ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

গৌরী

মূল : রাজা রাও, অনুবাদ : রাহাদ আবির | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৪৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ২১, ২০১১
গৌরী

http://www.banglanews24.com/images/PhotoGallery/2011November/galpo 120111121135429.jpg

তারা তাকে গৌরী ডাকত। সে প্রতি মঙ্গলবার সূর্য ডোবার আগে আগে এসে গুরুর কাছে দাঁড়াত আর তার চুল মুখ দিয়ে মৃদু মৃদু টানত।

গুরু তার গায়ে হাত দিয়ে আদর করে বলতেন, কেমন আছিস গৌরী? উত্তরে গৌরী প্রথমে পা ভেঙে জিহ্বা ভিতরে নিয়ে মাথা ঝাঁকায়। তারপর গুরুর চারপাশে একটা চক্কর ঘুরে দ্রুত কোনো ঝোঁপের ভেতর লুকিয়ে যায়। এবং দেখা যায় এর পরের মঙ্গলবার পর্যন্ত গৌরীর আর কোনো খোঁজ নেই। গুরুর শিষ্যরা মঙ্গলবার হলেই গৌরীর জন্য খড়, ঘাস ও ভাতের মাড় যোগাড় করে রাখত। গৌরী কিন্তু কিছুই ছুঁত না, কেবল গুরুর হাত থেকে দুটো খড় খেত। সে ধীরে ধীরে খড়টুকু সতর্কভাবে চাবাত যেন মুখ থেকে পবিত্র শব্দ বের করছে। খাওয়া শেষ হলেই ফের হাঁটু গেড়ে বসে মাথা ঝাঁকিয়ে অদৃশ্য হয়ে যেত।

গুরুর শিষ্যরা বলাবলি করত, কী আজব প্রাণী! তারা তাকে তুলাগাছের ঝোঁপে, আমগাছের ঝোঁপে এমনকি তাঁতিদের লাইন দিয়ে গিয়ে তুলার মিলগুলোতে খুঁজেও তার টিকিটি পেত না। সে কিন্তু খোদাই-ষাঁড় ছিল না। কোনো দোকানদারও বলতে পারবে না সে কখনও তাদের বাটখারা খেতে চেষ্টা করেছে। গৌরীকে কখনো কোনো গো-মহিষের পালেও দেখা যেত না। লোকজন বলত, গুরুর কাছেই কেবল গরুটা যায়। তারা গুরুর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, গুরু, আপনি বলবেন এই গরুটা আসলে কে? গুরু মুচকি হেসে স্নেহের সাথে মজা করে বলতেন, মনে হয় ও আমার শ্বাশুড়ি কালী-মা। হতে পারে তোমাদের মধ্যেও কারোর মা। এমনও হতে পারে ও দেবী মায়ের বাহন। আর লোকজন দেবী মা মনে করেই গৌরীর কপালে সিঁদুর পরিয়ে দিত এবং সামনের মঙ্গলবার পর্যন্ত অপেক্ষা করত।

