ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

কালিদাস কর্মকার: ‘অ্যা ডিকশনারি অব আইডিয়া’

ফিচার রিপোর্টার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২০৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩০, ২০১৯
কালিদাস কর্মকার: ‘অ্যা ডিকশনারি অব আইডিয়া’

ঢাকা: শিল্পের ভুবনের অনন্য প্রতিভা তিনি। অল্পসময়ে ছবি আঁকার ক্ষেত্রে যেমন তার জুড়ি মেলা ভার, ঠিক তেমনি শিল্প নিয়ে নতুন নতুন আইডিয়ার যেন আঁতুর ঘর তিনি। পৃথিবীর যে প্রান্তে পা রেখেছেন, রংতুলির ছোঁয়ায় সেখানেই তুলে ধরেছেন নিজের দেশ, মানবিকতা ও বাংলা সংস্কৃতিকে। আর বাংলাকে পরম মমতায় বিশ্বময় তুলে ধরতে চাওয়া এই মানুষটি চিত্রশিল্পী কালীদাস কর্মকার।

সম্প্রতি শিল্পরসিকদের শোকের সাগরে ভাসিয়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন এই শিল্পী। কিন্তু তার শিল্পকর্মের মধ্য দিয়ে এদেশের মানুষের মাঝে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন এই গুণীজন।

শিল্পী কালিদাস কর্মকারকে নিয়ে এমন মূল্যায়নই তার বন্ধু, সুহৃদ ও স্বজনদের।

মঙ্গলবার (২৯ অক্টোবর) বিকেলে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে ও বাংলাদেশ চারুশিল্পী সংসদের সহযোগিতায় একাডেমির চিত্রশালা মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয় স্মরণানুষ্ঠান। এতে কালিদাস কর্মকারের জীবন ও কর্ম নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি তাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেন বরেণ্যজনেরা।

শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে শিল্পী কালিদাস কর্মকারকে নিয়ে কথা বলেন বরেণ্য শিল্পী হাশেম খান, নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার, পাখি বিশেষজ্ঞ ও আলোচিত্রী এনাম আল হক, কীরিটি রঞ্জন বিশ্বাস, শিল্পকলা একাডেমির চারুকলা বিভাগের পরিচালক আশরাফুল আলম পপলু, চারুশিল্পী সংসদের পক্ষে শিল্পী জাহিদ মুস্তফা, কসমস গ্যালারির পক্ষে সৌরভ চৌধুরী, সাবেক পররাষ্ট্র বিষয়ক সচিব ওয়ালিউর রহমান, শিল্পী নাজিয়া আন্দালিব প্রেমা প্রমুখ। পরিবারে পক্ষে স্মৃতিচারণ করেন মেয়ে কঙ্কা কর্মকার ও ভাই দীলিপ কর্মকার। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন বিশিষ্ট শিল্প সমালোচক মঈনুদ্দীন খালেদ।

অনুষ্ঠানের শুরুতেই একুশে পদকপ্রাপ্ত শিল্পী কালিদাসের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।

পরিবারে পক্ষে স্মৃতিচারণ করে শিল্পীর মেয়ে কঙ্কা কর্মকার বলেন, একজন শিল্পী ছাড়াও তিনি ছিলেন আমাদের মা এবং বাবা। ৪ বছর বয়সে মায়ের মৃত্যুর পর বাবাই আমাদের সব। নিজের কাজের জন্য দেশে-দেশে ঘুরতে হতো বলে বাবা আমাদের একটা বোডিং স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। সেখানে বাবা প্রতি মাসে আমাদের দেখতে যেতেন, দু’বার চিঠি লিখতেন। তিনি আমাদের সবাইকে এতো ভালোবাসতেন যে, তিনি শুধু আমার বাবা না, স্কুলের ১২’শ মেয়ের ‘বাবু’ হয়ে গিয়েছিলেন।

