এক সময় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ছিল একে অপরের চরম প্রতিদ্বন্দ্বী। রাজপথ থেকে শুরু করে আলোচনার টেবিল—সব জায়গাই তারা ছিল পরস্পরবিরোধী অবস্থানে।
রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় দুই দলের আদর্শগত ভিন্ন অবস্থান স্বাভাবিক হলেও স্বৈরাচার হাসিনার পতনের আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ থাকা বিএনপি-জামায়াতের বর্তমান বিরোধ কোন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছায়, তা নিয়েই চলছে নানা আলোচনা। বিশ্লেষকরা বলছেন, ভোটের ময়দান সামনে রেখে ভিন্ন কৌশলে এগোতে পারে দু-দলই। কিন্তু সেটা যেন অস্থিরতা তৈরির সুযোগ না দেয় পতিত শক্তিকে।
২০০১-২০০৬ মেয়াদে জোট সরকার চালিয়েছিল বিএনপি ও জামায়াত। তাদের মধ্যকার সম্পর্কে দীর্ঘদিন মিত্রতা থাকলেও ২০১৩-১৪ সাল পরবর্তী প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক চাপসহ নানা কারণে জামায়াতের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে চলতে থাকে বিএনপি। যদিও দুই দলই ফ্যাসিস্ট হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে লড়েছে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। কিন্তু জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে হাসিনা সরকারের পতনের পর সেই টানাপোড়েন বেড়ে যায়। সংস্কার আগে নাকি জাতীয় নির্বাচন আগে, নির্বাচন কোন পদ্ধতিতে হবে—এমন প্রশ্নে বিএনপি ও জামায়াত পরস্পরবিরোধী অবস্থান নেয়।
বিএনপি দেশের স্থিতিশীলতার স্বার্থে দ্রুত নির্বাচনের দাবি জানালেও জামায়াত রাষ্ট্রের বিভিন্ন খাতে সংস্কারের দাবিতে অনড় থাকে। তাদের তরফ থেকে বলা হতে থাকে, প্রয়োজনীয় সংস্কার ছাড়া নির্বাচন হলে ভবিষ্যতেও এ ধরনের সংকট তৈরির ঝুঁকি রয়ে যাবে। যদিও আবার তারা সংসদ নির্বাচনকে মাথায় নিয়ে বিভিন্ন আসনে দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করে। দলটির এ ধরনের তৎপরতায় বিএনপির মধ্যে সন্দেহ ও আস্থাহীনতা আরও বাড়ে। স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়েও বিরোধে জড়ায় দল দুটি। বিএনপি বলতে থাকে, জাতীয় নির্বাচনের আগে অন্য কোনো নির্বাচন নয়। আর জামায়াতের দাবি ছিল, আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হোক।
সম্প্রতি পাঁচ দফা দাবিতে জামায়াতে ইসলামী কয়েকটি সমমনা দলকে সঙ্গে নিয়ে যুগপৎ আন্দোলন শুরু করেছে। এ দাবিগুলোর মধ্যে আছে জুলাই জাতীয় সনদের ভিত্তিতে আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন আয়োজন করা; আগামী জাতীয় নির্বাচনে উভয় কক্ষে পিআর (সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব) পদ্ধতি চালু করা; অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের লক্ষ্যে সবার জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড (সবার জন্য সমান সুযোগ) নিশ্চিত করা; ফ্যাসিস্ট সরকারের সব জুলুম-নির্যাতন, গণহত্যা ও দুর্নীতির বিচার দৃশ্যমান করা এবং স্বৈরাচারের দোসর জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা। প্রাথমিকভাবে দলগুলো ঢাকাসহ দেশব্যাপী তিন দিনের বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। ধারাবাহিকভাবে আরও কর্মসূচি পালনের পরিকল্পনাও রয়েছে তাদের।
এর বিপরীতে পাল্টা কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিএনপি। দলটি সারাদেশে নির্বাচনী আবহ সৃষ্টির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ লক্ষ্যে প্রার্থী বাছাই, দলীয় ৩১ দফা ও ইতিবাচক কর্মসূচির প্রচার, ভোটারদের মন জয় করতে বাড়ি বাড়ি যাওয়া এবং নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি প্রচারসহ নানা কার্যক্রম পরিচালনা করবেন বিএনপির নেতারা। এছাড়া জামায়াতের পিআর পদ্ধতি দাবির পেছনেও উদ্দেশ্য দেখছেন বিএনপির নেতারা। তারা মনে করছেন, আসনভিত্তিক নির্বাচনে ফলাফল অনুকূল হবে না ভেবে জামায়াত পিআর পদ্ধতি চাইছে। তাছাড়া আন্দোলনে পিআর পদ্ধতি নির্ধারণ হবে না। এটার জন্য আলোচনার টেবিলে আসতে হবে।
বিএনপির মতে, জামায়াতের যুগপৎ আন্দোলনের উদ্দেশ্য নির্বাচনের আগে মাঠের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রাখা এবং নেতা-কর্মীদের চাঙ্গা রাখা। এ অবস্থায় বিএনপি নিজ দলের নেতা-কর্মীদের নির্বাচনমুখী করার কৌশল নিয়েছে। দলের মনোনয়নপ্রত্যাশীসহ সব পর্যায়ের নেতা-কর্মীকে জনসম্পৃক্তিমূলক কার্যক্রম জোরদারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এদিকে জুলাই-আগস্টে শেখ হাসিনার পতন আন্দোলনে বিএনপির ভূমিকাকে প্রশ্ন করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও তাদের ঘনিষ্ঠ জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতারা যে প্রশ্ন তোলেন-সেটি জামায়াতের ইন্ধনেই হয়ে থাকে বলে বিএনপির নেতৃত্ব মনে করে। বিএনপি দাবি করে, ছাত্রদের আন্দোলনে চূড়ান্তভাবে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলেও এর ভিত্তি তৈরি হয়েছে তারেক রহমানের নেতৃত্বে তাদের গত ১৫ বছরের আন্দোলনের মাধ্যমে।
