ঢাকা, শনিবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

পাণ্ডুলিপি থেকে রুদ্র আরিফের ১০টি কবিতা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৪৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০১২
পাণ্ডুলিপি থেকে রুদ্র আরিফের ১০টি কবিতা

প্রথম দশকের কবি রুদ্র আরিফ। একুশে বইমেলায় ভাষাচিত্র  থেকে এসেছে তার দ্বিতীয় কবিতার বই ‘র‌্যাম্পমডেলের বাথটাবে অন্ধ কচ্ছপ’।

এছাড়া ঐতিহ্য থেকে এসেছে অনুবাদগ্রন্থ ‘তারকোভস্কির ডায়েরি’। বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো পাণ্ডুলিপি থেকে ১০ টি কবিতা।


২৭ মে ২০১১

রাতের বাঁকে বাঁকে সাপগুলো ছটফট করে খুব, যেন ঈদ ওদের
আমারও কেমন জোনাকি স্বভাব, রাত হলে—
গলির অন্ধকারে খলবল করে দিই ছুট, খেলি লুকোচুরি; তুমি—
ভয় পেয়ে ভীষণ, আগন্তুক হরিণের মতো করো টগবগ, খোঁজো—
খুঁজে অস্থির তবু পাও না দেখা; ফলে,
তোমার চোখের ভেতর থেকে মায়া ও ভয়ের পারদ-
তোমার কপাল থেকে আতঙ্ক ও স্বপ্নের ঘাম-
    গলে পড়ে নিচে,
    ভিজে যায় বুকের গিরিপথ :
আর তাতে বর্ষার নতুন পানি পেলে বাচ্চা ব্যাঙ যেমন তিড়িংবিড়িং দেয় লাফ—
আমিও তেমনি লাফে নাক গুঁজি সেই গিরি-বাগানে, নিই ঘ্রাণ...

এমনি করে উড়ে যেতে যেতে সময় কেমন দাঁড়ালো থমকে হঠাৎ
আমিও গেলাম থেমে; দেখলাম- তোমার মুখ মুহূর্তে হয়ে উঠলো কেমন জাদুর আয়না; তাতে-
জানা হলো আবার : দেখতে হয়েছি আমি। ঠিক তোমার মতো; আমার-
    নাক-চোখ-হাসি ও শরীরের রঙ,
    এমনকি ঘুমকাতরতাও ঠিক তোমারই ফটোকপি যেন...
--এই কথা কেউ বললেই শৈশবে, হয়ে যেতাম আমি লাজুক চড়–ই, দিতাম ঝাঁপ- বুকে তোমার; তুমিও জড়িয়ে ধরে রাখতে ঢেকে আঁচলে আমায়;

মা,
তোমার এ কী বাচ্চাপনা আজ?
কেমনতরো এ শোধবোধ খেলা?
দিলে ঝাঁপ তুমি বুকে আমার-
আর,
আমি কি-না রাখলাম নামিয়ে তোমায়- কবরের খাঁচায়!


আনন্দবাদকের ডায়েরি থেকে

প্রেমিকের সাথে সেলফোনে কথা বলতে বলতে ওয়েবক্যামে যে চ্যাট করছে আমার সঙ্গে, সেই মেয়েটা আমার বন্ধু না। তবু আনন্দ উড়াতে যদি সে ডাকে আমাকে, আমি ছুটবো। যদি সেখানে সাজানো থাকে অসংখ্য মৃত্যুকূপ, যদি সাজানো থাকে কাটাতারবাদকের অসংখ্য রাইফেল-- তবু ছুটবো। যদি এর ফলে লিখে দিতে হয় একমাত্র জীবনের সব জৌলুস- আমি ছুটবো...

পরিব্রাজক হওয়ার স্বপ্নে আমার পৃথিবীর চারপাশে কেবলই জেগে ওঠে শরীর; ফলে, তুমি ও তোমরা তোমাদের সাজানো মনটাকে ফেলে রাখতে পারো পাশে- ছুঁয়ে দেখবো না; তুমি ও তোমরা পবিত্রতার দোহাইয়ের নাচাতে পারো তোমাদের হৃদয়- সালসা, ব্যালে, সাঁওতালি কিংবা মনিপুরি ঢঙে- তবু দেখবো না। আমার চোখ উন্মাদ ঝড়ের রাতে ছোট নৌকায় মহাসমুদ্র পাড়ি দেওয়া রাগি নাবিকের মতো খুঁজে নেবে তুমি ও তোমাদের শরীরের যতো অলিগলি, যতো ঢেউ, যতো কম্পন...!

কেননা, আমি তো জানি, শরীরে ডুবে মরলেই কেবল চির পুনর্জন্মের, চির প্রেমিকত্বের বাহাদুরি সম্ভব


শরীরের কবিতা

আমি তো হেঁটে গেছি শরীরের দিকে, আমি তো জেনে গেছি- শরীরই প্রার্থনালয়...