গৌরীর কথা দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল। দূর-দূরান্তের লোকেরা খড় নিয়ে, লালপদ্মের জল নিয়ে আসত। বলত, আমাদের অলৌকিক দর্শনার্থী আসবে, তাকে বরণ করতে হবে। ব্যবসায়ীরা এসে বলত, মনে হয় ও লক্ষ্মী, এইবার ভাল ফসল হবে--  আমাদের হাতে টাকা-পয়সা আসবে। বলে গৌরীর পায়ে পড়ত। ছাত্রছাত্রীরা এসে তার মাথা ও লেজ স্পর্শ করে বলত, আমার এই বছরের পরীক্ষাটা পাশ করিয়ে দাও। যুবতী মেয়েরা জানতে আসত, তাদের স্বামীদের বিষয়ে, আর বিধবারা তাদের দেহের পবিত্রতা নিয়ে এবং বন্ধ্যা মেয়েরা সন্তান লাভের আশায়। এভাবে প্রতি মঙ্গলবার গুরুর আশ্রমে নানা জাতের লোকজনের ভিড় লেগে যেত। কিন্তু গৌরী সবাইকে পাশ কাটিয়ে সোজা গুরুর কাছে চলে যেত যেভাবে কোনও সত্যবতী স্ত্রী পুরুষদের মধ্যে দিয়ে নিঃসংকোচে এগিয়ে যায়। গৌরী গুরুর জটার কাছে মুখ এগিয়ে দিত এবং একটু পরই ঝোঁপের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যেত। লোকেরা দানের জন্য নিয়ে আসা জিনিসগুলোকে শেষপর্যন্ত বাধ্য হয়ে নদীতে ফেলে দিত। আর মাছেদের মধ্যে সেই খাবার খাওয়ার জন্য উৎসব পড়ে যেত। আর কুমির তো গভীর জল থেকেও ততদিনে বিদায় নিয়েছে। এক সকালে গুরুর ঘুম ভেঙে গেল। তার খাটিয়ার নিচে সাপ ও ইঁদুর খেলা করছে। শিকারি শিকারের সাথে মজা পেলেই এমন কা- হতে পারে। যেমন শিয়াল ও হরিণ, ইঁদুর ও সাপ পরস্পর বন্ধু হতে পারে। গৌরী বোধ হয় পরজনমে কোনো জ্ঞানী ব্যক্তি হয়ে জন্মাবে। গুরু ছাড়া আর একজনের চুলই সে টানত-- মহাত্মার। যেহেতু মহাত্মা সকল জীবকেই ভালোবাসতেন-- বোবা হোক আর সবাক হোক।

মহাত্মার অনুসারীরা এই সময় দেশে বৃটিশ সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। মহাত্মা বললেন, ওদের তৈরি কাপড় কিনবে না। লোকজন ওদের তৈরি কাপড় কেনা ছেড়ে দিল। মহাত্মা বললেন, ওদের অধীনে কাজ করো না। লোকজনও ওদের অধীনে কাজ ছাড়তে লাগল। মহাত্মা বললেন, ওদেরকে কর দেবে না। লোকজন কর দেয়া বন্ধ করল। লোকজন তারপর দলে দলে একত্রিত হয়ে মিছিল করে, রাস্তায় অগ্নিকু- জ্বালায়। ফলাফল--  অনেক লোক হতাহত হয়, মারা যায় এবং কারাবন্দি হয়। কিন্তু তারপরও লোকজন কর দেয় না বা বিদেশি কাপড় পরে না। এরপর সৈন্যরা রাইফেল নিয়ে শহরগুলোতে আসতে লাগল--  বিশাল দেহ একেক জনের, কারো কারো মুখে দাড়িও। তারা কোথাও কোথাও গিয়ে আদেশ ছুড়ল, তোমরা সন্ধ্যার পর বাড়ি থেকে বেরুবে না। কাউকে নির্দেশ দিল, তোমরা কেউ সাইকেল চালাতে পারবে না। আবার কারো ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করল, তোমরা জেলা শহরের বাইরে যেতে পারবে না। মহিলারা মন্দিরে যেতে পারল না, বিয়ের অনুষ্ঠানে তো না-ই। পুরুষরা সকালে নদীর পাড়ে হাঁটতে বেরুতে পারত না। জীবন অসহ্য হয়ে উঠল, লোকজনের দীর্ঘশ্বাস আর হা হুতাশ করা ছাড়া করার কিছু রইল না। কারণ যাই ঘটুক না কেন, বৃটিশ সরকার ভারতবর্ষ শাসন করবেই, আর জনগণকেও বেশি বেশি কর দিতে বাধ্য করবে।

