ঢাকা, শনিবার, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

ধারাবাহিক অনুবাদ উপন্যাস

ব্যানকো [পর্ব-৫]

মূল : হেনরি শ্যারিয়ার, ভাষান্তর : আহ্সান কবীর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯০৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩০, ২০১১
ব্যানকো [পর্ব-৫]

[দুনিয়াজুড়ে সাড়া জাগানো এবং দীর্ঘদিন ধরে বেস্ট সেলার, জেলপালানো কয়েদির মনোমুগ্ধকর আর শিহরণ জাগানিয়া কাহিনী ‘প্যাপিলন’ফ্রান্সে জন্ম নেয়া হেনরি শ্যারিয়ার ওরফে প্যাপিলন লিখিত বাস্তব এই ঘটনা নিয়ে একই নামে হলিউডে সিনেমাও হয়েছে।

 

১৯৩১ সালের অক্টোবরে ফরাসি আদালত কর্তৃক বিনা অপরাধে (প্যাপিলনের দাবি মতে) খুনের আসামি হিসেবে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর থেকে ১৯৪৪ সালের জুলাই পর্যন্ত পরবর্তী ১৩টি বছর হেনরি শ্যারিয়ারের জীবন কেটেছে জেল পালানো এবং আবারো জেলে ফেরার মধ্যে দিয়ে। তবে সত্যিকারার্থে প্যাপিলন জেলমুক্ত হন ১৯৪৫ সালের ১৯ অক্টোবর। এদিন এল ডোরাডো কারাগার থেকে প্যারালাইসিস আক্রান্ত আরেকজন প্রতিবন্ধী কয়েদি পিকোলিনোসহ মুক্ত হন প্যাপিলন।

হেনরি শ্যারিয়ারের দীর্ঘ ১৩ বছরের ফেরারি এবং জেল-জীবনের  হৃদয়স্পর্শী, দুর্ধর্ষ, মানবিক আর আবেগমথিত অমানবিক সব অভিযানের কাহিনী লেখা হয়েছে প্যাপিলন-এ।

এরপরের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে শ্যারিয়ার রচিত দ্বিতীয় বই ‘ব্যানকো’ তে। স্পেনীয় দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে জন্মভূমির মুক্তি আনয়নকারী মহান নেতা সিমন বলিভারের দেশ এবং বর্তমান সময়ের আলোচিত নেতা হুগো শ্যাভেজের দেশ ভেনিজুয়েলা’একজন নাগরিক হিসেবে শুরু হয় তার নয়া জীবন। প্যাপিলনের শেষ পৃষ্ঠায় ছিল এল ডোরাডো পেনাল সেটলমেন্টের অফিসার প্যাপিলনকে ‘গুড লাক’ বলে বিদায় জানাচ্ছেন।

আর ব্যানকো’কাহিনী শুরু ঠিক এর পর থেকে। প্যাপিলনের মতই ব্যানকো-উত্তেজনাপূর্ণ ঘটনায় জমজমাট, শ্বাসরুদ্ধকর আর এক নিঃশ্বাসে পড়ার মত। যারা প্যাপিলন পড়েননি তাদেরও নিরাশ করবে না এই কাহিনী। এখানে প্যাট্রিক ও’ব্রায়ান-এর করা ব্যানকো’ইংরেজি অনুবাদের সংক্ষেপিত বাংলা রূপান্তর করা হয়েছে। বিভিন্ন নামের উচ্চারণের ক্ষেত্রে ইংরেজিকেই অনুসরণ করা হয়েছে, যেমন- ফরাসী শব্দ ‘পাপিলঁ’-কে করা হয়েছে প্যাপিলন, আবার লেখক অঁরি শারিয়ারকে করা হয়েছে হেনরি শ্যারিয়ার। ] 

 

