্পার বাবা গৃহশিক্ষক হিসেবে নিয়ে আসেন।   একই এলাকায় বাড়ি হলেও আলাউদ্দিনকে আগে থেকে চিনতেন না রুম্পা।   পরবর্তীতে তাদের মধ্যে সম্পর্ক হয়।   এক পর্যায়ে সেই সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠতায় রূপ নেয়।  

বায়েজিদ বোস্তামি থানার ওসি মোহাম্মদ মহসিন বাংলানিউজকে বলেন, ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের সূত্র ধরে আলাউদ্দিন তার মোবাইলে রুম্প‍ার কিছু ছবি নেয় এবং ভিডিও করে সংরক্ষণ করে।   রুম্পার ভাষ্য অনুযায়ী, বিয়ের পর তাকে সেই ছবি এবং ভিডিও দিয়েই ব্ল্যাকমেইলিং শুরু করে।  

চার বোন, দুই ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় রুম্পাকে এসএসসি পরীক্ষা দেয়ার আগেই বিয়ে দেয় তার বাবা।   বর রাঙ্গুনিয়ার রাণীরহাটের ওমর সাদেক চৌধুরী।

প্রথম সংসারে ‘আলাউদ্দিন ঝড়’

রুম্পা পুলিশকে জানায়, ওমর সাদেকের দ্বিতীয় স্ত্রী ছিলেন রুম্পা।   তার বাবাকে বড় অংকের টাকা দিয়ে বিয়ে করেছিল ওমর।   শুরু থেকেই ওমরকে মেনে নিতে পারেনি রুম্পা।  তার অসুস্থ শ্বাশুড়িকে বছরে দুই-তিনবার ভারতে চিকিৎসার জন্য যেতে হত।   এসময় সংসারে অশান্তির কথা চিন্তা করে রুম্পাকে বাবার বাড়িতে রেখে যাওয়া হত।  

ওসি মোহাম্মদ মহসিন বাংলানিউজকে বলেন, স্বামী ওমর সাদেক তার বাড়িতে রুম্পাকে মোবাইল ব্যবহার করতে দিত না।   সম্ভবত শুরু থেকেই একটা সন্দেহ ছিল।   বাবার বাড়িতে এলে রুম্পা মোবাইল ব্যবহার করার সুযোগ পেত।   তখন আবার আলাউদ্দিনের সঙ্গে তার যোগাযোগ স্থাপন হয় এবং ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে জড়ান।   

এক পর্যায়ে বিষয়টি ওমর সাদেক জানতে পারেন।   তিনি রুম্পার কাছ থেকে ‘আর কখনও আলাউদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করবে না’ মর্মে স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নেন।   শ্বাশুড়িও জেনে যান বিষয়টি।   তবে তারা রুম্পার মা-বাবাকে বিষয়টি জানাননি।   এই নিয়ে দাম্পত্য ঝগড়া এবং বিভিন্ন ঘটনা পরিক্রমায় ২০১৫ সালের ১৯ ডিসেম্বর প্রথম সংসার ছেড়ে বাবার বাড়িতে চলে যায় রুম্পা।   এর মধ্যেই ২০১৩ সালের ১০ মে রুম্পার কোলজুড়ে আসে এক মেয়ে।

২০১৬ সালের  ২৫ জুলাই ইকবাল হোসেনের সঙ্গে দ্বিতীয় বিয়ে হয় রুম্পার।   ওইদিনই ওমর সাদেকের সঙ্গে তার তালাক হয়।  

পুলিশকে দেয়া রুম্পার ভাষ্য অনুযায়ী, প্রথম সংসার ছেড়ে চলে আসার পর থেকে দ্বিতীয় বিয়ে পর্যন্ত আলাউদ্দিন তাকে যোগাযোগ ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখতে বাধ্য করেন।   এসময় আলাউদ্দিন ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ এবং বিল্ডিং থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যার ভয় দেখাত রুম্পাকে। রুম্পা ও তার স্বামী ইকবালসহ গ্রেফতার চারজন

দ্বিতীয় সংসারেও ‘আলাউদ্দিন ঝড়’

