ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

ফকির ইলিয়াসের দুটি কবিতা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪২৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৪, ২০১২
ফকির ইলিয়াসের দুটি কবিতা

 প্রিয় জেনারেল
------------
প্রথাগত সুন্দর আর আকাশের বেগুনী মলাট ছিঁড়ে উড়ে যাচ্ছে
একটুকরো মেঘ। উড়ে যাচ্ছে পূর্বে।

পশ্চিমের সকল পুঁজি বহন
করে যে ভিক্ষুক রাস্তায় নেমেছিল, সেও চেয়ে দেখছে তার পায়ের

 

নিচের মাটি সরে যাচ্ছে ক্রমশ। `আরও রক্ত চাই`- এমন হুঙ্কার শুনে হেসে উঠছে শিশুরা।
যারা আকাশে ঘুড়ি ওড়াবার জন্য মাঠে নেমেছিল, তারাও
ভাঙা নাটাই হাতে নিয়ে, ফিরছে ঘরে। পেরেক বিষয়ক প্রবন্ধ
লিখার জন্য কিছু তথ্য সংগ্রহে গুগল সার্চ সেরে নিচ্ছে ঘরবন্দী
পিতাদের দল।

 

বন্দীত্ব মানুষের আজন্ম নিয়তি ! এই তথ্যগুলো সামনে ভেসে
ওঠার সাথে সাথে কেউ কেউ সারমর্মগুলোর প্রিন্টও নিতে চাইছে
কালো কাগজে। শাদা দুঃখগুলো নির্বাসিত হবার পর এই নগরে
আর কেউ সফেদ কাগজে কলম ঘঁষে না। শিল্পীরাও কালির বদলে
ব্যবহার করেন তাজা রক্তের ফোঁটা।

 

রাতগুলো দীর্ঘ ছিল এই নগরের। আর দিনগুলো, বোমা এবং
বৈধব্যের স্থিরচিত্র ধারণ করে ক্রমশঃই লিখে যাচ্ছিল দাসত্বের ইতিহাস।

 

`আজ এই দাসপ্রথার প্রথম পর্বের সমাপ্তি হবে`। একজন জেনারেল
সগর্বে এই ঘোষণাটি দেবার পর, বাগদাদের মরুভূমি থেকে
ছুটে আসেন একজন বেদুঈন।

 

`আপনি সত্যি চলে যাচ্ছেন প্রিয় জেনারেল !
সত্যিই নামিয়ে নিচ্ছেন আপনাদের লাল নীল পতাকা !
আমাদের বিদীর্ণ আকাশ থেকে সত্যি খসে পড়ছে
আপনাদের পঞ্চাশটি তারকা ! `

 

বলতে বলতে দু’হাত তুলে দাঁড়ান বৃদ্ধ বেদুঈন।
আপনাকে আমি খুব ভালোবাসি প্রিয় জেনারেল !
খুব ভালোবাসি আপনার হাতের আগ্নেয়াস্ত্র ! কারণ এই
অস্ত্রই আমাকে পিতৃহীন করেছে। আমাকে করেছে ভিটেসূত্রহীন।
হারানোর বেদনা আমার পাঁজরে জমিয়েছে অজস্র পলিকণা। উর্বর
হতে হতে আমি জেনে গেছি যুদ্ধই জীবনের পরিণত পরিণাম।

 

আপনি চলে যাচ্ছেন প্রিয় জেনারেল! সাথে নিয়ে যাচ্ছেন আপনার
রক্তাক্ত চোখ। যে চোখে জমে আছে অগণিত নবজাতের রক্ত।
একটি মানব ভ্রূণ ধারণ করার চার সপ্তাহ পর আপনাদের বোমার
আঘাতে আবু গারিব শহরের উপকূলে ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল যে
তরুণী, জানি তার রক্তের দাগও লেগেছিল আপনার উর্দিতে।
সুখ্যাতি(!)র স্টারগুলো সামলাতে সামলাতে আপনি শুধুই বলেছিলেন-
` উই উইল উইন দ্যা ওয়ার `।

 