একফালি রোদ এসে আমার ঘুম ভাঙালো। ঘড়িতে জানান দিচ্ছে সকাল আটটা। বড় ঘরটিতে দাঁড়ানোর মত সাহস আমার ছিল না, এমনকি এককাপ কফি খাওয়ার মত সময়ের জন্যেও না। পিকোলিনো একটি চেয়ারে বসে আছে, তার গাল বেয়ে অশ্রু ঝরছে। এসমারেল্ডা ওকে ধুয়েমুছে কাপড়-চোপড় পড়িয়েছে। আমি মারিয়ার বোনদের খোঁজ করলাম, কিন্তু কাউকে পেলাম না। আমার বিদায়ক্ষণকে অবলোকন করতে চায় না বলে এরা সবাই আড়াল নিয়েছে। শুধুমাত্র দরজার পথে জোজো দাঁড়িয়ে আছে। কাছে যেতেই সে আমাকে ভেনেজুয়েলান ‘এবরাজো’ কায়দায় জড়িয়ে ধরলো (একহাতে অন্যজনের হাত ধরা এবং অপর হাতটি দিয়ে অন্যের কাঁধ পেঁচিয়ে ধরা), আমি তার অনুকরণ করলাম। আমার মুখ দিয়ে কোন কথা বের হলো না, আর সে শুধুমাত্র এই কথা ক’টা বললো: ‘আমাদের ভুলো না; আমরা কক্ষনো তোমাকে ভুলবো না। বিদায়, ঈশ্বর তোমার সহায় হোন। ’

ধুয়ে সাফ সুতরো করা জিনিসপত্রের পুটলিসহ পিকোলিনো অঝোরধারায় কাঁদছে। ওর মুখ দিয় বের হওয়া দুর্বোধ্য জান্তব ধ্বনি আর ওর নড়াচড়া বলছে হৃদয়ে জমে থাকা লক্ষ লক্ষ কৃতজ্ঞতাগুলোকে ভাষায় প্রকাশ করতে না পারার যন্ত্রণা ওকে কতটা দগ্ধ করছে। আমি ওকে নিয়ে চললাম।

মালপত্র নিয়ে ড্রাইভারদের এলাকায় চলে এলাম। কিন্তু ট্রাক অকেজো হয়ে আছে; আজ যাচ্ছে না। একটা নতুন কার্বুরেটর আসা পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। এছাড়া উপায় নেই-- আমি পিকোলিনোকে নিয়ে মারিয়াদের ওখানে ফিরে আসলাম। তারা আমাদেরকে ফিরতে দেখে কি পরিমাণ বিস্মিত, চমকিত হলো তা বর্ণনাতীত।

‘খোদার অশেষ দয়া যে ট্রাকটি নষ্ট হয়েছে, এনরিক। পিকোলিনোকে এখানে রেখে গ্রামের পথে একটু হেঁটে আস। এই ফাঁকে আমি খাবার বানিয়ে ফেলি। এটা একটা বাজে ব্যাপার। একটু থেমে মারিয়া যোগ করলো, ‘তবে এটাও হতে পারতো যে ক্যারাকাসে যাওয়া তোমার ভাগ্যে নেই। ’

পথে হাঁটতে হাঁটতে আমি মারিয়ার এই মন্তব্যটি নিয়ে ভাবলাম। এটা আমাকে উদ্বিগ্ন করে তুললো। আমি ক্যারাকাস চিনি না, বিশাল শহর, তবে লোকজনের কাছে শুনে অনুমান করতে পারি কি রকম হবে শহরটি। এই ভাবনটা হঠাৎই আমাকে সচকিত করে তুললো : আমি ওখানে পৌঁছালে করবোটা কি, আর কিভাবেই বা করবো তা?

দুইহাত পেছনে বেঁধে ধীর পায়ে এল-ক্যালাওয়ের স্কয়ারটিতে হাঁটাহাঁটি করছি। সূর্য প্রখর দীপ্তি ছড়াচ্ছে। তার হিংস্র আঁচ থেকে বাঁচার জন্য আমি একটা এ্যালমেনড্রোন-এর নিচে আশ্রয় নিলাম, বিশাল পাতাবহুল এ গাছটির ছায়ায় দু’টো খচ্চর দাঁড়িয়ে আছে। আর একজন খর্বকায় বৃদ্ধলোক ওগুলোতে মাল বোঝাই করছে। আমি খেয়াল করলাম তার সঙ্গে রয়েছে হীরক অনুসন্ধানীর ব্যবহার্য একধরনের চালনি, স্বর্ণ-অনুসন্ধানকারীদের ব্যবহার্য বারকোস-- এক ধরনের চাইনিজ হ্যাটের মত যা দিয়ে তারা স্বর্ণ মিশ্রিত কাদা ধোয় স্বর্ণ আলাদা করার জন্য। এই জিনিসগুলো লক্ষ্য করতে থাকলাম, এগুলো আমার কাছে একেবারে নতুন জিনিস।