http://www.banglanews24.com/images/PhotoGallery/2011November/bull20111121134254.jpgকল-কারখানার শ্রমিক-কর্মচারীরাও একসময় সাধারণ জনগণের সাথে সুর মেলাল। পুরুষরা বলল, ভাইগণ আমরা আপনাদের সঙ্গে আছি। মহিলারাও বলল, বোনেরা আমরা আপনাদের সাথে আছি। এইভাবে পুরো শহর রণাঙ্গনে পরিণত হলো। সৈন্যরা যখন রাস্তায় বেরুত শ্রমিকরা রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেডের পর ব্যারিকেড তৈরি করত। পাথর, বাঁশ, ঘোড়ার গাড়ি, ধানের গোলা--  কী ব্যবহার হত না ব্যারিকেড তৈরিতে। সৈন্যদের সাধ্য ছিল না ওসব পেরিয়ে এগিয়ে যায়। গুরু তখন বেরিয়ে এলেন, বললেন, মহাত্মার নামে আর কোন ব্যারিকেড দেয়া চলবে না, নাহলে অনেক রক্তপাত হবে। শ্রমিকরা বলল, গুরু আমরা আপনাকে প্রাণের চেয়ে ভালোবাসি, কিন্তু এভাবে তো আপনি বৃটিশদের অত্যাচারী মনোভাব বদলাতে পারবেন না। তারা একের পর এক ব্যারিকেড দিয়েই চলল এবং একদিন তারাই শহর রক্ষার ভূমিকায় অবস্থান নিল।

কিন্তু বৃটিশরা তো আর বোকা না। পেশোয়ার, পিন্ডি থেকে সৈন্য আসল। শহরের মুখে মুখে তারা গাড়ি নিয়ে অবস্থান নিল। ডানে বামে অস্ত্র তাক করে রাখল। যে কোনো মূল্যে তারা শহর অধিকার করবে এবং বৃটিশ শাসন অক্ষুণ্ন রাখবে।
গৌরীর যেহেতু নীল, লাল কোনো কার্ডই ছিল না, সে প্রতি সন্ধ্যায় তখন গুরুর কাছে আসত। তাকে খুব বিমর্ষ দেখাত। কেউ কেউ তার চোখে জলও দেখেছে--  গঙ্গার জলের মতোই পরিষ্কার সে জল চোখ বেয়ে ঝরে পড়ত।  

বৃটিশ সরকারের সৈন্যরা শহরে গ্রামে ধেয়ে আসছে, এই ভয়ে লোকজন বাড়ি ছেড়ে পালাতে শুরু করেছিল। লোকজন স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে দূরের খোলা মাঠগুলোতে অবস্থান নিয়েছিল। সেখানে গাছতলায় রান্না করত, সেখানেই ঘুমাত। সমস্ত বাড়ির দরজা-জানলা ছিল বন্ধ; কাপড়-চোপড়, হাড়ি-পাতিল, স্বর্ণালঙ্কার লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। শহরে কেবল শ্রমিক এবং পুরুষদের দেখা যেত। আর গুরু ছিলেন সবার প্রধান। সবাই তাকে প্রেসিডেন্ট বলে ডাকা শুরু করেছিল। রাস্তায় তরুণরা খাদি পোশাক ও গান্ধী টুপি পরে প্রদক্ষিণ করত। বুড়ো ও কিছু কিপটা কিছিমের লোক যারা বাড়ি ছাড়তে নারাজ, তারা এসময় দরজার ফাঁক-ফোকড় দিয়ে তাকিয়ে তরুণদের কর্মকা- দেখতে চেষ্টা করত। ওইসব প্রদক্ষিণরত তরুণদের চোখে পড়ে গেলে তারা তখন তাদের ডাক দিয়ে কথা বলত এবং খোলা মাঠে যে ক্যাম্প খোলা হয়েছিল সেখানে নিয়ে যেত। যেহেতু বিপদের আশংকা ছিল গুরু আদেশ দিয়েছিলেন তরুণ ও শক্তসমর্থ মানুষ ছাড়া কেউ বাড়িতে থাকতে পারবে না। ট্রেনের পর ট্রেন এসে যখন বৃটিশ সৈন্যরা নামল ততদিনে বাড়ির ছাদগুলোতে ঘাস জন্মাতে শুরু করেছে, রাস্তায় ধুলোর আস্তরণ পড়ে গেছে। সবাই দূরের পাহাড় থেকে স্টেশনে সেনাদের সম্মিলন দেখতে পেল। প্লেগে আক্রান্ত হয়ে মানুষ মারা যাওয়ার পর রাস্তায় যেভাবে মরদেহ পড়েছিল রাস্তায় দেয়া ব্যারিকেডগুলোকে তেমনি মনে হচ্ছিল। সবচে বড় ব্যারিকেড দেয়া হয়েছিল সূর্যনারায়ন রাস্তায়। সেটাকে বড় কোনো রথের মতো দেখাচ্ছিল।