নিরীহদের হত্যা করতে করতে হায়েনারা এভাবেই যুদ্ধ জয় করে,
প্রিয় জেনারেল ! এভাবেই বনেদি বেনিয়ারা আমাদের চারপাশে
সেরে নেয় রক্ত এবং তেলের মিশ্রণ। খনিজ সম্পদে চোখ বুলাতে
বুলাতে ভ্রমণ করে লক্ষ মরুমাইল। কখনও গোপন মাইন পোঁতে
সনাক্ত করে সম্পদের উৎস।
`বোমার বিনিময়ে বানিজ্য চাই `- এমন মিশন সেরে আপনি সত্যি
চলে যাচ্ছেন প্রিয় জেনারেল ! ৩১ ডিসেম্বর ২০১১ এর আগেই
আরেকটি কারবালার হাহাকার তৈরি করে সদলবলে আপনি
চলে যাচ্ছেন। রেখে যাচ্ছেন আমাদের জন্য গণতন্ত্রের ধনুক।
তীরটা সাথে করেই নিয়ে যাচ্ছেন। যাতে প্রয়োজনে আবার কাজে
লাগাতে পারেন।

 

চতুর শিকারীরা এভাবেই, ভিন্ন জনপদে রেখে যায় তাদের গৃহপোষা
ঈগল। কখনও রেখে যায় বিষধর সাপও। নির্দেশ পেলেই যাতে নগরে
মনুষ্যকূলকে ছোবল দিতে পারে।

 

আমার খুব কষ্ট হচ্ছে প্রিয় জেনারেল ! আপনি এই নগর ছেড়ে চলে
যাচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু আপনাদের রক্তদৃষ্টি, বজ্রবৃষ্টির মতোই দখল করতে
চাইবে নতুন কোনো জনপদ। আপনার সাবমেরিন খুঁজতে চাইবে নতুন
কোনো গন্তব্য। একদিন পেন্টাগনের কপাট ছুঁয়ে আপনি যে শপথ
নিয়েছিলেন, তা ছিল মানবতা রক্ষার অঙ্গীকার। অথচ আমরা দেখলাম,
ভোগের কাছেই পরাজিত হলো রক্তাক্ত মানবতা। ছটফট করতে করতেই
মৃত্যুবরণ করলো ডানাহীন অসংখ্য পাখি।
বিষণ্ন নির্জনতা জাগিয়ে দিয়ে আপনি চলে যাচ্ছেন, প্রিয় জেনারেল !
মাঝে মাঝে এভাবেই চলে যেতে হয়। নামিয়ে নিতে হয় দখলের পতাকা।
এই মরুরৌদ্রে বসে আমার উত্তরসূরিরা নিশ্চয়ই একদিন পরখ করবে
অতীতের লগ্নকাল। সবগুলো চন্দ্রগ্রাস অস্বীকার করে তারা লিখবে
নতুন ইতিহাস। যে ইতিহাস সাক্ষ্য দেবে, গোটা বিশ্ব থেকেই কীভাবে
সরে যাবে তিনরঙা রাহুগ্রহ। কীভাবে নেমে যাবে শোষণের উড্ডীন পতাকা।

 

প্রিয় জেনারেল, আপনি আমাদেরকে ঘুরে দাঁড়াতে শিখিয়েছেন। এই
মরুমাটিতে, আপনার পদধূলি না পড়লে আমাদের কোনোদিনই চেনা হতো না,
বিদগ্ধ যুদ্ধের এইসব বিপরীত সম্মোহন। কিছু মুখোশের অভিন্ন ছলাকলা।

 


নদীদের জবানবন্দী
---------------
`এখন আমাদের আর কোনো গন্তব্য নেই। স্থবির জীবনের সাথে মিশে আছে
আমাদের আয়ু। স্রোত, সে তো আজ আমাদের স্বপ্নের অতীত। `
অশ্রুসিক্ত চোখ মোছে এভাবেই এজলাসে দাঁড়ায় আমাদের পরিচিত নদী।
বিচারকের আসনে বসে আছেন যে মাননীয় বৃক্ষ, হাই তুলে তিনি আবারও তাকান
শীর্ণ নদীটির পানে। তারপর ভারী কন্ঠে বলেন, `বলো ... বলে যাও। `

 

