ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

বইমেলা

সোহরাওয়ার্দীতে স্বস্তি, তবে...

অশোকেশ রায়, আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭৫০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০১৭
সোহরাওয়ার্দীতে স্বস্তি, তবে... বইমেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশ। ছবি: আনোয়ার হোসেন রানা

ঢাকা: শিশু চত্বরে মনের আনন্দে দৌড়াতে-খেলতে থাকা বছর দুয়েকের প্রহর-এর উদ্দেশ্যে মায়ের সতর্ক চিৎকার- ‘হারিয়ে যাবে’। পাশেই বটগাছ ঘিরে গড়া ‘সিসিমপ‍ুর’ এর ছোট্ট মঞ্চে লাফাতে থাকা আরও ২৫/৩০ জন বাচ্চা-কাচ্চার দিকেও নিচে দাঁড়িয়ে থাকা অভিভাবকদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি- ‘পাছে না পড়ে গিয়ে ব্যথা পায়’। তারাও চেচিয়ে সতর্ক করছিলেন যার যার আদরের সন্তানকে।

কিন্তু নাগরিক ‘বন্দিজীবন’ থেকে খানিকটা ‘মুক্তি’ পাওয়ার আনন্দ কি আর বাঁধ মানে, বাধা মানে? শৈশবের উচ্ছ্বাস তাই স্বজনের সতর্কতায় বেড়েই চলেছিল কেবলই হাঁটতে শেখা থেকে শুরু করে এর চেয়ে বেশি বয়সি ছোট সোনামণিদের।

অমর একুশে গ্রন্থমেলায় এসে শিশু-কিশোরদের এ আনন্দ-উচ্ছ্বাস-উৎসব আগেও ছিল।

তবে বাংলা একাডেমির স্বল্প পরিসরের বইমেলার ভিড়-ঠেলাঠেলিতে আর কম জায়গার শিশু চত্বর ঘিরে তা প্রকাশের বিড়ম্বনা ছিল অনেক। মাঝে মাঝে ছোটদের হারিয়ে যাওয়ার ঘোষণাও শোনা যেতো তথ্যকেন্দ্রের মাইকে।

গত তিন বছর ধরে বাংলা একাডেমির উল্টোদিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিস্তৃত পরিসরে বইমেলা সম্প্রসারণ এবং কিছু প্রাতিষ্ঠানিক স্টল ও লিটল ম্যাগ চত্বর ছাড়া বাকি সব স্টল-প্যাভিলিয়ন নিয়ে যাওয়ায় বাবা-মায়ের হাত ধরে মেলায় আসা ছোটদের পাখির মতো ডানা মেলবার ফুরসত মিলেছে অনেক বেশি। তাদের সামলাতে অভিভাবকদের হ্যাপাও যে কমেছে, তাও বোঝা যাচ্ছে। কেননা, দুই প্রান্তেরই তথ্যকেন্দ্র, মূলমঞ্চ ও নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন মঞ্চ থেকে ভিড়ের মাঝে সন্তানদের হাত শক্ত করে ধরে রাখার অনুরোধ বার বার করতে দেখা গেলেও শোনা যাচ্ছে না কোনো হারিয়ে যাওয়ার সংবাদ।    

বইমেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশশুধু কি ছোটরা? ২০১৪ সালের পর থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বইমেলার বর্ধিত আয়োজন এবং কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি ছাড়া নিরাপত্তা নিয়ে দুই জায়গায় মেলা বসা নিয়ে খুশি-আনন্দিত সব বয়সী ক্রেতা-পাঠক-দর্শনার্থীরাও। তবে দুই অংশেই এবার ক্লান্তি দূর করতে একদণ্ড জিরোনোর সুযোগ উধাও হয়ে যাওয়ায় ক্ষুব্ধ তারা।

আবার সোহরাওয়ার্দী অংশের বেশকিছু অপরিকল্পিত পদক্ষেপ আর পাঠক-ক্রেতাদের দুই জায়গায় ছোটা-ছুটির ক্লান্তি, পরিশ্রম, দুর্ভোগে এবার বই বিক্রি কমেছে বলে অভিযোগ লেখক-প্রকাশকদের। মেলার মাঝামাঝি জায়গায় শিশু চত্বর লাগোয়া বিশাল জায়গাজুড়ে ডিএমপি’র পুলিশ কন্ট্রোলরুম ও সেটিকে ঘিরে রাখতে গিয়ে বাঁশ-দড়িতে মেলাকেই সঙ্কুচিত করাকেও অনেকে ভালো চোখে দেখছেন না।     