তিনি বলেন, শুধু শিল্প নয়, রান্না বা ঘর পরিষ্কারের মতো প্রতিটি কাজেই বাবা আর্ট খুঁজতেন। তিনি একটা কথা বারবার বলতেন, খুঁজে দেখ প্রতিটি জিনিসের মধ্যেই একটা আর্ট আছে। সমুদ্রের ধারে ঘুরতে গেলে বালি, পাথর, পায়ের ছাপ, ভাঙা টাইলসের ছবি তুলে এনে ফেসবুকে পোস্ট দিতেন আর বলতেন, আর্ট ইজ এভরি হয়্যার! তিনি সারাজীবন বাংলাদেশের শিল্পকে সারাবিশ্বের কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করে গেছেন।

শিল্পী হাশেম খান বলেন, আমার শিক্ষকতার প্রথম ব্যাচের ছাত্র ছিল কালিদাস কর্মকার। ছাত্রজীবন থেকেই নিজে শিখেছেন এবং শিক্ষকসহ অন্যান্য সবাইকে নানান বিষয়ে শিখিয়েছেন। সেই শুরু থেকে শেষ অবধি বাংলাদেশের শিল্পকে এগিয়ে নিতে তিনি আমৃত্যু কাজ করে গেছেন। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর যে বিষয়টি, তাকে একটি সার্থক অর্থ দিয়েছেন এই শিল্পী। তার শিল্পকর্মে, কাজে সব জায়গাতেই একটি আলাদা নিষ্ঠার আভাস পাওয়া যায়।

রামেন্দু মজুমদার বলেন, ড্রয়িংয়ে অসাধারণ ছিলেন কালিদাস কর্মকার। তার কাজের মাধ্যম ছিল নানারকম। গ্রামীণ, লোকজ, ধর্মীয় বিভিন্ন উপাদান একত্রিত করে নতুন কিছুর সৃষ্টি করতেন তিনি। কোথাও স্থির না হওয়া এই অস্থির চরিত্রের মানুষটির আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ছিল অত্যন্ত ভাল, যা অন্য শিল্পীদের অনেক কম। একইসঙ্গে তিনি মানুষকে আপন করে নিতে পারতেন খুব সহজে।

অন্যান্য বক্তারা বলেন, কালিদাসের শিল্পকর্ম শুধু গুণগ্রাহীই ছিল না, হৃদয়গ্রাহীও ছিল। খুব কম সময়ে তিনি যেকোনো শিল্পকর্মকে প্রাণবন্ত করে তুলতে পারতেন। তার হাত দিয়ে বারবার উঠে এসেছে এদেশের লোকজ ঐতিহ্য। পৃথিবীর যেখানেই যেতেন নিজের দেশকে সবার আগে প্রাধান্য দিতেন। তার শিল্পকর্মেও সেসবের ছোঁয়া পাওয়া যায়। শিল্পীদের নাচ, গান, আবৃত্তি, অভিনয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তিনি ছবি আঁকতেন। ব্রাশ ছাড়া শিল্পকর্ম আঁকতেন হাত অথবা পেন্সিলের মাধ্যমে। বলা চলে এদেশের ইন্সটলেশন ও পারফরমেন্স আর্টের পথিকৃতও কালিদাস কর্মকার। সবসময় চেয়েছেন দেশে একটা ন্যাশনাল আর্ট গ্যালারি প্রতিষ্ঠিত হোক।

সভাপতির বক্তব্যে লিয়াকত আলী লাকী বলেন, শিল্পী কালিদাস কর্মকারকে এক কথায় প্রকাশ করতে গেলে বলতে হয়, ‘হি ইজ এ ডিকশনারী অব আইডিয়াস’। যেকোনো শিল্পকে সহজভাবে দেখা, তাকে বোঝা, আহরণ এবং উপস্থাপনে অনন্য নজির ছিলেন তিনি। তার কাজের আলাদা গতি ছিল, যা সব শিল্পীর থাকে না। এশিয়ান আর্ট বিয়েনালে পারফরমেন্স আর্টে তার নামে যেন একটি নতুন পুরস্কার প্রবর্তন করা যায়, সে ব্যাপারে আমরা চেষ্টা করবো। আর তার সৃষ্টির কারণেই এদেশের মানুষের মাঝে তিনি যুগের পর যুগ স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

বাংলাদেশ সময়: ০৮০৮ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৯, ২০১৯
এইচএমএস/এসএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।