ঢাকা, শনিবার, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১৮ মে ২০২৪, ০৯ জিলকদ ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

‘আমি মৃত্যুর অপেক্ষায় নেই’

রমেন দাশগুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬০৮ ঘণ্টা, মার্চ ৭, ২০১৭
‘আমি মৃত্যুর অপেক্ষায় নেই’ হাসপাতালের বেডে সিদ্দিক আহমেদ। ছবি: উজ্জ্বল ধর / বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

চট্টগ্রাম: আড়াই বছর ধরে মরণব্যাধি ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করছেন। হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, শ্বাসকষ্টসহ অনেক রোগ বয়ে বেড়াচ্ছেন শরীরে।  অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে এখন আর ক্যান্সারের চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।  চরম সংকটাপন্ন অবস্থায় মঙ্গলবার তাকে ভর্তি হতে হয়েছে হাসপাতালে।

হাসপাতালের বেডে শুয়ে মার্কিন কবি অ্যামিলি ডিকেনসনকে উদ্ধৃত করে তিনি শোনালেন এক অমর বাণী, আমি মৃত্যুর জন্য অপেক্ষায় নেই, মৃত্যুই আমার জন্য অপেক্ষা করছে।  যখন মৃত্যু মনে করবে তার অপেক্ষা শেষ, তখন আমার কাছে আসবে।

 

মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়ে এমন দৃঢ়তা নিয়ে কথা বলতে পারেন যিনি, তিনি সিদ্দিক আহমেদ। বর্ষীয়ান সাংবাদিক, যার অবস্থান সাংবাদিকতায় যাদের দিকপাল বিবেচনা করা হয় তাদের কাতারে।

  জ্ঞানের কিংবদন্তী হিসেবে ভক্ত-অনুরাগীদের কাছে যার পরিচিতি ‘এই শহরের সক্রেটিস’।

মঙ্গলবার সন্ধ্যায় হাসপাতালে কথা হয় ‘এই শহরের সক্রেটিসের’ সঙ্গে।   শরীর যে আর তাকে এগিয়ে যেতে সমর্থন করছে না, বোঝা যায় কন্ঠস্বরে।   কন্ঠের ক্ষীণ স্বর প্রায় অস্ফূট।   মৃত্যুর প্রহর গোণা মানুষটি তবু মৃত্যু নিয়ে এতটুকু চিন্তিত নন।   বরং প্রায় অচল শরীর নিয়ে ক্ষীণ সেই কন্ঠস্বরে এখনও তার মৃত্যুকে হারিয়ে দেয়ার দৃঢ়তা।  

বললেন, তুমি শুধু লিখবে, আমি এখন অসুস্থ।   সারা শরীর ফুলে গেছে।   নড়াচড়ার কোন সুযোগ নেই।   শরীরের অবস্থা খুব নাজুক।  

‘আমি বলছি, আমি কষ্ট পেতে রাজি আছি।   কিন্তু পরিবারকে কষ্ট দিয়ে বাঁচার আমার কোন দরকার নেই।  ডাক্তার বলছে, ঢাকায় গিয়ে চিকিৎসা করাতে হবে।   টাকা ম্যানেজ হবে, জায়গাজমি বিক্রি করে হলেও।   কিন্তু বৌ-ছেলেদের রেখে চিকিৎসার জন্য আর কোথাও যেতে চাই না। ’

‘আমি বলছি যে, দুই লাখ, তিন লাখ টাকা খরচ করলাম।  কিন্তু আমি জানি, আমি পুরোপুরি সুস্থ হব না। ’

এরপর সিদ্দিক আহমেদের সেই দৃঢ় কন্ঠে খানিক আবেগের স্পর্শ।  বললেন- পড়তে পারি না, লিখতে পারি না, শুধু শুধু জীবনের আয়ূ বাড়িয়ে লাভ নেই।  

