ফিশারিঘাটে বরফ কুড়িয়ে জীবন চলে সুমনের মতো কমপক্ষে শ’খানেক শিশুর। ফিশারিঘাটের মাছ বিক্রেতাদের কাছে কেউ যদি সুমনদের দেখিয়ে জানতে চায়, এরা কারা ? উত্তর আসবে, এরা টোকাই, বরফ টোকাই।
কনকনে শীতের দেখা চট্টগ্রামে এখনও মেলেনি। তবুও শীতের ভোরে ঠাণ্ডার মধ্যে অনেক শিশুই যখন পরম মমতা আর আয়েশে ঘুমের তৃপ্তি নিচ্ছে তখন সেই ঠাণ্ডাকে উপেক্ষা করে সুমনদের নামতে হচ্ছে জীবিকার সংগ্রামে।
মঙ্গলবার (১০ জানুয়ারি) ভোর ৬টার দিকে ফিশারিঘাটে মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে গিয়ে দেখা হয় সুমনের সঙ্গে। পরণে পাতলা একটি শার্ট আর জিনসের প্যান্ট। শরীরে নেই কোন শীতবস্ত্র।
শীত লাগছে না, জানতে চাইলে উত্তর আসে এভাবে, ‘শীত একটু একটু লাগে। বরফ ধরলে আরও বেশি লাগে। শীত লাগলে কামাই করব ক্যামনে ?’
জামালের বয়স ৯ বছর। নগরীর বাকলিয়ায় বাস্তুহারা কলোনিতে ব্র্যাক স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র। সুমনের মতো জামালেরও সকাল শুরু হয় ভোরের আলো ফোটার আগে। জামালরা ৬ ভাই-বোন। বাবা ভ্যানগাড়ি চালায়। ভাই এখনও ছোট, সেজন্য মাকে বাসায় থাকতে হয়। ঘরে নিত্য অভাব।
‘টাকার দরকার আছে। না হলে কি আর এখানে আসি। সাধে কি আর বরফ কুড়াই !’ বলে জামাল।
বঙ্গোপসাগর ও কর্ণফুলী থেকে মাছ নিয়ে তীরে ভিড়ে ট্রলার-নৌকা। ছোট ছোট ট্রাক-পিকআপ ভ্যানে বোঝাই করে সেই মাছ বিক্রির জন্য নিয়ে আসা হয় পাইকারি আড়ত ফিশারিঘাটে। ট্রাক-ভ্যান থেকে মাছগুলো খালাসের পর সেখানে দেওয়া বরফের ছোট ছোট খণ্ড পড়ে থাকে মাটিতে। সেই বরফখণ্ড কুড়িয়ে টুকরিতে নেয় বরফ টোকাইরা।
পাথরঘাটা কলাবাগান থেকে দুই ভাই সাদ্দাম আর শাকিল আসে ফিশারিঘাটে বরফ কুড়াতে। দুই ভাই মিলে প্রতিদিন কমপক্ষে ১০ টুকরি বরফ কুড়ায়।
সাদ্দাম বাংলানিউজকে বলেন, গরমকালে বরফের দাম বেশি। তখন এক টুকরি ২৫ থেকে ৫০ টাকায় বিক্রি হয়। শীতকালে তো মাছে বেশি বরফ দিতে হয় না। এখন টুকরি ১০-২০ টাকায় বিক্রি করি।
কুড়িয়ে পাওয়া বরফ বিক্রি করে প্রতিদিন দুই ভাইয়ের দেড়’শ টাকার মতো আয় হয় বলে জানায় সাদ্দাম।
বরফ টোকাই জাহেদ বাংলানিউজকে জানায়, পুরো ফিশারিঘাট জুড়ে শ’খানেক শিশু আছে যারা বরফ কুড়িয়ে বিক্রি করে। পাথরঘাটা কলাবাগান, শুটকিপট্টি, বাকলিয়ার মিয়াখান নগর, বৌবাজার, বাস্তুহারা কলোনিসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে শিশুরা বরফ কুড়ানোর জন্য প্রতিদিন সকালে ফিশারিঘাটে জড়ো হয়।
১০ বছর বয়সী আমজাদ। কাজ করে ফিরিঙ্গিবাজারে একটি বরফকলে। বড় বড় বরফের টুকরা ভ্যানে তুলে দেওয়া তার কাজ। আমজাদের পরণে আছে উলের সোয়েটার, মাথায় উলের টুপি।
‘বরফকলের ভেতরে তো শীত বেশি। কানের ভেতর দিয়ে ঠাণ্ডা বাতাস ঢুকে যায়। সেখানে কাজ করতে বেশি কষ্ট। ঠাণ্ডার জন্য বরফ ধরতে ইচ্ছা করে না। ’ বলেন আমজাদ।
বরফকল থেকে বড় বড় বরফের খণ্ড ভ্যানে করে ফিশারিঘাটে মাছে দোকানে নিয়ে যাওয়া হয়।
ভ্যানচালক মোখলেছ (৪০) বাংলানিউজকে বলেন, হাতে ধরে বরফ নামাতে হয়। হাত অবশ হয়ে আসে। তবুও নামাই। এটাই আমাদের পেশা।
মোখলেছের মতো হাত অবশ হয়ে আসে রাকেশ জলদাসেরও (৩৮)। বরফ নামাতে কষ্ট হয়, খুব কষ্ট।
‘কষ্ট হলে কি হবে ? শীত-গরম, এগুলোকে পাত্তা দিলে কি পেট চলবে ? আমার ঘরে ১১ জন লোক। ইনকাম না করলে খাব কোত্থেকে ?’ বলে রাকেশ জলদাস।
বাংলাদেশ সময়: ০৯১২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১০, ২০১৭
আরডিজি/আইএসএ/টিসি