আমার সামনে নৈঃশব্দতায় ডুবে থাকা আত্মসমাহিত শান্ত, স্নিগ্ধ, নৈঃসর্গিক জীবনাচারের পটচিত্র যেখানে প্রাকৃতিক আর নাগরিক জীবনের দৈনন্দিতার কোন কোলাহল নেই। আমি ভাবতে চেষ্টা করলাম ঠিক এই মুহূর্তে ক্যারাকাসের চিত্রটা কিরকম হতে পারে! মহাব্যস্ত, জঞ্জালপূর্ণ শহরটি যা আমাকে অমোঘ আকর্ষণে টানছে তার দিকে। যতসব বর্ণনা শুনেছিলাম ক্যারাকাস সম্পর্কে তার বাস্তবসম্মত চিত্র আমার চোখে ভেসে উঠলো। মোদ্দাকথা, ইতিমধ্যে চৌদ্দ বছর পার হয়ে গেছে যখন আমি শেষ কোন বড় শহর দেখছি। এখন থেকে আমি আমার ইচ্ছাধীন জীবন-যাপন করবো, এ ব্যাপারে কোনই সন্দেহ নেই। আমি সেখানেই যাচ্ছি এবং যত দ্রুত সম্ভব।



http://www.banglanews24.com/images/PhotoGallery/2011October/Butterfly Sky20111030185721.jpgতৃতীয় পরিচ্ছদ
 
যীশু, ফরাসি ভাষায় গান গাইছে কে? সেই খর্বকায় বৃদ্ধটি? আমি কান পেতে শুনলাম।
বুড়ো হাঙ্গরগুলো সব তৈরি আছে, সেখানে তারা একজন মানুষের রক্তের ঘ্রাণ পেয়েছে। তাদের একজন আপেলের মত করে হাত চিবোচ্ছে,  অন্যজন লোকটির ধরটি খাচ্ছে আর ট্রা-লা-লা ত্বরিৎগতি ওয়ালারা এখানে জয়ী হন, অন্যরা সব ফাক্কা, শুভ বিদায় পুরনো পাপী, দীর্ঘজীবী হোক আইন!

আমি বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে গেলাম। সে ধীরলয়ে গেয়ে চলেছে এটা, অনেকটা প্রার্থনাগীতির ট্রা-লা-লা কথাটায় একটা চিরন্তন আনন্দ ধ্বনি আছে আর লং লিভ দা ল (আইন দীর্ঘজীবী হোক) কথাটা আইন-আদালত বিষয়ে প্যারিসের অপরাধ জগতের দৃষ্টিভঙ্গীর বিদ্রুপাত্মক প্রহসনে পূর্ণ, এটা অলংঘনীয় সত্যের মত প্রতিধ্বনি তুলছিল আমার কানে। কিন্তু এই কথার নির্মমতার বাস্তব রূপ অবলোকন করতে হলে সশরীরে প্যারিসে উপস্থিত থাকতে হয়।

