ঢাকা, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

তদন্তে আটকে আছে চবির ছাত্র হত্যার বিচার

মাহবুব আলম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৫৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২০, ২০১৪
তদন্তে আটকে আছে চবির ছাত্র হত্যার বিচার ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

চট্টগ্রাম: আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) বিভিন্ন সময় ছাত্র সংঘর্ষের ঘটনায় ১৭ হত্যাকাণ্ডের বিচার তদন্তের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। এসব ঘটনায় বেশ কয়েকটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও কমিটির প্রতিবেদন অনুসারে কার্যকরী ব্যবস্থা বা কোন সুপারিশই বাস্তবায়ন করেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।



সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সংঘর্ষের ঘটনার পর তদন্ত কমিটির রিপোর্ট অনুসারে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা এবং সংঘর্ষ এড়াতে সুপারিশমালা বাস্তবায়ন করলে শিক্ষাঙ্গনে পড়তে এসে শিক্ষার্থীরা রাজনীতির বলি হতো না।

২০১০ সালের ১৫ এপ্রিল অর্থাৎ পহেলা বৈশাখের পরদিন রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেলস্টেশনে খুন হওয়া আসাদ হত্যাকাণ্ডে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান ইনস্টিটিউট অব ফরেস্ট্রি এন্ড ফিশারিজে’র প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আল-আমীন।


ওই হত্যাকাণ্ডের খুনীদের চিহ্নিত করে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিলেও তা প্রকাশ করা হয়নি। এমনকি প্রতিবেদনে করা কোন সুপারিশও বাস্তবায়ন হয়নি আজ পর্যন্ত!

হতাশা প্রকাশ করে ড. মোহাম্মদ আল আমীন বাংলানিউজকে বলেন,‘নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আসাদ হত্যার আসামিদের চিহ্নিত করে প্রতিবেদন জমা দিয়েছিলাম। কিন্তু তা আমলে নেওয়া হয়নি। আসামিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া তো দূরের থাক প্রতিবেদনটি সিন্ডিকেটসহ কোন পর্ষদেই উত্থাপন করা হয়নি। ’

জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা কিংবা সুপারিশমালা বাস্তবায়ন হলে ছাত্রদের মধ্যে এ ধরনের সংঘর্ষ এড়ানো সম্ভব হত বলে মনে করেন তিনি।

একই কথা জানালেন ২০১০ সালে হারুণ-অর-রশিদ হত্যার ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক বন ও পরিবেশবিদ্যা ইনস্টিটিউটের প্রফেসর ড. মোহাম্মদ মহিউদ্দিন। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া মামুন হত্যার তদন্ত কমিটিরও প্রধান তিনি।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রায় প্রতিটি হত্যা ও সংঘর্ষের ঘটনার ব্যাপারে গঠিত তদন্ত কমিটি বেশ কিছু সুপারিশ প্রতিবেদন আকারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে জমা দিয়েছে। এরমধ্যে প্রায় প্রতিটি রিপোর্টের মধ্যেই উল্লেখ ছিল, নেতিবাচক রাজনীতি না করার ব্যাপারে প্রচারণা চালানো, ১৫ সদস্যের স্থায়ী পরিবেশ কমিটি গঠন, ক্যাম্পাসে সভা-সমাবেশ ও প্রতিক্রিয়াশীল পোস্টার-লিফলেট না সাঁটানো, আবাসিক হলগুলোকে বহিরাগতমুক্ত করা এবং শিক্ষার্থীদের নিয়ে কাউন্সেলিং এর ব্যবস্থা করাসহ বিভিন্ন সুপারিশ।
 
জানতে চাইলে প্রফেসর ড. মোহাম্মদ মহিউদ্দিন বলেন,‘প্রতিবেদনের সুপারিশ বাস্তবায়ন হয় না তা নয়, কিছু বাস্তবায়ন হলেও অধিকাংশই হয় না। কঠোর হস্তে এসব সুপারিশ বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নিলে ছাত্র সংঘর্ষ এড়ানো যেতো, সার কথায় বলতে পারি এ ধরনের সংঘর্ষ ঘটতো না। ’

অগ্রগতি নেই মামলারও:
বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংঘর্ষে নিহতের প্রায় প্রতিটি ঘটনায় স্থানীয় হাটহাজারীসহ রেলওয়ে থানায় মামলাও হয়েছে। এরমধ্যে একটি মামলার কার্যক্রম শেষ হয়েছে। বাকি মামলাগুলোর ঘন ঘন তদন্ত কর্মকর্তা বদলি হয়েছেন বিভিন্ন কারণে। ফলে তদন্তের মধ্যেই থেকে যাচ্ছে মামলার কার্যক্রম।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নিখোঁজ হওয়া আইনুল হকের লাশ গুম করার অভিযোগ প্রমানিত না হওয়ায় ২০০৯ সালের এপ্রিলে আসামিদের খালাস দেয়া হয়। ছাত্রলীগ নেতা আলী মর্তুজা হত্যা মামলার এখনও বিচারাধীন।

তবে আসাদ হত্যা মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হলেও কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি।

হাটহাজারী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (তদন্ত) আবুল কাশেম ভূঁইয়া বলেন,‘আসাদ হত্যা মামলার তদন্ত শেষে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। বাকি মামলাগুলোরও তদন্ত কাজ চলছে। ’

পুলিশ সূত্র জানায়, কায়সার হত্যা মামলায় তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন জিআরপির এসআই (উপ-পরিদর্শক) মো. শহীদুল্লাহ। তবে তিনি জাতিসংঘ মিশনে অংশ নেওয়ার কাজে ঢাকায় চলে যান। এ মামলায় ছাত্রলীগের পাঁচ নেতা-কর্মীকে তিন দিনের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা ছাড়া আর কিছুই করতে পারেনি পুলিশ।