আমি তো দেখে ফেলি, একবার উড়ে যাওয়ার পর ডানাভাঙা ফড়িং আবার এলো ফিরে ঘরে; কারণ, তার ঠোঁটেও এঁকেছিলাম চুমু, আরও এঁকেছিলাম প্রেমান্ধ গিটারিস্টের অজস্র রাগি কর্ড, রকস্টারের চিৎকারমাখা প্রার্থনা এবং র‌্যাম্পমডেলের নাভীর নিচে লেপ্টে থাকা সাপ-ট্যাট্টুর লকলকে জিহ্বা- লাল...

আমি তো ভেসে গেছি শূন্যতার দিকে, আমি তো দেখে ফেলেছি— দিগন্তের মুখোমুখি হলে মাটি কেমন হয়ে ওঠে নগ্ন উন্মাদ ও ভয়াবহ প্রেমিক


কটেজে অন্ধ ঘুড়ি

এই শহরের ভেতর হঠাৎ নড়েচড়ে ওঠলো বিষণ্ন এক গলি...

গলির প্রান্তে দাঁড়ানো বিড়ালের হাত ধরে
    আমরা পৌঁছে গেলাম দলছুট এক গ্রহের আস্তানায়।
আস্তানার দেয়ালে যতো পোস্টার, যতো ইতস্তত গিটারের তার
    এবং
        সুপারমডেলের গাউন ও ঘাম ঝুলে আছে—
তাতে হাত বুলাতেই ঘটে গেলো এক আজব বিপ্লব : সবগুলো এক হয়ে
    পোষা খরগোশের মতো নাক ঘঁষলো বাহুতে আমার!

এই খরগোশের লোমের তাপ ও আত্মার বুনো ঘ্রাণে নাক ডুবুতেই-
    আরও একটা মায়ার বর্শিতে গেঁথে গেলাম আমি। জেনে গেলাম-

জীবন হলো গোপন মহাসমুদ্র এক :
সেই মহাসমুদ্রের তলে বাগান বানাবো বলে বনফুলের বীজ খুঁজতে খুঁজতে-
        দাঁড়িয়েছি এসে র‌্যাম্পের কিনারায়...

 

 

পিয়ার্সিংয়ের গান

তোমার কালো নাভীর পিয়ার্সিংয়ে ঝুলে থাকা রিং-
            লকলকে লাল জিহ্বা দেখায়-
                    সাপের মতো!
আমি ভয় পাই, একটু, বেশি না; তারপর হাসি...
সাপের ঠোঁটে চুমু খাওয়ার ইচ্ছেটা জেগে ওঠে আবার :

এই মাঝরাতে আমাকে আরও একবার প্রেমিক করে তোলায়,
তোমার প্রতি,
হে র‌্যাম্পমডেল,
আরও একবার ঋণী হয়ে যাই। আর ভাবি-
    আমাদের সন্ধ্যাগুলো কী আজব উদাসীন স্ট্রিটগার্লের মতো
        তাকিয়ে থাকে জ্যামের দিকে;
                আর বুঝি—
    আমাদের রাত্রিগুলো কী উন্মাদ নেচে ওঠে
        আনাড়ি ডিজের আঙুলের ইশারায়।

ভাঁজ খোলার মন্ত্র ভুলে আমরা আরও বুদ হয়ে যাই-
অমাবস্যার চেয়েও অধিক কোনো অন্ধকারের অনন্ত বুদ্বুদে...

পৃথিবী তখন ব্রেকফেইল এক রেলগাড়ি হয়ে ছুটতে থাকে-
                দূর মরুভূমির শরীরের টানে

 http://www.banglanews24.com/images/PhotoGallery/2012February/rudra arif`s -poetry book20120216183140.jpg

 

বিদেশি সৈনিকের কবরের সামনে

অসংখ্য রাত্রির কান্নায় মুছে গেছে নামফলক; তবু-
মা তোমার, মৃত্যুর ওপার থেকে এখনো চেয়ে আছেন বুঝি
                তোমার ফেরার দিকে
ফলে, ধ্রুবতারা পায়নি ছুটি- ঘুমের...
ভাবি, তোমারও কি প্রেমিকা ছিলো রাগি?
তারও কি চোখে করেছে চিকচিক-
ডাইনির মোহনীয় অবিশ্বাস ও শরীরের ভ্রান্ত তাপ?