লোকটাকে কাছ থেকে দেখলাম। মনে হচ্ছে তিনটে আপেল একটার ওপর আরেকটা সাজিয়ে রাখা হয়েছে, মাত্র চার ফিট এক ইঞ্চি উচ্চতা (পরে জেনেছিলাম)। আমার দেখা প্রাক্তন অপরাধীদের মধ্যকার সবচেয়ে মার্কামারাদের একজন। তুষার শুভ্র কেশ, মুখের দু’পাশে ধূসর চাপদাঁড়ি। পরনে নীল জিন্স, বিশাল চওড়া এক চামড়ার বেল্ট জড়ানো কোমরে, এর ডাইন দিকে একটি লম্বা তরবারির খাপ ঝুলানো, যার মুখ থেকে বাঁকানো লম্বা বাট বেরিয়ে আছে উরুসন্ধির দিকে মুখ করে। তার দিকে এগিয়ে গেলাম। মাথায় হ্যাট নেই লোকটির-- মাটিতে পড়ে আছে এটি।   তাই তার প্রশস্ত আর রোদে পোড়া তামাটে কপাল প্রকাশ হয়ে আছে যা তার জলদস্যুসুলভ লালচে শরীর থেকে বেশি মাত্রায় রোদভাজা মনে হচ্ছে। ভ্রু দু’টো এত ঘন আর দীর্ঘ যে আমি নিশ্চিত ওগুলো ঠিক রাখতে চিরুনি চালাতে হয়। এসবের বাইরে ওর ইস্পাত কঠিন ধূসর-সবুজ চোখ যাতে প্রখর অন্তর্ভেদী দৃষ্টি-- তা এবার আমার দিকে নিক্ষিপ্ত হলো। আমি নড়েচরে ওঠার আগেই ও মুখ খুললো, ‘আমার নাম লা পাসে এটা যেমন নিশ্চিত তেমনি তুমি জেল থেকে বেরিয়েছো এ ব্যাপারেও আমি নিশ্চিত।

