ঢাকা, বুধবার, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১, ০১ মে ২০২৪, ২১ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

নারীর স্বাধীনতা আর বর্ণবাদ বিরোধী উৎসব ঢাকা লিট ফেস্ট

হোসাইন মোহাম্মদ সাগর, ফিচার রিপোর্টার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২৩৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ১০, ২০১৮
নারীর স্বাধীনতা আর বর্ণবাদ বিরোধী উৎসব ঢাকা লিট ফেস্ট ঢাকা লিট ফেস্টের একটি সেশনে অতিথিরা/ছবি: জি এম মুজিবুর

ঢাকা: প্রথম দিন বাকস্বাধীনতার কথা হয়েছে, আর দ্বিতীয় দিন সকাল থেকেই বিভিন্ন অধিবেশনে বারবার উঠে এসেছে নারীর ক্ষমতায়ন, স্বাধীনতা আর বর্ণ বৈষম্যের বিষয়। কথা হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের আন্দোলন #মিটু নিয়েও। আবার বলিউডের দুই অভিনেত্রী মনীষা কৈরালা ও নন্দিতা দাস কথা বলেছেন চলচ্চিত্র ও সমাজের নারীর অবস্থান নিয়েও। আর এতো ভিড়ে দেওয়া হয়েছে জেমকন সাহিত্য পুরস্কার।

শুক্রবার (৯ নভেম্বর) উৎসবের দ্বিতীয় দিনের শুরুতেই প্রধান আকর্ষণ ছিল বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে ‘ব্রেকিং বাদ’। অধিবেশনে যোগ দেন বলিউড অভিনেত্রী মনীষা কৈরালা ও নন্দিতা দাস।

তার সঙ্গে সঞ্চালনায় ছিলেন উৎসবের অন্যতম পরিচালক সাদাফ সায্।

এতে মনীষা কৈরালা বলেন, পরিচালক হিসেবে এখনও মানুষ একজন নারীকে কল্পনা করতে পারেন না। চলচ্চিত্র জগতে শতকরা ২০ জনেরও কম নারী ক্যামেরার পেছনে কাজ করে। আর এটা শুধু চলচ্চিত্র পরিচালনার ক্ষেত্রে নয়, প্রায় সর্বক্ষেত্রেই হয়ে আসছে। নারীদের উচিৎ নিজেদেরই শক্ত হাতে এটা দমন করা। নারীদের শক্ত হতে হবে।

নন্দিতা দাসের আলোচনায় দারুণভাবে উঠে আসে নারীর প্রতি বর্ণবাদ প্রসঙ্গটি। সে সঙ্গে তিনি কথা বলেন ‘ব্ল্যাক ইজ বিউটিফুল’ প্রচারণা নিয়েও।

বিকেলে ছিলো #মিটু নিয়ে বিস্তর আলোচনা। ‘#মিটু এর যুগে বাঙালি সমাজ আনাড়িত্ব’ শিরোনামের এ অধিবেশনে আলোচনা করেন সাংবাদিক মুন্নি সাহা, জাইমা ইসলাম, অভিনেত্রী বন্যা মির্জা এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রিতা দাশ রায়। এতে বক্তারা বলেন, শুধুমাত্র সামাজিক মাধ্যমে লেখাতেই এ আন্দোলন সীমাবদ্ধ নয়। একজন নারীকে সেই সঙ্গে এই প্রতিবাদ চালিয়ে যাওয়ার মানসিকতা ও সাহস রাখতে হবে।

নারীদের এত সব কথার মধ্যে হাস্যরসে উৎসব মাতিয়ে তুলেছিলেন ইউটিউবার রাবা খান। কমেডিয়ান এ নারী অংশ নিয়েছিলেন ‘ওমেন অ্যান্ড উইট’ অধিবেশনে। তার সঙ্গে ছিলেন ফারিহা পান্নি। এতে রাবা খান বলেন, অনেকই রস আর ভাঁড়ামোর মধ্যে পার্থক্য বোঝেন না। সারা পৃথিবীতে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও কমেডিয়ান হিসেবে জায়গা করে নিচ্ছেন। সেটা রসবোধের কারণে। যদিও আমাদের দেশে এ রসবোধ বিষয়টিকে ভালোভাবে নেওয়া হয় না।

কুড়িগ্রামের রাজারহাটের ‘লোকসঙ্গীত’ দলের কীর্তন পরিবেশনার মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া দ্বিতীয় দিনের আয়োজনে শিশুদের জন্য ছিলো নানা অধিবেশন। সাত থেকে ১১ বছর বয়সী শিশুদের জন্য ছিলো ‘সুপারডগস’ শিরোনামের অধিবেশন, যা পরিচালনা করেন হিমানজল শঙ্কর। ফাতেমা তুজ জোহরা শিশুদের পাঠ করে শোনান ‘পশু পাখির তিন গল্প’।  

ছোটদের নাট্যদল বিদ্যাভুবন মঞ্চায়ন করে নাটক ‘দ্যা লাস্ট ট্রি’। ছিলো ছড়াপাঠের আয়োজন ‘আউট অব দ্য ক্লোজেট’। রিফাত ইসলাম ইশার সঞ্চালনায় অংশ নেন সারিনা হোসাইন ও সাকিয়া চৌধুরী। পুতুলনাট্য ‘মানুষ’ পরিবেশন করেন রশিদ হারুন।  