ইকবালকে বিয়ের আগেই রুম্পার বাবা বিষয়টি জেনে যান।   এই নিয়ে তিনি রুম্পাকে মারধর করেন।   তবে বিয়ের পর সাময়িকভাবে আলাউদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়।   বিয়ের দুই মাস ছয়দিন পর ওমানে চলে যান ইকবাল।   যাবার আগে রুম্পার এলাকার লোকজনের কাছ থেকে ইকবাল রুম্পা ও আলাউদ্দিনের সম্পর্কের বিষয়টি জেনে যান।   পুলিশ সূত্রমতে, রুম্পার ধারণা আলাউদ্দিনই ইকবালকে কৌশলে বিষয়টি জানিয়ে দেয়।  

ওমান থেকে ইকবাল কয়েক দফা আলাউদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করে তার স্ত্রীকে বিরক্ত না করার অনুরোধ করেন।   ২০১৬ সালের ২২ ডিসেম্বর রুম্পার বাবা মারা যান।   তখন রুম্পা তাদের বাড়িতে গেলে আবারও আলাউদ্দিন তার সঙ্গে যোগাযোগ করে।   ২৮ ডিসেম্বর ইকবাল দেশে ফেরেন।  

বায়েজিদ বোস্তামি থানার ওসি মোহাম্মদ মহসিন বাংলানিউজকে বলেন, রুম্পা তার আব্বার সিমটি নিয়ে যায়।   সেখানে হোয়াটস অ্যাপ এবং ইমোতে নিজের অ্যাকাউন্ট খোলে।   তখন আলাউদ্দিনের সঙ্গে আবারও যোগাযোগ নিয়মিত হয়।   এখানে রুম্পারও সমস্যা থাকতে পারে।   কারণ রুম্পা আমাদের বলেছে, আলাউদ্দিনের কন্ঠস্বর শুনলে সে দুর্বল হয়ে পড়ত।   এককভাবে আলাউদ্দিন দোষী ছিল কি না, সেটা এখনও বলা যাবে না।   তবে তার অপরাধই বেশি দেখা যাচ্ছে।

সূত্রমতে, রুম্পার বক্তব্য অনুযায়ী দেশে ফেরার পর ইকবাল রুম্পার ভাই ফারুক এবং মাকে বিষয়টি নিয়ে জিজ্ঞেস করেন।   তারা আলাউদ্দিনের সঙ্গে তার সম্পর্কের বিষয়টি স্বীকার করে নেন।   এরপর বাসায় ফিরে ইকবাল রুম্পাকে মারধর করেন।   এক পর্যায়ে ইকবাল আলাউদ্দিনকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়।

‘বিষ খাইয়ে’ আলাউদ্দিনকে মারার প্ল্যান

জানাজানির পর আলাউদ্দিনকে যে কোনভাবে আয়ত্তে আনার চেষ্টা করতে থাকে ইকবাল।  আর আলাউদ্দিনের নিপীড়নে বিরক্ত রুম্পারও সায় মেলে।   আলাউদ্দিন রুম্পার স্বামীর দেশে ফেরার বিষয়টি জানতেন না।  তিনি আগের মতোই রুম্পার সঙ্গে যোগাযোগ করতে থাকেন এবং তাকে দেখা করার জন্য বলতে থাকেন।

সূত্রমতে, এক পর্যায়ে ইকবাল রুম্পাকে চাপ দেয় আলাউদ্দিনকে খুন করার জন্য।   তাকে ডেকে এনে বিষ খাইয়ে হত্যার কথা বলেন ইকবাল।   কিন্তু রুম্পা বললেন, ‘আমি পারব না। ’ তখন ইকবাল বলেন, ‘আমি হেল্প করব।  তোমাকেই মারতে হবে। ’ কিন্তু রুম্পা রাজি হয়নি।  

এদিকে আলাউদ্দিন বারবার রুম্পাকে দেখা করার জন্য চাপ দিতে থাকেন।   এক পর্যায়ে রুম্পা ইকবালের পরামর্শমতো আলাউদ্দিনকে জানায়, রুম্পা নতুন একটি বাসায় উঠতে যাচ্ছে।   সেখানে তিনি আলাউদ্দিনের সঙ্গে দেখা করবেন।

ইকবাল বায়েজিদ বোস্তামি থানার শহীদনগর এলাকায় ওমান প্রবাসী আবু ছৈয়দের মালিকানাধীন বাড়িতে একটি বাসা ভাড়া নেয়।   মূলত ইকবালকে হত্যার জন্যই বাসাটি ভাড়া নেয়া হয়।