‘যথার্থ। আমার নাম প্যাপিলন। ’
‘আমি জো জো লা পাসে। ’ সাদরে করমর্দন করলো, এতজোড়ে করমর্দন যে প্রতিপক্ষের আঙুল গুড়িয়ে দেয় যা প্রাথমিক পরিচয়ে অনেকেই করে মূর্খের মতো নিজের শক্তি-ক্ষমতা প্রকাশের ইচ্ছায়। আবার এতটা কোমলও নয় যেভাবে ভণ্ড আর হিপোক্রেটরা সাধরণত করে থাকে। আমি বললাম, ‘চল বারে গিয়ে একটু গলা ভেজানো যাক, আমার পক্ষ থেকে। ’
‘না, এই পথের শেষে আমার বাড়ি, সাদা রংয়ের বাড়িটি। সেখানে চল। আমি ছোটবেলায় যেখানে বড় হয়েছি সেখানকার নামানুসারে এর নাম রেখেছি বেলেভাইল। আমরা সেখানে আরামে কথা বলতে পারি।
বাড়িটি ঝকঝকে পরিপাটি-- তার স্ত্রীর করিৎকর্মতার লক্ষণ। লোলাকে তরুণীই বলা চলে, স্বামীর তুলনায় খুবই অল্প বয়েস, বছর পঁচিশেক হবে। আর বুড়োর-- খোদায় মালুম: কমসে কম ষাট। লোলা একজন কালো চামড়ার ভেনেজুয়েলান।
‘তোমাকে স্বাগত জানাচ্ছি,’ দৃষ্টিকাড়া হাসি দিয়ে লোলা আমাকে অভ্যর্থনা জানালো।
‘ধন্যবাদ। ’
‘দুইপাত্র পাস্টিস’ জো জো অর্ডার করলো। ‘এক কর্সিকান আমাকে ফ্রান্স থেকে দুশ’ বোতল এনে দিয়েছে। চেখে দেখ ভাল না মন্দ। ’
লোলা মদ ঢাললো। জো জো নিজের গ্লাসের তিন চতুর্থাংশ এক ঢোকেই পেটে চালান করে দিল।
‘ভাল?’ ওর চোখ দিয়ে আমাকে গেঁথে রেখে প্রশ্ন করলো। ‘কিন্তু ভাল মানে কি বুঝছো? ভেবো না আমি আমার জীবন-বৃত্তান্ত তোমাকে পেশ করতে যাচ্ছি, নাকি সেরকমই ভাবছো?’
ঠিক আছে, বন্ধু। কিন্তু জোজো লা পাসে, স্মৃতিতে নিজের অতীত কি কোনই আঁচড় কাটে না?’
‘না। কত সহজেই লোকজন ভুলে যায় তোমাকে! যদিও জেলে এক মস্ত ঘুঘু ছিলাম। ডাইসের সেভেন-ইলেভেন খেলায় আমার মাইলখানে ধারেকাছেও আসার যুগ্যি কারও ছিল না একচালে-- বুঝতে পারছো, কোন ছল-চাতুরী ছাড়াই। অবশ্যই এটা এই সে দিনের কথা নয়; কিন্তু তারপরেও, আমাদের মত মানুষ, পেছনে পদচিহ্ন রেখে আসে, ঐতিহ্য সৃষ্টি করে। এবং এই ধারায় তুমি এখন যা আমাকে বলবে, বছর কয়েকের মধ্যেই এটা বিস্মৃত হয়ে যাবে। কোন বেজম্মাই কি এ যাবত তোমাকে আমার কথা বলেনি?’
তাকে খুবই উত্তেজিত মনে হলো।
‘সত্যি কথা, না। ’
আরও একবার-- তার দৃষ্টির ফলা আমাকে বিদ্ধ করলো, ‘তুমি জেলে খুব বেশিদিন ঘানি পেষনি: তাই এর বাস্তব চেহারা দেখনি। ’
‘সুদীর্ঘ তের বছর, এর সঙ্গে এল ডোরাডোর মেয়াদ। তুমি বলছো এটা কিছুই না?’
এটা সম্ভবই নয়। তোমার পিঠে অল্পই দাগ পড়েছে, আর তোমার সাথের অন্য একজন কয়েদীই বলতে পারতো প্রকৃত অবস্থা কি? এবং তারপরও যদি সেই কয়েদী জঘন্যতরভাবে ধূর্ত মনোপাঠক না হয়ে থাকে তাহলে বিভ্রান্তও হতে পারে। তুমিতো জেলজীবন পুষ্পশয্যায় কাটিয়ে এসেছো, তাই না?’
‘যেমন ভাবছো আসলে মোটই তা ছিল না কালাপানি; নির্জন কারাবাস। ’
‘আমার মুণ্ডু, বন্ধু, মুণ্ডু। ওই দ্বীপগুলো-- ওগুলোতো আসলে একেকটা অবকাশযাপন কেন্দ্র! সেখানে শুধু অভাব একটা করে ক্যাসিনোর। তোমার জন্য জেলতো ছিল সমুদ্রে হাওয়া খেতে যাওয়া, মাছ ধরে সময় কাটানো, মশার অত্যাচার নেই, আর মাঝেমধ্যে একটু একটু আসল মধুর স্বাদ নেওয়া-- কারণ কারারক্ষীদের কারও কারও স্ত্রীর যোনী আর পাছা তাদের স্বামী বেজন্মারা এতই বুভুক্ষ রাখতো যে তোমাদের ছাড়া তাদের গত্যন্তর ছিল না।
‘তারপরেও, তুমি জান...’
‘চু-চু-চু: আমাকে মক্কেল বানাতে চেওনা। এই কাহিনী আমার মুখস্ত। যদিও আমি ওই দ্বীপে ছিলাম না, কিন্তু এর খবর আমি রাখি। ’

এই লোকটি, হতে পারে ঘাঘু মাল, কিন্তু যা শুরু করেছে তাতে মনে হচ্ছে শালার কপালে শনি লাগতে যাচ্ছে : বুঝতে পারলাম দ্রুত আমার রাগ বেড়ে যাচ্ছে। ওদিকে সে চালিয়ে যাচ্ছে তার বকরবকর। কয়েদখানা, সত্যিকারের কয়েদখানা, এটা ছিল ‘কিলোমিটার ২৪’। কিছু ঠাহর হচ্ছে এখন? না, মালুম হচ্ছে না তোমার এবং এটাই স্বাভাবিক। তোমার যে দৌড় তাতে তোমাকে ওই পর্যন্ত পৌঁছাতে হয়নি। অসুবিধা নেই, বন্ধু, আমার সেই অভিজ্ঞতা আছে। শ’ খানেক লোক, প্রত্যেকেই অসুস্থ মনোবৃত্তি আক্রান্ত। কেউ দাঁড়িয়ে আছে, কেউ শুয়ে আছে। কেউ কেউ কুকুরের মত চিৎকার করছে। সামনে একটা জঙ্গলা, ঠিক দেয়ালের মত। কিন্তু এই জঙ্গল ওদেরকে কাটতে হয় না, জঙ্গলই জঙ্গল কাটে ওখানে। এটা কোন শ্রম শিবিরও না। কারা প্রশাসন খুব সচেতনতার সাথেই গায়েনা জঙ্গলের গহীন আড়ালের ভিতর এই দুর্ভেদ্য ছোট উপত্যকাটি বেছে নিয়েছে। হুম! কিলোমিটার ২৪ এর নাম। তুমি তোমার শত্রুকে সেখানে ফেলে আস, তার বিষয়ে ভাবতে হবে না, এই জীবনে সে আর তোমার সামনে আসবে না, স্রেফ ভুলে যাও তাকে।