শ্রমিকরা এটার পিছনে লুকিয়ে যুদ্ধের জন্য অপেক্ষা করছিল। কিন্তু গুরু বললেন, না ভ্রাতগণ, কোনো যুদ্ধ হবে না। শ্রমিকরা আবারো বলল, গুরু আমরা আপনাকে প্রাণের চেয়ে ভালোবাসি, কিন্তু এভাবে তো আপনি বৃটিশদের অত্যাচারী মনোভাব বদলাতে পারবেন না। অতএব তারা লাঠিসোটা, কাস্তে, লৌহদ- নিয়ে আর মুসলমানরা বেরুল তলোয়ার নিয়ে। কেউ কেউ সম্ভ্রান্ত কয়েক বাড়ি থেকে রাইফেলও যোগাড় করে এনেছে। তার মানে বৃটিশ সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য এখানেও একটা সৈন্যবাহিনী প্রস্তুত। গুরু এদিক-ওদিক গিয়ে সবাইকে থামাতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু শ্রমিকদের কথা একটাই--  আমরা যুদ্ধ করব। গুরু হতাশ হয়ে তখন ঘোষণা দিলেন, আমি তাহলে আমার নেতৃত্ব ছেড়ে দিলাম। তারপর তিনি চলে গেলেন এবং ধ্যানে বসলেন। এমন এক জগতে ডুব দিলেন যাতে ভালোবাসা দিয়ে এখানকার রক্তপাত থামান যায়। সাধারণ লোকজন এতে শ্রমিকদের ওপর রেগে গেল। কিন্তু তারা দেখল শ্রমিকদের কথায়ও যুক্তি আছে আবার গুরুর কথাও ঠিক। তারা বুঝে পেল না কোন দলে যাবে? দিনদুপুরে তখন পেঁচার ডাক শোনা গেল। সন্ধ্যা নামলে পরে দেখা গেল তারারা আকাশের এত নিচে নেমে এসেছে যে লোকজনের ধারণা হলো যুদ্ধ নিশ্চয়ই বাঁধবে।

সবার চোখই রাস্তার দিকে। তারা বলাবলি করছিল, গৌরী কোথায়?
রাত দশটার দিকে সেই বড়সড় রথটা থেকে আওয়াজ পাওয়া গেল। কামান, বেয়নট এবং তলোয়ার নিয়ে সবাই তখন প্রস্তুত।