‘মঞ্চ নাটক, টিভি নাটক ও চিত্রনাট্য’ শীর্ষক আলোচনায় অংশ নেন সমকালের ফিচার সম্পাদক মাহবুব আজীজ, চলচ্চিত্র নির্মাতা অমিতাভ রেজা চৌধুরী, গবেষক সাইমন জাকারিয়া ও কবি আলতাফ শাহনেওয়াজ। সঞ্চালনা করেন অভিনেত্রী বন্যা মির্জা।

‘ফিয়ারসাম ফিউচারস’ শিরোনামে অধিবেশনে কেলি ফ্যালকোনারের সঙ্গে আলাপচারিতা করেন পুলিৎজার বিজয়ী মার্কিন সাহিত্যিক অ্যাডাম জনসন। তিনি বলেন, দেখতে পারা আর না-পারার মধ্যে ফারাক শুধুই অনুভবে, অনুধাবনে। এটাই তার সাহিত্যের মূল সুর। প্রত্যেকটি মানুষের জীবনের গল্প তাকে ঘিরেই আবর্তিত হয়। লক্ষ্য ঠিক করে, নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে যখন আমরা সেই কাঙ্খিত চূড়ায় পৌঁছাই, তাকেই জীবনের সার্থকতা বলে মেনে নিতে হয়।

‘বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস: সংকট ও উত্তরণ’ শীর্ষক আলাপচারিতায় অংশ নেন রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ, উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক ড. নিখিলেশ রায় এবং কবি ও অধ্যাপক সুমন গুণ। এ পর্বটি সঞ্চালনা করেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ মুহসিন। এতে বক্তারা বলেন, বিগত চল্লিশ-পঞ্চাশ বছরের সাহিত্যের ইতিহাস একদম শূন্য। পরিতাপের বিষয় এসব সমস্যা আজও বিদ্যমান। লিখিত সাহিত্য ইতিহাস সংরক্ষণের পাশাপাশি মৌখিক সাহিত্যের সংরক্ষণও করতে হবে সমান গুরুত্ব দিয়ে। এ বিষয়ে রাষ্ট্রের উদ্যোগ খুবই কাম্য। আর্থিক সহায়তাও সমভাবে দরকারি।

বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান লেখক আরিফ আনোয়ার নিজের প্রথম উপন্যাস ‘দ্যা স্টর্ম’ নিয়ে রিফাত মুনিমের সঙ্গে কথা বলেন। দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস বুক রিভিউয়ে প্রশংসিত ‘দ্য স্টর্ম’ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ব্যর্থতার ভয় কাটিয়ে প্রতিদিন লিখে যাওয়ার চর্চাই তাকে লেখক করে তুলেছে। লেখালেখি একটা চলমান প্রক্রিয়া। একজন ভালো, গ্রহণযোগ্য লেখক হওয়ার পূর্বশর্তই হলো প্রচুর বই পড়া।

এছাড়া বাংলা একাডেমির উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে ছিলো ‘দ্যা জয় অব রিডিং’ শিরোনামের অধিবেশন। এতে মাইমুনা আহমেদের সঙ্গে আলাপচারিতায় অংশ নেন আহসান হাবীব ও বুশরা জুলফিকার। নিজেদের রচনা পাঠ করেন কবি কামাল চৌধুরী ও রুপার্ট ডস্তুর। এ পর্বটি সঞ্চালনা করেন সাবরিনা ফাতেমা আহমেদ। আর নভেরা প্রদর্শনালয়ে ছিলো প্রথম বই রচনার আলোচনা। অরূপ স্যানালের সঞ্চালনায় ‘ফার্স্ট বুকস: হোয়ার ডু দে কাম ফ্রম?’ শিরোনামের এ অধিবেশনে নিজেদের প্রথম বই রচনার গল্প বলেন ওলগা গার্জাসনোয়াম হিমাঞ্চল শংকর ও চন্দ্রহাস চৌধুরী।

দুপুর সোয়া বারোটায় কবি শামসুর রাহমান সেমিনার কক্ষে ‘অ্যাপ্রিসিয়েট কালচার’ শিরেনামের অধিবেশনে সামিয়া খাতুনের সঞ্চালনায় আলোচনায় অংশ নেন অ্যানি জায়দি, জয়শ্রী মিশ্র ও হিমাঞ্জল শংকর। কসমিক টেন্টে ছিলো ‘ডার্টি লন্ড্রি’ শিরোনামের অধিবেশনে নিসিম জান সাজিদের সঞ্চালনায় আলোচনায় অংশ নেন ক্যাটরিনা ডন, অমিত আশরাফ, কাজী ইসতেলা ইমাম ও ফারাহ খন্দকার।