শোন, প্যাপিলন; তোমার  দ্বীপান্তর আর নিঃসঙ্গ কারাবাসের কাহিনী বলে আমাকে মন্ত্রমুগ্ধ করতে চেওনা। এই গল্পে আমাকে ঘুম পাড়াতে পারবে না। হাজারো প্রেতাত্মার তাড়া খাওয়া কুকুরের বিভ্রান্ত দৃষ্টি তুমি দেখনি, যাবজ্জীবন দণ্ড পাওয়া অস্থি চর্মসার কঙ্কালবৎ দেহের উপরে ছুঁচোমুখ আদম সন্তানের চেহারাও দেখনি কিংবা সেসব হতভাগ্য নালায়েকদের হতশ্রীরূপ, যারা ওই নরক থেকে অবিশ্বাস্যরকমভাবে পালিয়ে যেতে পারতো-- সেই দুর্ভাগাদের চেহারা দেখতে হতো অনেকটা যেন একজন যুবকের দেহের উপরের মাথাটা ছেনি দিয়ে কূঁদে বুড়ো মানুষের একটি মুখ বানিয়ে দিয়েছে কেউ। আর তাই বলছি আমার বিচারে সম্ভাব্যতর কোন ভুলই নেই: তোমার ক্ষেত্রে জেলজীবন সমুদ্র সৈকতে বসে রোদ পোহানো ছাড়া কিছুই ছিল না।
কোন সাহসে এই বেজন্মা বামুনটা একের পর এক উদ্দেশ্যমূলক নির্মম খোঁচা দিয়ে যাচ্ছে আমাকে ভেবে অবাক হচ্ছিলাম আর এই অনাহুত সাক্ষাতের পরিণতি কি হতে পারে তা ভেবে দুশ্চিন্তাও হচ্ছিল।

‘আমার ক্ষেত্রে যেমন আমি তোমাকে বলছিলাম, এটা এমন একটা কানাগলি ছিল যেই পথের যাত্রী হলে কেউ আর জ্যান্ত ফেরে না-- রক্ত আমাশা। বুঝলে, এমন একটা জায়গা এটা যেখানে তোমার সমস্ত আত্মবিশ্বাস, অহঙ্কার, ব্যক্তিত্ব সবকিছু ওই রক্ত আমাশয়ের সঙ্গে পায়খানার রাস্তা দিয়ে ধীরে ধীরে মাটিতে নেমে আসে। আর তোমার ক্ষেত্রে বলবো, কয়েদখানা কাহাকে বলে তাহা তুমি কখনোই জানতে পারো নাই। ’

http://www.banglanews24.com/images/PhotoGallery/2011October/chess ২20111030190226.jpgআমি ভয়ঙ্করভাবে প্রাণশক্তিতে ভরপুর এই ক্ষুদ্র মানুষটির চেহারা খুব যতেœর সঙ্গে জরীপ করতে লাগলাম, ঠিক কোথায় আমার বিরাশি সিক্কাটা হাঁকানো যায় এই চিন্তায়, কিন্তু সহসাই মত বদলালাম এবং তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করার সিদ্ধান্ত নিলাম। বৈরিতা করে লাভ নেই : এই চিড়িয়াকে আমার দরকার আছে। ‘তুমি ঠিকই বলেছো জো জো। আমার জেলজীবন আসলে তেমন কহতব্য কিছু নয়। যেহেতু আমাকে দেখতে পরিপাটিই লাগছে তাই তোমার মত ঘাগুমাল সহজেই বলতে পারছে আমার অতীত।