এরপর যা ঘটল তা অবিস্মরণীয় ঘটনা। গৌরীকে দেখা গেল ঘানির লাইন দিয়ে হেঁটে যেতে--  সূর্যনারায়ন রাস্তার পাশ দিয়ে। তার কান দুটো মনে হচ্ছিল মাথার পেছনের বেণীর মতো যেন শান্ত ভঙ্গিতে ফুল আর ফলমূল নিয়ে দেবীর উদ্দেশ্যে যাচ্ছে। ক্রমেই তার হাঁটার গতি দ্রুততর হতে লাগল এবং লোকজন যখন গৌরীকে দেখল তারাও পিছন পিছন দৌড়াতে লাগল। প্রচুর লোকজন এতে অংশগ্রহণ করল এবং ভিড় ক্রমেই বাড়তে লাগল। লোকজন হাতে মশাল, লণ্ঠন নিয়ে ব্রাক্ষ্মণ সড়ক ধরে, তুলার বাজার দিয়ে, বড় কুয়ার পাশ দিয়ে গৌরীর পিছন পিছন দৌড়াতে লাগল। গৌরী ব্যারিকেডের দিকে যতই এগিয়ে যাচ্ছিল ততই তার হাঁটার গতি বাড়ছিল, তবে সে দৌড়াচ্ছিল না। লোকজন বলাবলি করছিল, সেই আমাদের রক্ষা করবে; নিশ্চয়ই সে আমাদের সবাইকে বাঁচাবে। ঘণ্টা বাজান শুরু হলো, কর্পূরের বাতি জ্বলল। গৌরী কিন্তু এসব কিছুই গ্রাহ্য করল না, সে কেবল এগিয়ে যেতেই থাকল। ব্যারিকেডের পিছনে যেসব শ্রমিকরা ছিল তারা এ দৃশ্য দেখে ভীত হয়ে উঠল। বলল, গৌরীর পিছনে যদি লোকজন এইভাবে জড় হতে থাকে তবে তো ব্যাটাকে মরা ছাড়া উপায় নেই। ব্যারিকেডের ওপাশে বৃটিশ সেনারা আছে, যেকোনো সময় মারাত্মক পরিস্থিতির তৈরি হতে পারে। তারা আরো ভয় পেয়ে গেল কারণ জনতা মিছিলের সুরে ‘বন্দে মাতরম’ উচ্চারণ করছিল এবং ক্রমেই গৌরীর পিছন পিছন ব্যারিকেডের দিকে ধেয়ে আসছে। গৌরী যখন মন্দির চত্বরের কাছাকাছি চলে আসল শ্রমিকরা বন্দুক থেকে হাত উঠিয়ে নিল। গৌরী তুলসি-কূপের পাশ দিয়ে আসায় শ্রমিকরা তখন তার দিকে হাত ভাঁজ করে দাঁড়াল। একেবারে ব্যারিকেডের নিচে এসে যখন গৌরী থামল শ্রমিকরা তার পায়ের ওপর ভক্তিতে উপুড় হয়ে পড়ল, বিড়বিড়িয়ে বলল, কে তুমি দেবী? ব্যারিকেডের ওপরে ওঠার জন্য তারা গৌরীকে সহয়তা করল। গৌরী প্রথম বাম পা রাখল বালির ব্যাগের ওপর, দ্বিতীয় পা রাখল রথের চাকার ওপর। আর তৃতীয় পদক্ষেপে শ্রমিকরা তাকে ঠেলে উপরে উঠিয়ে দিল--  একদম ব্যারিকেডের সর্বোচ্চভাগে। তখন জোরে জোরে ফিসফিসানি শোনা গেল যেমনটি সান্ধ্য উপাসনার সময় শোনা যায়। বৃটিশ সেনারা ব্যারিকেডের ওপাশ থেকে চিৎকার করে উঠল, আরে ওইটা কী? কী জিনিস ওইটা? তারা এটাকে শান্তিচুক্তির পতাকা ভেবে ব্যারিকেডের সামনে এগিয়ে গেল। সামনে যেতেই তারা দেখতে পেল এটা একটা গরু, যার চোখে জল--  গঙ্গার মতো স্বচ্ছ যে জল। তারা উল্লাসে চিৎকার করে উঠল, জয় মহাত্মা গান্ধী, জয় মহাত্মা গান্ধী। বলতে বলতে শ্রমিকদের দলে যোগ দিলো। তাদের গোরা ক্যাপ্টেন এ অবস্থা দেখে গুলি ছুড়ল। গুলিটা এসে লাগে গৌরীর মাথায় এবং সাথে সাথে সে নিচের শ্রমিকদের ওপর পড়ে যায়।