`কোথা থেকে এসেছিলাম তা আজ আর মনে নেই , জনাব। তবে শুনেছি
উত্তর থেকে এসেছিলেন আমাদের আদিপিতা। বলেছিলেন, দক্ষিণেই যাবো। ভাসিয়ে
নিতে চাই সকল জরা,ব্যাধি আর মানবিক দীনতা।
রেখে যেতে চাই, শুশ্রূষার নিশান। উড়াতে উড়াতে একদিন মানুষই দাঁড়াবে
সকল স্রোতের সপক্ষে। `

 

বলতে বলতে একটু জিরিয়ে নেয় নদী। তারপর আবার বলতে শুরু করে -----

 

` আমরা এর আগেও আঘাতের শিকার হয়েছি, মাননীয় বিচারক। একটি প্রেতাত্মার
ছায়া কেড়ে নিতে চেয়েছে আমাদের কল কল ধ্বনি। যে ভাষায় আমার সন্তানেরা
জুড়ে দিত কান্নার কোলাহল,অথবা যে শব্দানন্দে আমরা বরণ করতাম
নবীন বসন্তকে, ওরা কেড়ে নিতে চেয়েছিল সেই ভাষার বৈভব।
আমরা এর প্রতিবাদ করলাম। বৈশাখী তুফানের শক্তি ধারণ করে
আমরা ভাসিয়ে দিলাম ছাপান্ন হাজার বর্গমাইল। আমাদের পাশে
এসে দাঁড়ালো অগণিত মানুষ। মিছিল হলো। ঘাতক রাজশক্তির
বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে গেল আমাদের প্রতিবেশী বন্ধুদের মুখ।

 

তারপর,--- তারপর----, আমরা সগর্বে প্রতিষ্ঠা করলাম মাতৃভাষায়
আমাদের জোয়ারের ধ্বনি।

 

হায়েনারা এরপর আরও শক্তি নিয়ে আমাদের উপর হামলে পড়লো।
বৃষ্টি, আমাদের প্রিয় ছোটবোন দুঃখ বুকে নিয়ে সারারাত কাঁদলো
আমাদের মায়ের গলায় জড়িয়ে।
যমুনা,মেঘনা, সুরমা,শীতলক্ষা - আমাদের সহোদরা সবাই,
স্পষ্ট জানিয়ে দিল বুড়ীগঙ্গা মা কে, ওরা যুদ্ধে যাবে।
গর্জে উঠলো এই বদ্বীপ। পলিশূন্য মাটি উত্তপ্ত হয়ে গেল গোলার আওয়াজে।

 

শকুন আর অজগরের উদ্যত ফণা রুখে দিতে আমরা মেতে উঠলাম
বর্ষা উৎসবে।
আমাদের বুকের জল, রক্তজবার রঙ ধারণ করে বয়ে গেল দূরের উজানে।
শিশুরা মাতৃদুগ্ধ পান ভুলে গিয়ে পান করলো মেশিন গানের বিষাক্ত কার্বন।

 

অবশেষে তিরিশ লক্ষ প্রাণস্মৃতি আর শত শত বিবর্ণ নদীর ছায়া বয়ে
জন্ম নিল আমাদের মানচিত্র। স্বাধীন পাঁজরস্তম্ভ।
এরপর থেকে আমরা আছি, এইতো আছি।

 

ভালো আছি, সেকথা ঠিক বলা যাবে না মাননীয় বিচারক।
প্রতিদিন ধর্ষনের যাতনা নিয়ে ভরাট হচ্ছে আমাদের বুক। দখল হয়ে যাচ্ছে,
আমাদের চর। দলবদল করে লাঠিয়াল বাহিনী হরণ করে নিচ্ছে
এই মাটিসূত্র।

 

আমরা সুবিচার চাই মাননীয় বিচারক। বেঁচে থাকার স্বাধীনতা চাই।
চাই প্রবাহের অবাধ বিচরণ।
জানি, মাটি থেকে নদীদের বাঁক মুছে গেলে, কবিরাই প্রধানতঃ আহত হবেন।
আর কবিতা,
ধারণ করতে ভুলে যাবে জোয়ারের সর্বশ্রেষ্ঠ কলা।  

 

বাংলাদেশ সময় ১৪০০, জানুয়ারি ২০১২



বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।