চাইলেই যায় না ফেরা- সব পথে; তবু, ঘুরে দাঁড়িয়ে আমাদের পোষা কুকুর
    দিয়েছে হাঁটা সমুদ্রের দিকে :
রক্তে তার কচ্ছপের জিন থাকুক বা না-ই থাকুক, দেবে সে সাঁতার--
ঠিক একদিন যাবে পৌঁছে তোমার মামণির কবরের পাশে,
তার উপর ছড়াবে আদিম পৃথিবীর পবিত্রতম মায়াময় কান্না

তোমার গলিত দেহের ঘ্রাণ;
আর
তাতে জন্মাবে এক গাছ।
সেই গাছের ডানায় প্রতি সন্ধ্যায় অসংখ্য পাখির সঙ্গে বসবো আমিও :

দেখবো,
হেঁটে যাওয়া তরুণীর ভেতর তোমার প্রেমিকার অবিশ্বাস ও অপেক্ষার ওম
    কতোটা রাখে ক্ষমতা—
        আমাকে মাতাল করার



ডিজের সঙ্গে, ঘুমে

নির্বাক কোনো সিনেমার চোখ গলে ঝরে পড়া কান্নার শব্দে
তুমি
ফিরছো পাশ; তোমার ঘুমের ঘ্রাণ ছুঁয়ে দিচ্ছে উড়াল—
    অজস্র ফ্লাইংসসার- রঙিন।
আর নাইটির ভাঁজে ঘাপটি মেরে থাকা ঘামের সবুজ ঘ্রাণে
আরও বেশি ঘুম-মাতাল হয়ে ওঠলো আমার আজন্ম পথভোলা বিড়াল।

পার্টি শেষ। ক্লান্ত আমিও। বিছানায় করছি জড়ো কুড়িয়ে—
যতো আহত ডিস্কের ডানা
        ও
        হলুদ আর্তনাদ



 
জাদুকর

এই মাঝরাতে হঠাৎ কোনো এক সমুদ্র ঢুকে গেলো তোমার ঘরে
আর প্রেমিকা আমার, মুহূর্তেই যতো হাঙর ও কুমিরের দাঁড়ালো দাঁত,
তিমি ও ডলফিনের লোভী ঠোঁট গিলে নিলো আমার ঘুমের কারখানা...
সমুদ্রের যতো রাগি যান- সাবমেরিন কিংবা আরও যা যা আছে,
            দেখো কীভাবে আসছে ধেয়ে—
এই মাঝরাতে লুকাবো কোথায় আমি?
নেই কোনো ট্রাফিক পুলিশ জেগে, নেই জ্বলে লাল-নীল-হলুদ জ্যাম
                কী অবাক এই রাতের শহর!
                আমি এলিয়েন!
জ্যাম নেই, নেই ভিক্ষুকের একটানা চিৎকার ও পথঅন্ধ প্রেমিকের কান্না—
যার প্রেমিকা আজ সকালে দিয়েছে ঝাঁপ— মাতাল ট্রেনের নিচে...!
এই মাথানষ্ট শহরের বাঁকে এতো অলিগলি এতো ধূলি ও মায়া পেরিয়ে আমি
                ছুটবো কোথায়...!
কোনো জাদুকর পড়ছে না চোখে, যে মুহূর্তেই রঙিন বেলুন করে
                    উড়াবে আকাশে আমাকে,
কোনো রিক্সাঅলা পড়ছে না চোখে, যে মুহূর্তেই ঘাম বানিয়ে
                    মুছে নেবে গামছায়...

অথচ তুমি কী জাদু শিখে এলে, শিখলেই বা কোথায় : পুরো সমুদ্র ও তার শস্য সব--
মাথা নিচু করে
দাঁড়িয়ে গেলো
তোমার বিছানায়...!

আর তুমি তাদের বাধ্য ছাত্র বানিয়ে রূপকথা শুনতে শুনতে শুয়ে পড়লে পাশে
 
 

ড্যান্সফ্লোরে আগন্তুক

ঘুম ঘুম অমাবস্যার ঠিক মাঝরাতে
অন্ধ সাগরের বুকে জেগে ওঠা নতুন চরে
        তোমাদের যখন পার্টি—
আমি কুমিরের পোশাক পরে উঠে গেছি রোদ পোহাতে;
তুমি ও তোমার বন্ধুরা নাচছো উদ্দাম
ডানা, ভাঁজ ও ঘাম থেকে আনন্দের বদলে পড়ছে খসে--
        বিষাদের ক্লান্ত মুদ্রা

বুঝি,
সমুদ্রের সব পানি মদ এখন :

যদি ১০০ কোটি চুমু দাও, ছেড়ে দেবো মদের নেশা
হয়ে যাবো জ্ঞানী বটগাছ :
আর
বসন্ত-সন্ধ্যায় শোনাবো অসংখ্য সানাইবাদকের ঝিরিঝিরি স্বপ্নগান


আমি, কবিতা ও কুকুর

আমি ও আমার কবিতা মাঝেমধ্যেই মৃতদের ভান করি।
তারপর গলা ধরাধরি করে শুয়ে থাকি গলির অন্ধকারে।
পাশ দিয়ে যেতে যেতে উঠতি নেশাখোর—
আস্তে করে ছিড়ে নিয়ে আমাদের আঙুল ও ডানা,
        চোখ ও অক্ষর... আরও কতো কী!

একটা কুকুর এসে পা দু’টো বাড়িয়ে দেয় সামনে
নতজানু হয়ে তাকিয়ে থাকে আমাদের হৃদয়ের দিকে।
আমরা হেসে উঠি তখন; বলি, ‘শহরে নতুন নাকি হে গর্দভ?’

 

বাংলাদেশ সময় ১৭২২, ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।