তারা বলল, গৌরীর মাথা থেকে তেমন রক্ত নিঃসৃত হয়নি। সামনের দুই পায়ের মাঝ থেকে বুকের গভীর হতে কিছুটা রক্ত বেরিয়েছে।

আবার আমাদের মধ্যে শান্তি ফিরে এসেছে। শেঠ জমলাল দোরক চাঁদ ব্যারিকেডের দুই পাশের দুটি বাড়ি কিনে নিয়েছে। বাড়ি দুটির মধ্যে দিয়ে একটি সংযোগ রাস্তা করেছে এবং মাঝখানের জায়গায় লৌহ নির্মিত গৌরীর একটি ভাস্কর্য বসিয়েছে। আমাদের এই গৌরী তেমন খাড়া-লম্বা না, তবে মানুষের চেহারার একটা আদল আছে ওর মুখে। আমরা সবাই তাকে ফুল, সুগন্ধি মিষ্টান্ন ও বসন্তের প্রথম ঘাস দিয়ে শ্রদ্ধা জানাই। আমাদের ছেলেময়েরা রেলিংয়ের ওপর লাফালাফি করে এবং গৌরীর পায়ের নিচে খেলা করে। গৌরীর বুকে মুখ রেখে ওরা গুমগুম শব্দ তোলে। গৌরী মারা যাওয়ার পর আমাদের ছুতোর কারিগরদের একরকম পোয়বারো আবস্থা। কারণ শিশুরা অন্য কিছু বাদ দিয়ে কেবল কাঠের তৈরি গৌরী কেনা শুরু করল। রেলস্টেশনগুলোতে হকাররা চেচিয়ে ফেরি শুরু করল, এই যে গোরাকপুরের গৌরী! এবং হিমালয় থেকে শুরু করে দক্ষিণ সাগর পর্যন্ত অনেক শিশুকে দেখা যেতে লাগল হিন্দুস্তানের ধুলোভরা রাস্তাগুলোতে কাঠের গৌরীকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।

এখনো আমরা যখন মন্দিরে রাত্রে আলো জ্বালাই, বলে উঠি, গৌরী কোথায়? একমাত্র গুরুই জানেন গৌরী কোথায়? তিনি বলেন, গৌরী স্বর্গের মাঝখানে--  জন্ম নেয়ার জন্য অপেক্ষায় আছে। সে আবার নতুন করে জন্ম নেবে যখন ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার আগে এর জনগণ পুনর্বার জ্বলে উঠবে।
সুতরাং বলা যায়, মহাত্মার রাজনৈতিক মতাদর্শে হয়তো ভুল থাকতে পারে কিন্তু সর্ব জীবের প্রতি তার যে ভালোবাসা সেখানে তিনি অনন্য।



http://www.banglanews24.com/images/PhotoGallery/2011November/RajaRaoলেখক পরিচিতি :

ভারতীয় সাহিত্যের এক কিংবদন্তী লেখক রাজা রাও । জন্ম ৮ নভেম্বর ১৯০৮। তিনি ইংরেজিতেই লিখতেন। তার সর্বাধিক আলোচিত বই দ্য সারপেন্ট অ্যান্ড দ্য রোপ (১৯৬০)। এটি একটি আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ। বেশ কিছু লেখা তিনি ইংরেজি ও ফ্রেঞ্চ দুই ভাষাতে লিখেছেন। ‘গৌরী’ গল্পটি তার দ্য কাউ অব দ্য ব্যারিকেডস গল্পের অনুবাদ। রাজা রাও মারা যান ২০০৬-এর ৮ জুলাই।

বাংলাদেশ সময় ১৩১৫, নভেম্বর ২১, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।