‘ঠিক হ্যায়’ আমরা চুক্তিতে আসলাম। এখন তুমি করছো কি?’
‘মকুপিয়া স্বর্ণখনিতে কাজ করছি। দিনে আঠারো বলিভার পাই। কিন্তু আমি এখন যে কোন জায়গায় যাওয়ার অনুমোদন পেয়েছি; আমার বাধ্যতামূলক আবাসন শেষ হয়েছে। ’
‘বাজি রেখে বলতে পারি, ক্যারাকাসে গিয়ে মুক্ত জীবন আস্বাদন করতে চাচ্ছো তুমি।
কিন্তু ক্যারাকাস, বিশাল শহর, ওখানে নয়-ছয় করে কিছু হাতাতে যাওয়া বিরাট ঝুঁকির কাজ, তারচেয়েও বড় কথা-- তুমি মাত্র ছাড়া পেয়েছো, আর এক্ষুণি আবার ভিতরে ঢুকতে চাইছো না তো?’
আমার একটা বিরাট ঋণ আছে ওই হারামজাদাদের কাছে যারা আমার এই অবস্থার জন্য দায়ী-- শূকর শাবক পুলিশ, ভুয়া সাক্ষীর দঙ্গল আর আইনজীবীর পাল তের বছরব্যাপী দীর্ঘতর এক দুঃস্বপ্নের কারাজীবন আমার নসিবে বরাদ্দ করেছে এমন এক অপরাধের জন্যে যা আমি কখনো করিনি। বন্দিশালার ওই দ্বীপগুলো, তোমার দৃষ্টিতে সেগুলো যাই হোক, এরপর সেন্ট জোসেফের নির্জন কারাবাস যেখানে কর্তৃপক্ষের কল্পনার সবচেয়ে বিভীষিকাময় নির্যাতনগুলো করা হয়েছে আমার ওপর। আর একথা ভুলে যেওনা যে যখন ওরা আমাকে গ্রেফতার করে তখন আমি মাত্র চব্বিশ বছরের এক যুবক ছিলাম।

‘ভয়ঙ্কর, অর্থাৎ তারা তোমারÑতারুণ্যের সবটুকু গায়েব করে দিয়েছে। নিষ্পাপ, সত্যিই নিষ্পাপ, কসম খেয়ে বলো, নাকি এখনো চাপাই ঝাড়ছো?’
‘নিরপরাধ, জো জো। আমি আমার মরা মায়ের নামে কসম খেয়ে বলছি। ’
‘যীশু, বুঝতে পারছি, দেখা যাচ্ছে ব্যাপারটা তোমার বুকে জগদ্দল পাথরের মত চেপে আছে। এক্ষেত্রে আমি তোমার ক্যারাকাসে যাওয়াটা জরুরি মনে করছি না। যদি তোমার প্রতিশোধ নেওয়ার খেলাটা মজবুত করতে চাও-- আস আমার সঙ্গে। ’
‘কি জন্যে?’
‘হীরা, বন্ধু হীরা! এখানকার সরকার খুব উদার। পৃথিবীতে এটাই একমাত্র দেশ যে দেশে তুমি যেখানে খুশি সেখানে স্বর্ণ অথবা হীরার খোঁজে স্বাধীনভাবে খোঁড়াখুড়ি করতে পারো। শর্ত শুধু একটাই : কোন মেশিনারি ব্যবহার করা যাবে না। স্রেফ বেলচা, খুন্তি আর চালুনি-- ব্যস, এগুলোই তুমি ব্যবহার করতে পারো এই কাজে। ’
‘এই সত্যিকারের এলডোরাডোটা কোথায়? আশা করছি যেই এলডোরাডো থেকে আমি এসেছি এটা সেই এলডোরাডো নিশ্চয় নয়। ’
‘তবে রাস্তা অসম্ভব কঠিন। জঙ্গলের বিপদসঙ্কুল পথে বেশকিছু দিন গাঁধার পিঠে চলতে হবে, এরপর ক্যানোতে (নৌকা) এবং তারপর পায়ে হাঁটা, সঙ্গে তোমার মালপত্রের বোঝাসহ। ’
‘তার মানে মূলো অনেক দূরে, একেবারে ছেলেখেলা নয়। ’
‘দেখ, প্যাপিলন, মোটা দান মারার এটাই একমাত্র সুযোগ। মাত্র একটা দান মারতে পারলেই তুমি ‘তুমি’ হয়ে যাচ্ছো, একজন বিত্তবান মানুষ-- এমনই ধনবান যার হারেমে রূপবতী নারী সিল্কের বিছানায় শুয়ে হুঁকোয় মুখ দিয়ে ধোয়ার কুণ্ডলী বানায়। অথবা তোমার দৃষ্টিতে এমন এক মালদার যে নিজের ঋণ শোধ করতে (প্রতিশোধ নিতে) পুরোপুরি সক্ষম। ’

