ঢাকা, শনিবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

সূর্যেরা

ফকরুল চৌধুরী | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮০০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৫, ২০১২
সূর্যেরা

http://www.banglanews24.com/images/PhotoGallery/2012January/galpo 120120115180126.jpgযেন পুকুরের ভেতর থেকে উঠে এসেছে সবুজ। ঢাল বেয়ে লতাগুল্ম, ঝোপঝাড়।

আল ধরে সবুজ রঙ ফুঁড়ে উত্থিত বৃক্ষ। বৃক্ষের মাথায় ঝাঁকড়া সবুজ চুল। আছে বাঁশঝাড়, আম গাছই বেশি, একই আকৃতির, সমবয়সী, গাঢ় সবুজ। কড়ই গাছ আরো বড়, হালকা সবুজ। একপাশে কিছুটা ফাঁকা, নিঃসঙ্গ একটি গাছ; প্রায় পত্রবিহীন, পলাশ। পলাশের মাথা ঝাঁকড়া লাল।

পলাশ বৃক্ষের নিচে এক যুবক বসে আছে। অবিচল, সাবলীল। অদূরে বাঁশঝাড়ে লাল সূর্য লটকে আছে, ঝিকিমিকি আলো, আগুন অথবা দ্রবীভূত সোনা কিংবা মানুষের রক্ত। যুবকের চারপাশে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত পলাশফুল, লাল আগুনে বিছানায় একজন দগ্ধ মানুষ। যখন সূর্যটা ছিল তার মাথা বরাবর, তখন সে বসেছিল; এখন ক্লান্ত সূর্য বাড়িমুখো। যুবক দেখছে সূর্যও একসময় ঘরমুখী হয়। যুবক হাসে, রহস্যময়।

যুবক ভাবলেশহীন, পলাশ বৃক্ষে লেপ্টে আছে। যেন টেরাকোটা কিংবা অজন্তা পাহাড়-শরীরের নকশা, কিংবা হাজার বছরের বিবর্তীত ফসিল। প্রকৃতির অর্কেস্ট্রা শুরু, সব পাখি ঘরে ফেরে, নীড়ে ফেরা পাখিরা কোলাহোল শুরু করে, নাচন বাড়ে। কিন্তু যুবক সাবলীল, অনড়--- সূর্য দেখছে। লাল-কুসুম সূর্যের গোলকে মানুষ, ছেলে মানুষ, মেয়ে মানুষ ছবি হয়ে আছে। মানুষ নড়ে না, কথা বলে না। মানুষগুলো লাল, সারা শরীরে ক্ষত চিহ্ন, রক্ত চুঁইয়ে পড়ছে। এই যুবক এবং সূর্যের ছেলে ও মেয়ে মানুষ নিয়ে একটি গল্প আছে, সত্য গল্প।

তখন দেশের হৃৎপিণ্ডে শত্রুরা তেল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দিল। তাতে দেশময় মানুষ পুড়তে লাগল। অনেক মানুষ পুড়ে কয়লা হয়ে গেল। প্রচণ্ড দ্রোহের চাপে কয়লা-মানুষ হীরে হলো। এই সব মহামূল্যবান হীরে প্রতিরোধ গড়ে তুলল। শুরু হল যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা। বারোশ মাইল দূর থেকে আসা শত্রুসেনারা ছিল মহাপরাক্রমশালী, তারা দেশের সবুজ বৃক্ষ, সবুজ মানুষ ধ্বংস করতে লাগল। কিন্তু এদেশে সবুজ বৃক্ষের আত্মীয় ছিল লাল টুকটুকে পলাশ, আর মানুষের রক্ত ছিল বিশুদ্ধ লাল। তাই প্রতি ফোটা ঝরে পড়া রক্ত থেকে জন্ম নিল অসংখ্য সাহসী মানুষ।

...একটি বাড়ি ছিল, বাড়ির সামনে উঠোন, পেছনে মস্ত বড় দীঘি, সবুজ বৃক্ষাদি আর ভালোবাসা। সে সময় বাড়িতে মাত্র তিনজন... বৃদ্ধ, যুবতিকন্যা আর কন্যার সদ্য প্রসূত সন্তান। তখন এলো বারশ মাইল দূরের শকুনেরা, তাদের বড্ড ক্ষিধা, খাদ্য চাই। বাড়িতে কোনো যুবক ছিল না, যুবকেরা বাড়ি করেছে যুদ্ধের মাঠে। হানাদার শকুনের খাদ্য ভয়াবহ--- যুবতিকন্যা। বৃদ্ধের কপালের ভাঁজ বেড়ে গেল, শরীর নুইয়ে পড়ল। চোখে পানি ঝরল। কিন্তু শকুনেরা দয়াদ্র হল না, তাদের খাদ্য চাই। ... পিতার কপালের ভাঁজ বুজে গেল। শরীর টানটান হল, চোখের জল উবে গেল। শকুনেরা খুশি হলো।

দৃঢ় পায়ে পিতা ভিতরের ঘরে গেলেন। শিশুকন্যার কান্না হল। শকুনেরা মহাখুশি। তৈরি খাদ্যের মৌ মৌ গন্ধে লালায়িত। তাদের অর্থপূর্ণ চোখাচোখি হয়। নিজেদের মধ্যে প্রাক চাটাচাটি চর্চা করে। একটু পরেই খাদ্য আসবে, প্লেটে সাজানো থাকবে ঘিয়ে ভাজা মচমচে শরীর, তিড়িং তিড়িং দেহ প্রতিবাদ করবে, কিন্তু শক্ত হাতের পেষনিতে হার মানবে।

... প্রচণ্ড শব্দ, একটি গুলির শব্দ। তারপর ভেতর থেকে বৃদ্ধ বেরিয়ে এলো, আঠারো বছরের যুবক হয়ে। বলল--  যাও। শকুনেরা গেল ভেতরের ঘরে, দেখল খাদ্যের কপালে ফুটো, রক্তের প্রবাহ, পাশে স্থির নিশ্চুপ এক শিশু। শকুনেরা তখন পিতাকে শাস্তি দিল, খাদ্য বিনষ্টের দায়ে, বাঁশঝাড়ে এনে বেয়নটে কুচি কুচি করে খুন করলো। পরদিন সকালে খুনের রক্ত থেকে সূর্য উঠল এবং এখনো ওঠে প্রতিদিন।

সে দিনের সে শিশুটি আজকের এই টেরাকোটা যুবক--- দেখছে খুন থেকে উঠে আসা সূর্য, একজন শ্রদ্ধাভাজন খুনি এবং মানচিত্রের সবুজের মা।

বাংলাদেশ সময় ১৭১৫, জানুয়ারি ১৫, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।