বইমেলার শেষ সময়ে এসে শুক্রবারের (২৪ ফেব্রুয়ারি) ‘শিশু প্রহর’সহ সারাদিনের প্রচণ্ড ভিড়ে বেশিরভাগ স্টলে বই বিক্রি আর পাঠক-ক্রেতা-দর্শনার্থী সামলাতে ব্যস্ত সময় কেটেছে প্রকাশক-কর্মীদের। তারপরও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ‘পাললিক সৌরভ’ প্রকাশনা সংস্থার (৪১২ নম্বর) স্টলে বসে ক্ষোভ প্রকাশ করলেন প্রধান নির্বাহী ও প্রকাশক মেহেদী হাসান শোয়েব। তার ক্ষোভ স্টল-প্যাভিলিয়ন বিন্যাস নিয়ে।       

শোয়েব বলেন, ‘বাংলা একাডেমি অংশ ঘুরে ও এতোদূর হেঁটে এসে যাওবা ক্রেতা-পাঠকরা আমাদের দিকে আসছেন, তারা তো বড় জায়গাজুড়ে থাকা ১৩টি প্যাভিলিয়নসহ ২৫টি বড় স্টলেই ঢুকে যাচ্ছেন। ফলে আমরা ছোট প্রকাশকরা মার খাচ্ছি। গতবার সাত লাখ টাকার বই বিক্রি হলেও এবার সোয়া লাখও পেরোবে না জানিয়ে তিনি বলেন, প্যাভিলিয়নসহ বড় স্টলগুলো একটি সীমাবদ্ধ অংশে রয়ে গেছে, তারাই দখল করে রাখছে এ জায়গাটুকু। পুরো সোহরাওয়ার্দী অংশে তাদের মাঝে দূরত্ব রেখে রেখে বিন্যস্ত করলে সবাই সমান গুরুত্ব-সুযোগ পেতো’।       

বইমেলায় ঢুকতে দীর্ঘ লাইন ও জনস্রোত এখনও মূলত বাংলা একাডেমির দিকেই চলে যাচ্ছে বলে উল্লেখ করে স্টলকর্মীরা আরও বলছেন, অনেক পাঠক-ক্রেতা ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত হয়ে সেখান থেকেই ফিরে যাচ্ছেন। মোড়ক উন্মোচন মঞ্চও এবার চলে গেছে সোহরাওয়ার্দী অংশে, বাইরে বের হওয়ার রাস্তার আগে। ছোট্ট মঞ্চ ও দর্শক দাঁড়ানোর জায়গায় ভিড়ের পাশাপাশি সেখানে থাকা ৠাবের ওয়াচ টাওয়ারের কারণে তারা বই বিক্রি ও ক্রেতাদের জায়গা করে দিতে পারছেন না লাগোয়া অগ্রদূত (৩৬২), পলল প্রকাশনী (৩৬০-৩৬১), শব্দশৈলী (৩৫৬) ও পার্ল পাবলিকেশন্স (৩৫৪-৩৫৫) কর্মীদের।      

মেলার শেষ সময়ের ভিড়সোহরাওয়ার্দী অংশের সিদ্দিকীয়া পাবলিকেশন্সের (২৪৫ ও ২৪৬ নম্বর স্টল) প্রকাশক শিশু সাহিত্যিক মালেক মাহমুদের মতে, আবার এ অংশে এমনভাবে স্টল বিন্যাস করা হয়েছে যে, দর্শনার্থীরা একবার কোনো স্টলের সামনে এসে সামনে এগিয়ে গেলে আর সেখানে ফিরে আসতে পারছেন না। আগে গোলাকৃতির স্টলসজ্জায় সেটি ছিল না। এবার স্টলগুলোর গ্যাপ কমানোয় স্টলের সবপাশ খোলা রাখা গেলেও লম্বালম্বি ফুটবল মাঠের মতো হওয়ায় সামনে-পেছনে এসে, ঘুরে-ঘুরে, পছন্দমতো বই কেনার সুযোগ পাচ্ছেন না এবং বের হওয়ার রাস্তা নিয়ে সুনির্দিষ্ট দিক-নির্দেশনা না থাকায় গোলকধাঁধায় পড়ছেন পাঠক-ক্রেতারা।  
 
শিশু সাহিত্যিক ও ‘জলছাপ প্রকাশনী’র প্রকাশক লোকমান আহম্মদ আপন চান আরও অনেক কিছু। তার মতে, লেখক-পাঠক-প্রকাশকদের দীর্ঘদিনের দাবি মেনে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বইমেলা সম্প্রসারিত করে কাজের কাজ করেছে বাংলা একাডেমি। তবে এখন সময়ের দাবি মেনে মূল মঞ্চসহ পুরো মেলাকেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিয়ে যাওয়ার সময় এসেছে। এজন্য উদ্যানের আরও বেশি জায়গা, সম্ভব হলে পুরো উদ্যানেই মেলাকে ছড়িয়ে দিতে হবে। তাতে লেখক, পাঠক, ক্রেতা, প্রকাশকদের ভোগান্তি দূর হবে, সবাই মিলে গড়তে পারবেন আরও বড় মিলনমেলা।  