বিএনপি-জামায়াতের প্রায় মুখোমুখি অবস্থান দেখা যায় সদ্য অনুষ্ঠিত দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচন ঘিরেও। গত ৯ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের পর ফলাফল ঘিরে নানা উত্তেজনার মধ্যে প্রবেশপথে অবস্থান নেয় জামায়াত-শিবির ও বিএনপি-ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা। এতে ক্যাম্পাসে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। যদিও শেষ পর্যন্ত কোনো সংঘাত ছাড়াই নির্বাচন শেষ হয়। ফলাফলে দেখা যায়, ডাকসুতে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়ী হয়েছে জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ছাত্রশিবিরের প্যানেল। বিএনপির ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলের প্রার্থীরা এই ফলাফল কারসাজি করে হয়েছে দাবি করে প্রত্যাখ্যান করেন।
একই ধরনের পরিস্থিতি দেখা যায় দুই দিন পর ১১ সেপ্টের অনুষ্ঠিত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) নির্বাচনে। সেদিনও নির্বাচনে জালিয়াতিসহ নানা অভিযোগের মধ্যে মূল ফটক ও আশপাশে দুই পক্ষের নেতাকর্মীরা অবস্থান নেন। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়। যদিও ভোটগ্রহণের শেষভাগে অনিয়ম-কারচুপির অভিযোগ তুরে ছাত্রদলের প্যানেল নির্বাচন বর্জন করে। ফলাফলে দেখা যায়, নির্বাচনে ভিপি পদ ছাড়া বাকিগুলোর বেশিরভাগই জিতেছে ছাত্রশিবিরের প্যানেল।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের পর থেকেই সংস্কার ও নির্বাচন ইস্যুতে বিএনপির অবস্থানের সঙ্গে একমত ছিল জামায়াত। বিএনপি ও জামায়াত নেতাদের মধ্যে বিরোধের মূল কেন্দ্রে আছে জাতীয় নির্বাচন। অর্থাৎ জাতীয় নির্বাচন কখন হবে কিংবা কোনটি আগে হবে- জাতীয় নির্বাচন নাকি স্থানীয় নির্বাচন।
তারা বলছেন, বিএনপি ভাবছে জামায়াত ৩০০ আসনে প্রার্থী দিচ্ছে বা তারা অন্য ধরনের কিছু করতে পারে। আবার জামায়াত মনে করছে সংস্কারের আগে নির্বাচন হলে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে সেটি আর জনপ্রত্যাশা অনুযায়ী বাস্তবায়ন হয় কি না তা নিয়ে সন্দেহ আছে। এমন কিছু বিষয়েই দল দুটির চিন্তার ভিন্নতা দেখা যাচ্ছে।
বিএনপির জ্যেষ্ঠ এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তাদের ধারণা, বিএনপি যেন নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশ আসনে বিজয়ী না হতে পারে, সেজন্যই জামায়াত নির্বাচন প্রলম্বিত করতে নানা ধরনের তৎপরতা শুরু করেছে। আর জামায়াত নেতাদের দাবি, বিএনপির সঙ্গে তাদের দূরত্ব বা বিরোধিতার কোনো বিষয় নেই। বরং বিএনপির মতো তারাও তাদের দলীয় কাজ করে চলেছেন।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ বলেন, বিএনপি জনগণের দল। জনগণই বিএনপির মূল শক্তি। বিএনপি প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে জনগণের জন্য আন্দোলন করেছে। তাতে কারও সঙ্গে আপস করেনি।
তিনি বলেন, অতীতে জামায়াতে ইসলামী আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিএনপির বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে। গত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে কিছু বিষয়ে জামায়াতের সঙ্গে আন্দোলনে মতের ঐক্য থাকলেও ভিন্নভাবে আন্দোলন করা হয়। জামায়াতে ইসলামী নির্বাচনে জিততে পারবে না বলেই নির্বাচনকে বানচাল করার জন্য ষড়যন্ত্র করে পিআর পদ্ধতি চাচ্ছে।
জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বাংলানিউজকে বলেন, পতিত স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে বিএনপি-জামায়াত যুগপৎভাবে আন্দোলন করেছে। তবে জুলাই বিপ্লবের সেন্টিমেন্টকে ধারণ করে জামায়েত ইসলামী পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চাইলে বিএনপি তাতে নারাজ। কারণ এই পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে তারা ক্ষমতায় যেতে পারবে না। এ কারণেই তারা জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে।
বিএনপি ও জামায়াতের দূরত্বের বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, দুই দলের দূরত্বের ফলে বাংলাদেশ একটি গোলযোগপূর্ণ পরিস্থিতির দিকে চলে যাচ্ছিল। এখন বিএনপি আর জামায়াতের মধ্যে যদি দূরত্ব কমে আসে, তাহলে সংসদ নির্বাচনও এগিয়ে আসবে। একই সঙ্গে দেশে স্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক গোলাম হাফিজ বাংলানিউজকে বলেন, রাজনীতিতে প্রতিনিয়ত উত্থান-পতন একটি স্বাভাবিক নিয়ম। আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কোনো ধরনের জোট হবে বা হবে না, তার অনেক কিছু নির্ভর করবে সামনে বাংলাদেশের রাজনীতি কোন দিকে যাবে সেই পরিস্থিতির ওপর।
টিএ/আরএইচ/এইচএ