‘জীবনে আনন্দ না থাকলে এক সেকেণ্ডও বাঁচতে চাই না।  নট ফর অ্যা মিনিট।   এটা হল আমার শেষ কথা।   মূল্যহীন জীবন আমি এক সেকেণ্ডও উপভোগ করতে চাই না। ’ 

‘এক জীবনে মানুষের এত এত ভালবাসা পেয়েছি, আর কী চাই ? কত নিবিড় ভালবাসা আমার জন্য।   আমি এখন অক্ষম এক মানুষ।   তারপরও মানুষ ফোন করে বলে, কেমন আছেন ? এটা ভালবাসা। ’ বলেন সিদ্দিক আহমেদহাসপাতালের বেডে সিদ্দিক আহমেদ (ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম)

তবে জীবন চলার পথে যারা দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু তাদের নিয়ে আক্ষেপের কথাও শোনালেন সিদ্দিক আহমেদ, স্বভাবজাত ভালবাসার গুণে যিনি লেখক-সাংবাদিক-সংস্কৃতিকর্মী, প্রগতিশীল রাজনৈতিক মহলে সৃষ্টি করেছেন অগণিত ভক্ত-অনুরাগী।  

‘যারা সবসময় ক্লোজ ছিল, তারা চলে গেছে।   তারা ভাবছে আমার কাছে আসলে আমি টাকা চাইব।   কিন্তু আমি তো অন্যধরনের মানুষ।   আমি তো আমার ছেলেদের থেকেও টাকা খুঁজি না। ’

‘আমার বন্ধুদের অনেকে কোটি কোটি টাকার মালিক।   আমার টাকা থাকলে আমি তাদের দেখাই দিতাম।   বলতাম, এটা রাখ, চিকিৎসা কর। ’

‘আমি লেখাপড়া করেছি, অনেক পড়েছি।   আমি পড়েছি জীবনকে সাজানোর জন্য, জীবনকে বোঝার জন্য।   টাকা কামানোর জন্য নয়।  এমনও দিন গেছে আমি উপোস থেকেছি।   দুইদিন পর্যন্ত ভাত খাইনি। ’

‘দু:খ হচ্ছে, আমি আমার মত মানুষ খুঁজে পেলাম না।   সবখানে স্বার্থের দ্বন্দ্ব, কর্তৃত্বের দ্বন্দ্ব।  অথচ আমি জীবনে কোনদিন কারও কাছে কোন বেনিফিট চাইনি।   আমার ছেলেরা সবাই নিজের যোগ্যতায় লেখাপড়া করেছে।   অথচ আমার বন্ধুবান্ধবের সংখ্যা কম নয়। কিন্তু ছেলেদের জন্য আমি কখনও কারও কাছে কিছু চাইনি। ’ বলেন সিদ্দিক আহমেদ

সিদ্দিক আহমেদকে ভর্তির খবর শুনে হাসপাতালে যান বিএফইউজের সহ সভাপতি শহীদ উল আলম ও ডেইলি অবজারভারের ব্যুরো প্রধান নূরুল আমিন।   তারা সিদ্দিক আহমেদের চিকিৎসার খোঁজখবর নেন।  

সিদ্দিক আহমেদের শরীরিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে ডা. মো.জাহেদুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, ক্যান্সার শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে।   কিন্তু ক্যামোথেরাপি দেয়ার মতো শারীরিক সক্ষমতা উনার নেই।   হার্ট ফেইলিউর আছে।  হার্টে পাম্প কম হওয়ায় সারা শরীরে ফোলা এসেছে।   এই অবস্থায় উনার অবস্থা সংকটাপন্ন বলা যায়।

বাংলাদেশ সময়: ২১৫৮ ঘণ্টা, মার্চ ০৭, ২০১৭ 

আরডিজি/টিসি

‘জীবনের গান গাওয়া বোধহয় শেষ...’

‘মানুষ কোনো দিন মরে না’

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।