দুপুর দুইটায় আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে অস্কার জয়ী টিল্ডা সুইন্টন নিজের লেখা ‘ফার্স্ট অ্যান্ড লাস্ট মেন’ থেকে পাঠ করেন। কবি শামসুর রাহমান সেমিনার কক্ষে অ্যাড কামিংয়ের সঞ্চালনায় জেমস মিক অংশ নেন ‘দ্যা গ্রেট বিট্রেইল’। উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে কোর্টনি হোডেলের সঞ্চালনায় ক্রিস হেইসার ও রুপার্ট ড্রাস্টর অংশ নেন ‘শর্ট আউট’ শিরোনামের অধিবেশনে। নভেরা প্রদর্শনালয়ে সালি পমি ক্লাইটন পরিবেশন করেন ‘অ্যামেজিং মেইডেন্স’। কসমিক টেন্টে ছিলো ‘ম্যাথ অলিম্পিয়াড’ নিয়ে আলোচনা। মুনীর হাসানের সঞ্চালনায় এতে অংশ নেন বিশ্ব ম্যাথ অলিম্পিয়াডের স্বর্ণজয়ী আহমেদ জাওয়াদ চৌধুরী, মাহবুবুল আলম মজুমদার ও শুভা নওয়ার পুষ্পিতা।

বিকেল সোয়া তিনটায় কবি শামসুর রাহমান সেমিনার কক্ষে ছিলো ‘লাইব্রেরি অব বাংলাদেশ’ শিরোনামের অধিবেশন। এতে সঞ্চালনা করেন রিফাত মুনীম। আলোচনায় অংশ নেন কায়সার হক, খাদেমুল ইসলাম ও কিউপি আলম। উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে ছিলো গল্পবলার আয়োজন। অ্যাড কামিংয়ের সঞ্চালনায় গল্পপাঠে অংশ নেন ক্রিস্টিয়ান হোডেল, ক্রিস হেইসার ও রস পর্টার। বিকেল সাড়ে চারটায় কবি শামসুর রাহমান সেমিনার কক্ষে খাদেমুল ইসলামের সঞ্চালনায় ‘সিক্রেট হিস্টোরি’ নিয়ে আলোচনা করেন ফিলিপ হেনসের।

নভেরা প্রদর্শনালয়ে সান্ড্রা কোপ পরিবেশন করেন ‘দ্য ট্রি অব লাইফ’। কসমিক টেন্টে ছিলো আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে নিয়ে ‘ইলিয়াস’ শিরোনামের অধিবেশন। এতে সঞ্চালনা করেন মুসহারাত হুসেইন। আলোচনায় অংশ নেন খালেকুজ্জামান ইলিয়াস, ইমদাদুল হক মিলন, প্রশান্ত মৃধা ও সর্বজন দাশগুপ্ত। নজরুল মঞ্চে ছিলো উত্তরবঙ্গের লোকজ পরিবেশনা ‘কুশন’।

বিকেল পৌনে ছয়টায় আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে ছিলো ‘আই এমন চেঞ্জ’ শিরোনামের অধিবেশন। এতে সঞ্চালনা করেন নবনীতা চৌধুরী। আলোচনায় অংশ নেন খালেদা শাহরিয়ার কবির, সায়েবা আখতার, নমিতা হালদার ও কাঙালিনি সুফিয়া। কবি শামসুর রাহমান সেমিনার কক্ষে ছিলো ‘দ্য বাংলাদেশ প্যারাডক্স’ শিরোনামের অধিবেশন। এতে সঞ্চালনা করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান। আলোচনা করেন বিনায়েক সেন, ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ ও কে এ এস মুরশিদ। উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে ছিলো কবিতা পাঠের আসর ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি’। এ পর্ব সঞ্চালনা করেন ফরিদ কবির। নভেরা প্রদর্শনালয়ে প্রদর্শিত হয় চলচ্চিত্র ‘বিদ্যাভুবন’। যা নিয়ে আলোচনা করেন নাদিম ইকবাল ও শেখ আল মামুন। কসমিক টেন্টে ‘স্টারস, স্টোরিজ অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজি’ শিরোনামের অধিবেশন। এতে রুপার্ট হাকসলের সঞ্চালনায় আলোচনা করেন ক্রিস্টান হোডেল। নজরুল মঞ্চে প্রবার রিপনের নির্দেশনায় গান আর কবিতার যুগলবন্দী পরিবেশিত হয় নিউ সোনার বাংলা সার্কাস। আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী নিজের বই ‘চ্যারোট অব লাইফ’ নিয়ে হায়াত সাইফের সঞ্চালনায় আলোচনা করেন।

কথাসাহিত্যিক কাজী আনিস আহমেদ, কবি সাদাফ সায্ সিদ্দিকী ও কবি আহসান আকবরের পরিচালনায় অষ্টমবারের মতো অনুষ্ঠিত হচ্ছে এ উৎসব। উৎসবের সহযোগিতায় রয়েছে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও বাংলা একাডেমি। এবারের উৎসবের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে থাকছে ঢাকা ট্রিবিউন ও বাংলা ট্রিবিউন। সহপৃষ্ঠপোষক হিসেবে রয়েছে ব্র্যাক ব্যাংক।

বাংলাদেশ সময়: ২১২৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৯, ২০১৮
এইচএমএস/এসএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।