‘আমার ভুল হয়ে গেছে’ এবং ভুলের খেসারত

পুলিশ সূত্রমতে, ২২ মার্চ বিকেলে আলাউদ্দিনকে ওই বাসায় আসার কথা বলেন রুম্পা।  বিকেল ৫টার দিকে ইকবাল ও রুম্পা এবং তার তিন সৎ ভাই হেলাল, মাসুদ ও তৈয়ব ওই বাসায় যায়।   সঙ্গে নেন নাইলনের রশি, একটি ছোরা, বালিশ-কাঁথা ও পাটি।   হেলাল বাড়ির কেয়ারটেকারের কাছ থেকে ঝাড়ু ও বালতি চেয়ে নেন এবং রুম পরিস্কার করেন।

যোগাযোগের পর মাত্র পাঁচ মিনিটের মধ্যে বিকেল ৫টা ২০ মিনিটের দিকে আলাউদ্দিন ওই বাসায় আসে।   রুম্পা দরজা খুলে দেয়।   রুম্পা ছাড়া বাকিরা ভেতরের একটি কক্ষে ছিল।

রুম্পা পুলিশকে বলেন, ‘আলাউদ্দিন বাসায় ঢুকেই আমাকে নিয়ে ভেতরের রুমে যেতে চেষ্টা করেন।   ভেতরের রুমে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই একজন তার শার্টের কলার ধরে ফেলেন।   তখন আমি বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলাম।   ইকবাল আলাউদ্দিনকে বলল, কেউ যদি তোমার স্ত্রীকে এভাবে ডিস্টার্ব করে তুমি কি করবে।   এসময় আলাউদ্দিন বলল, আমার ভুল হয়ে গেছে। ’

তখন ভেতরে ধ্বস্তাধ্বস্তির আওয়াজ শুনতে পার রুম্পা।   এক পর্যায়ে ইকবাল ওই কক্ষ থেকে বের হয়ে রুম্পাকে বলে একা একা বাসায় চলে যেতে।   রুম্পা বেরিয়ে যান।

বায়েজিদ বোস্তামি থানার ওসি মোহাম্মদ মহসিন বাংলানিউজকে বলেন, ইকবাল, তৈয়ব, হেলাল ও মাসুদ মিলে বাথরুমে নিয়ে খুন করে আলাউদ্দিনকে।   গ্রেফতার হওয়া তিনজনই হত্যার বিবরণ আমাদের দিয়েছে।   আমরা মাসুদকে ধরার চেষ্টা করছি।

হত্যার পর রাতেই ইকবাল তার মা ও স্ত্রী রুম্পাকে নিয়ে রাউজানে খালার বাড়িতে চলে যান।   সেখান থেকে স্ত্রীকে নিয়ে রাতে চলে আসেন নগরীর হামজারবাগে তার এক বন্ধুর বাসায়।   সেখান থেকে পরদিন আবার রাউজানের হিঙ্গলায় তার আরেক খালার বাড়িতে যান।  

ওইদিন রাতে খালার বাড়িতে যাবার সময় রুম্পা ইকবালের কাছে জানতে পারেন, আলাউদ্দিনকে খুন করা হয়েছে।

গ্রেফতারের পর রুম্পা পুলিশকে জানিয়েছেন, স্কুলজীবনে আলাউদ্দিনকে ভালবাসতেন রুম্পা। কিন্তু ক্রমাগত ব্ল্যাকমেইলিংয়ের শিকার হতে হতে আলাউদ্দিনের প্রতি তার ঘৃণা জন্ম নেয়।

আলাউদ্দিন খুন হওয়ার পর রুম্পার মধ্যে কোন অনুশোচনা আছে কি না জানতে চাইলে রুম্পা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, ‘কি বলব আর।   কিছুই বলার নেই। ’

বাংলাদেশ সময়: ২২৪৮ ঘণ্টা, মার্চ ২৮, ২০১৭

আরডিজি/টিসি

চবি ছাত্র খুনে গ্রেফতার ৪

বায়েজিদে খুন হওয়া যুবক চবি ছাত্র আলাওল

সন্ধ্যায় নেয় বাসাভাড়া, রাতে হত্যা করে উধাও

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।