এদিকে মাসুম হত্যা মামলাটি প্রথমে রেলওয়ে পুলিশ (জিআরপি) তদন্ত করলেও পরে তা সিআইডিতে হস্তান্তর করা হয়। এর দায়িত্ব পান সিআইডির তৎকালীন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (এএসপি) নাজির হোসেন। কিন্তু  তিনি বদলি হলে মামলার তদন্তভার পান এএসপি সাদেকুল ইসলাম। তার বদলির পর মামলাটির অগ্রগতি থেমে যায়।

পড়তে এসে লাশ হলেন যারা:
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ১৯৮৮ সালে আইনুল হক নামে বিশ্ববিদ্যালয় শিবিরের এক কর্মী নিখোঁজ হন। শিবির এ ঘটনায় প্রতিপক্ষতে দায়ী করে আসছিল।

১৯৯০ সালের ২৩ ডিসেম্বর ক্যাম্পাসে ছাত্র-শিক্ষকদের আনন্দ মিছিলে শিবিরের হামলায় নিহত হন ছাত্রমৈত্রীর নেতা ফারুকুজ্জামান। এরপর ১৯৯৪ সালের ২৭ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সাংগঠনিক সম্পাদক নুরুল হুদা মুছার ওপর হামলা চালায় শিবির। এরপর ৯ নভেম্বর চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাসপাতালে মারা যান তিনি।

এছাড়া ১৯৯৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশ্ববর্তী মোজাম্মেল কটেজে ও ‘৯৮-এর ৬ মে শাহ আমানত হলে শিবিরের হামলায় প্রাণ হারান আমিনুল ইসলাম ও আইয়ুব আলী নামে দুই ছাত্র।

১৯৯৮ সালের ১৮ মে নগরীর অক্সিজেন-হাটহাজারী সড়কের বালুচরা এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক বহনকারী বাসে নির্বিচারে গুলি চালায় শিবিরের নেতাকর্মীরা। এসময় ওই বাসে থাকা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের (চমেক) শিক্ষার্থী মুশফিক সালেহীন নামে এক শিক্ষকের ছেলে মারা যান।

একই বছরের ২০ আগস্ট নগরীর বটতলী পুরানো রেলস্টেশনে শিবিরের কর্মীদের হামলায় আহত হয়ে ২২ আগস্ট চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী সঞ্জয় তলাপাত্র।

এ ছাড়া ছাত্রলীগের কর্মীদের হামলায় ১৯৯৯ সালের ১৫ মে জোবায়ের হোসেন এবং একই বছরের ১৯ ডিসেম্বর মো. রহীমুদ্দিন ও মাহমুদুল হাসান নিহত হন। এই তিনজনকে শিবির তাদের নেতাকর্মী বলে দাবি করেছে।

২০০১ সালের ২৯ ডিসেম্বর হাটহাজারীর ছড়ারকূল এলাকায় শিবিরের হামলায় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র নেতা আলী মতুর্জা চৌধুরী, ২০১০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি সন্ত্রাসী হামলায় রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র মহিউদ্দিন মাসুম এবং একই বছরের ২৯ মার্চ রাতে চৌধুরীহাট স্টেশনের কাছে মার্কেটিং তৃতীয় বর্ষের ছাত্র হারুণ-অর-রশিদ কায়সার খুন হন।

২০১০ সালের ১৫ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয় রেলস্টেশনে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডারত আসাদুজ্জামান আসাদকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করা হয়।

এরপর ২০১২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ছাত্রলীগ-শিবির সংঘর্ষে ছাত্রশিবিরের নেতা মাসউদ বিন হাবিব ও মোজাহিদুল ইসলাম নিহত হন। সর্বশেষ চলতি বছরের ১২ জানুয়ারি শাহ আমানত হলে ছাত্রলীগ-শিবির সংঘর্ষে ওই হল শাখার শিবিরের সাধারণ সম্পাদক মামুন হোসেন খুন হন।

নিষিদ্ধ করেও বন্ধ করা যাচ্ছে না সংঘর্ষ:
ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে বিভিন্ন সংঘর্ষের ঘটনা এড়াতে ২০১০ সাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সব ধরনের মিটিং-মিছিলসহ রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। তবে সরকার সমর্থিত ছাত্রসংগঠনসহ বিভিন্ন প্রতিক্রিয়াশীল সংগঠনও তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর মো. আনোয়ারুল আজিম আরিফ বাংলানিউজকে বলেন,‘তদন্ত কমিটির সুপারিশসহ প্রতিবেদন যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা হয়। রিপোর্ট অনুযায়ী জড়িতদের বিরুদ্ধে বহিষ্কারসহ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে মামলা করা হয়। বাকি দায়িত্ব প্রশাসনের। ’

বারবার সংঘর্ষের ঘটনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন,‘বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের ঘটনার পেছনে অনেক ইন্ধনদাতা রয়েছে। তাদের চিহ্নিত করতে হবে। ’

ছাত্রদের সঙ্গে ছাত্র সুলভ আচরণ না করে প্ররোচনা দেয়ায় এধরনের সহিংস ঘটনা ঘটছে বলে মনে করেন উপাচার্য।

তবে বিভিন্ন হত্যা মামলাগুলোর বিচার প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়াসহ ভবিষ্যতে ছাত্রদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা এড়াতে প্রয়োজনীয় চেষ্টা চালানো হবে বলে দৃঢ় মনোভাব ব্যক্ত করেন প্রফেসর আরিফ।

বাংলাদেশ সময়: ১২৫১ঘণ্টা, জানুয়ারি ২০, ২০১৪
সম্পাদনা: তপন চক্রবর্তী, ব্যুরো এডিটর।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।