ঢাকা, সোমবার, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ২০ মে ২০২৪, ১১ জিলকদ ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

ভাসমান সবজি চাষে বিশ্বস্বীকৃতি ও অধ্যাপক আবু তৈয়ব

তাসনীম হাসান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৪৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৪, ২০১৬
ভাসমান সবজি চাষে বিশ্বস্বীকৃতি ও অধ্যাপক আবু তৈয়ব

চট্টগ্রাম: টোপাপানা, শ্যাওলা, কচুরিপানাকে ধাপে ধাপে সাজিয়ে পানির ওপর তৈরি ভাসমান বীজতলা। কৃষকের হাতের ছোয়ায় সেখানে গড়ে উঠে সবুজ।

তোকায় তোকায় ধরে লাউ, সিম, বেগুন, বরবটি, করলা, টমেটো, পুঁইশাক কিংবা মিষ্টি কুমড়া। এটি দেশের বন্যাকবলিত অঞ্চলের পরিচিত দৃশ্যের একটি।


টেকসই কৃষি ব্যবস্থার ঐতিহ্য হিসেবে ২০১৫ সালের ১৫ ডিসেম্বর জাতিসংঘের স্বীকৃতি পেয়েছে এই ভাসমান সবজি চাষ ব্যবস্থা। আর এই স্বীকৃতির পেছনে অবদান রেখেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবু তৈয়ব চৌধুরীর গবেষণা। তার দীর্ঘ দেড় যুগের খাদ্য নিরাপত্তা ও টেকসই উন্নয়নের ওপর গবেষণার ফসল এই স্বীকৃতি।

১৯৯৭ সালে জাতিসংঘের একটি অংগ সংগঠনের অধীনে চার বছর কৃষি অর্থনৈতিক প্রশিক্ষণ এবং ডাটাবেস বিশেষজ্ঞ হিসেবে কর্মরত ছিলেন অধ্যাপক আবু তৈয়ব চৌধুরী।

এ সময় রিসার্স মনোগ্রাফ এবং ওয়ার্কিং পেপার হিসেবে তার যেসব প্রকাশনা  জাতীসংঘের সোস্যাল কমিশন ফর এশিয়া অ্যান্ড দ্য প্যাসিপিক এর মাধ্যমে হয়েছে তা হল, অ্যাগরিকালচারাল প্ল্যানিং ইন এশিয়া, ডাটাবেজ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড অ্যানালিটিক্যাল টেকনিক’স ফর অ্যাগরিকালচার প্ল্যানিং এবং এন অ্যাগরিকালচার স্ট্যাটাটিসটিক্যাল প্রোফাইল অব বাংলাদেশ। এসব প্রকাশনায় এশিয়ার কৃষি ব্যবস্থা ছাড়াও ওঠে আসে বাংলাদেশের কৃষি ব্যবস্থার পেক্ষাপট।

পরবর্তীকালে সেই গবেষণায় গতি পায় ২০১২ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদানের পর। একই বছরের আগস্ট মাসে জাতীসংঘের সোস্যাল কমিশন ফর এশিয়া অ্যান্ড দ্য প্যাসিপিক এর গবেষণা পত্রিকা পালাউইযাতে একটি গবেষণা প্রবন্ধ ছাপানো হয়। প্রবন্ধটি খাদ্য নিরাপত্তায় টেকসই কৃষির ভূমিকা নিয়ে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে লেখা। এরপর তিনি সোস্যাল কমিশন ফর এশিয়া অ্যান্ড দ্য প্যাসিপিক এর ডিরেক্টর ড. কাতিঙ্কা উয়িনবারজারের অনুপ্রেরণায় সাসটেইনেবল অ্যাগরিকালচারাল টেকনোলজি নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করেন।

২০১২ সালের শেষের দিকে তিনি সাসটেইনেবল অ্যাগরিকালচারাল টেকনোলজি নেটওয়ার্ক (এসএটিএনইটি)এশিয়া গ্লোবাল সার্ভেতে টেকনোলজিস অ্যান্ড গুড প্যাকট্রিস ইন সাসটেইনেবল অ্যাগরিকালচার শীর্ষক বিষয়ের ওপর এক জরিপ শুরু করেন।

তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের ভাসমান সবজিচাষকে টেকসই প্রযুক্তি হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের লক্ষে এসএটিএনইটি, এশিয়া বরাবর একটি প্রস্তাবনা প্রতিবেদন পেশ করেন। এর ফলশ্রুতিতে জার্মানির হোহেনিহেয়াম বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত এক জরিপের তথ্য সংগ্রহ ও প্রযুক্তি বিশ্লেষণের কাজে নেতৃত্ব দেন এই শিক্ষক। এ সময় প্রচারের আলোয় নিয়ে আসেন বাংলাদেশের ভাসমান সবজি চাষকে।

২০১৩ সালের মার্চে জার্মানীতে অনুষ্ঠিত ইনটারনেশনাল কংগ্রেস হিডেন হাঙ্গার এ প্রবন্ধ উপাস্থাপন করেন অধ্যাপক আবু তৈয়ব। এতে তিনি খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় ভাসমান সবজি চাষের গুরুত্ব তুলে ধরেন।

২০১৪ সালের ৩১ অক্টোবর ভাসমান সবজি চাষ টেকসই প্রযুক্তি হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করলে তার গবেষনাসমূহ সংরক্ষণ করা হয়। অধ্যাপক তৈয়বের এই গবেষণা এখন বিশ্ব ঐতিহ্য। বাংলাদেশকে দিয়েছে বিশ্বস্বীকৃতি।

বন্যাকবলিত অঞ্চলের চাষাবাদ ব্যবস্থায় নতুনত্ব, টেকসই এবং অভিযোজন ক্ষমতা এই তিনটি বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে বাংলাদেশকে এ স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন অধ্যাপক আবু তৈয়ব।

নিভৃতচারী ও প্রচারবিমুখ এ গবেষকের কাছে স্বীকৃতির বিষয়ে জানতে চাইলে  অভিজ্ঞতার ঝাপি খুলে দিলেন। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, দীর্ঘদিনের গবেষণার ফলে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোর পাশাপাশি অন্যান্য জেলাগুলোতেও পরিত্যক্ত, জলযুক্ত অনাবাদী, জলাশয়যুক্ত জমি, হাওড়-বাওড় ইত্যাদিতে ভাসমান সবজি চাষ করা যাবে। এতে একদিকে বেকারদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে অন্যদিকে দেশের জনগণের খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা পূরণে গুরুত্বর্পূর্ণ অবদান রাখবে। এ পদ্ধতিতে চাষাবাদের ফলে সম্ভাব্য জলবায়ূ পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলা, খাদ্য ও পুষ্টি সমস্যা সমাধানে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

অধ্যাপক আবু তৈয়ব জানান, প্রথাগত এই চাষ কৌশলটি খুবই পরিবেশ বান্ধব। এর মাধ্যমে জলাভূমির প্রাকৃতিক সম্পদের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত হয়। একই  সঙ্গে সারা বছর এ পদ্ধতিতে বিভিন্ন ধরনের ফসল চাষাবাদ করা যায়।

‘এ চাষাবাদ হয় সম্পূর্ণ জৈব পদ্ধতিতে। রাসায়নিক সারের ব্যবহার নেই বললেই চলে। ফলে উৎপাদন খরচও কম এবং স্বাস্থ্যকর। আর ভাসমান বলে বন্যা হলেও সমস্যা হয় না। ’

বাংলাদেশের এই স্বীকৃতিতে দারুণ গর্ববোধ করছে গুণী এই শিক্ষক। তবে গবেষকের বিষয়টি তুলে না ধরায় আক্ষেপ দেথা গেল কণ্ঠে। তিনি বলেন, দেশে ভাসমান সবজি নিয়ে প্রথম গবেষণা করেছি আমি। জরিপও চালিয়েছি আমি। সবকিছু সংরক্ষণ করেছি। অথচ কার গবেষণার ভিত্তিতে এই অর্জন তা কোথাও তুলে ধরা হয়নি। আমরা শিক্ষক, প্রচারণা চাই না। তবে প্রেরণাতো কামনা করতে পারি।  

বাংলাদেশ সময়, ১৮৪০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৪, ২০১৬
টিএইচ/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।