‘তাতে কি প্রাণের মেলার ঐতিহ্য হারিয়ে যাবে না, বাংলা একাডেমির অমর একুশে গ্রন্থমেলা- ভাষার মাস ফেব্রুয়ারির এ বছরান্তের আয়োজন কি ম্লান হবে না?’

এবারের মেলায় আসা ৪টিসহ মোট ২৬টি শিশুতোষ বইয়ের লেখক ও বাংলা সাহিত্যের প্রধান ছড়া কাগজ ‘ছড়াকর্ম’ এর সম্পাদক আপন মনে করেন, বাঙালি জাতি জানে-জানবেই, এটি বাংলা একাডেমির বইমেলা, ঐতিহ্য তাই হারাবে না, বরং আরও ছড়াবে আরও জনপ্রিয় হবে।

এবারের মেলায় রয়েছে ১২টি চত্বরে ভাগ করে গুচ্ছ পদ্ধতিতে সাজানো ৪১৫টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের প্যাভিলিয়নসহ ৬৪০ ইউনিটের স্টল। এর মধ্যে উদ্যান অংশে ৫৪০ ইউনিট ও একাডেমি অংশে রয়েছে ১০০ ইউনিট। একাডেমি অংশে বাংলা একাডেমিসহ বিভিন্ন সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের স্টলসহ বহেরাতলায় রয়েছে লিটল ম্যাগাজিন চত্বর।
 
শিশু চত্বরে ছোটদের ভিড়তবে অমর একুশে গ্রন্থমেলা পরিচালনা কমিটি ও বাংলা একাডেমির পক্ষ থেকে লেখক-প্রকাশকদের অভিযোগের বিষয়ে দাবি করা হচ্ছে, এবার ভালো ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মেলাকে দৃষ্টিনন্দন করা হয়েছে, মেলায় আসা পাঠক-দর্শনার্থীদের জন্য রয়েছে বসার ব্যবস্থা, আলোকসজ্জা।

গত বছরের বইমেলায় স্টল বিন্যাসের নানা অসঙ্গতিকে মাথায় রেখে এবার মেলার বিন্যাসে পরিবর্তন আনা হয়েছে। বিশেষ করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে মূল প্রকাশকদের স্টল, তাই সেদিকেই বেশি নজর দিচ্ছে কর্তৃপক্ষ। সব স্টল যেন সমান গুরুত্ব পায়, সেদিকে নজর রাখা হয়েছে। এবারের বইমেলার নান্দনিকতা বাড়াতে এবং পাঠকের সুবিধার্থে কিছু নতুন উদ্যোগও নিয়েছে আয়োজক বাংলা একাডেমি। রয়েছে পর্যটন করপোরেশনের রেস্টুরেন্টও।

তাছাড়া কবি-সাহিত্যিক-মনীষীসহ বিশিষ্টজনদের নামে নামাঙ্কিত ১২টি চত্বরেই প্রথমবারের মতো যুক্ত হয়েছে আলোকসজ্জা। চত্বরগুলোর স্বতন্ত্র রঙিন বাতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে চত্বরে অন্তর্ভুক্ত প্রকাশনা সংস্থাগুলোর স্টলসজ্জায় সে বিশেষ রঙের প্রাধান্য দিয়েছে একাডেমি।

১২টি চত্বরেই ডিজিটাল স্ক্রিনে রয়েছে স্টলের তালিকা ও নির্দেশিকা। চত্বরগুলোর মধ্যে শিশু চত্বরকে শিশুতোষ গ্রন্থ সংগ্রহের পাশাপাশি শিশুদের বিনোদন উপযোগী করে গড়ে তোলা হয়েছে। ১৩টি প্যাভিলিয়নকে রাখা হয়েছে অন্য ১১টি চত্বরে ভাগ ভাগ করে। সোহরাওয়ার্দী অংশের ৮টি ও একাডেমি অংশের ৪টি গেট দিয়ে নির্বিঘ্নে ঢুকতে এবং আলাদা আলাদা জায়গার গেট দিয়ে স্বচ্ছন্দে বের হতে পারছেন সবাই।

বাংলাদেশ সময়: ১৩৪৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০১৭
এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।