এখন সে পুরো তোড়ে আছে; তার চোখদুটো ঝকঝক করছ; জো জো পূর্ণ তেজে জ্বলে উঠেছে, সম্পূর্ণ উদ্ভাসিত। একটা দাও, তার কথামত-- এবং আমি খনিতে অন্যদের কাছেও শুনেছি-- মাটিতে টিলার মত দেখতে ক্ষুদ্র একটা ঢিবি, কৃষকের রুমালের পুটলির মত অনেকটা, এরকম যে কোন ঢিবিতে প্রকৃতির অজানা খেয়ালে একশ, দুইশ’ পাঁচশ’ এমনকি একহাজার ক্যারেট পরিমাণ হীরক দলা বেঁধে থাকে। যদি কোন অনুসন্ধানকারী কোথাও এরকম একটা গুপ্তধন পেয়ে যায়, হোক না সেটা নরকের গভীরে, খুব বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় না-- উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম সবখান থেকে দলে দলে পঙ্গপালের মত লোক আসতে শুরু করে দেয় সেখানে। অনেকটা যেন বাতাস থেকে তারা খবর পায়, প্রথমে জনা বারো, তারপর শ’খানেক, এরপরে--- হাজারে হাজারে। ক্ষুধার্ত কুকুর যেমন হাড় বা শুকনো মাংসেরও ঘ্রাণ পায় তেমনি তারা স্বর্ণ বা হীরকের ঘ্রাণ পায়। দশদিক ছেয়ে ভেসে আসে গুপ্তধনের দিকে। লক্ষ্মীছাড়া টাইপের কর্মহীন লোক যারা দৈনিক বারো বলিভারে শ্রম দেয় সন্তুষ্ট চিত্তে, তারাও এই খবরে উদাস হয়ে যায়, এবং জঙ্গলের ডাকে সারা দিয়ে ছুট লাগায়। তারা চায়না তাদের পরিবার-পরিজন ছা-পোষা হয়ে বেঁচে থাকুক, তাই তারা নোঙ্গর ছেঁড়ে, কষ্টকর সাধনায় ঝাঁপ দিতে যাচ্ছে জেনেশুনেই।

সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত প্রতিকূল আবহাওয়া আর বিরুদ্ধ পরিবেশে অমানুষিক পরিশ্রম করে, বছরের পর বছর নারকীয় কষ্ট আর শ্রমের নরকে নিক্ষেপ করে নিজেদের। কিন্তু ফলশ্রুতিতে তারা যা নিয়ে ঘরে ফেরে তাতে করে তার বউ ছোটখাট ছিমছাম একটা বাড়িতে ঘুমোতে পারে নিশ্চিন্তে, বাচ্চারা ভাল খাওয়া আর ভাল পোশাক পায় এবং তারা স্কুলেও যায়-- এমন কি নিজের পছন্দানুযায়ী উচ্চমানের শিক্ষাও পেতে পারে।
‘অর্থাৎ একটা গুপ্তধনের দান এইসব উপহার দেয়?’

[চলবে]

বাংলাদেশ সময় ১৮৪৪, অক্টোবর ৩০, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।