ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

সুফিয়া কামালের একাত্তরের দিনলিপি

ভূমিকা : ফেরদৌস মাহমুদ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৩৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৯, ২০১১
সুফিয়া কামালের একাত্তরের দিনলিপি

  সওগাত’ পত্রিকায় ‘বাসন্তী’ নামের একটি কবিতার মধ্য দিয়ে ১৯২৬ সালে সাহিত্যাঙ্গনে যাত্রা শুরু সুফিয়া কামালের

ত্রিশের দশকের শুরুর দিকে কলকাতায় তিনি পরিচিত হয়ে যান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম শরৎচন্দ্রের মত মহান সাহিত্যিকদের সাথে।



১৯৩৮ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘সাঁঝের মায়া’বইটির মুখবন্ধ লিখে দিয়েছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। বইটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ অনেক বিদগ্ধজনের প্রশংসা কুড়ায়।  

 

সুফিয়া কামাল জন্মগ্রহণ করেন ১৯১১ সালের ২০ জুন প্রয়াত হন ৮৮ বছর বয়সে ১৯৯৯ সালের ২০ নভেম্বর।

সফিয়া কামালের উল্লেখযোগ্য অন্যান্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে :  গল্প সংকলন--  কেয়ার কাঁটা (১৯৩৭), কাব্যগ্রন্থ- মায়া কাজল (১৯৫১), মন জীবন (১৯৫৭), শান্তি প্রার্থনা (১৯৫৮), উদাত্ত পৃথিবী (১৯৬৪), দিওয়ান (১৯৬৬), মোর জাদুদের সমাধি পরে (১৯৭২)ভ্রমনকাহিনী-  সোভিয়েতে দিনগুলি (১৯৬৮) এবং স্মৃতিকথা-একাত্তুরের ডায়েরি (১৯৮৯)

১৯৭১ সালে লেখা সুফিয়া কামালের দিনলিপিতে উঠে এসেছে একাত্তরের যুদ্ধকালীন সময়ের যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের নানা মুহূর্ত। যা ওই সময়ের আতঙ্কগ্রস্ত, বিধ্বস্ত জীবনকে উপলব্ধি করতে পাঠকদের সহায়তা করে। দিনলিপি লেখা প্রসঙ্গে সুফিয়া কামাল লিখেছিলেন ‘মুক্তিযুদ্ধের নয়টি মাস আমি বারান্দায় বসে বসে দেখেছি পাকিস্তানী মিলিটারীর পদচারণা। আমার পাশের বাসায় ছিল পাকিস্তানী মিলিটারীরর ঘাঁটি। ওখানে দূরবীন চোখে পাকবাহিনীর লোক বসে থাকতো। রাস্তার মোড়ে, উল্টো দিকের বাসায় সবখানে ওদের পাহারা ছিল। ’

বছর পালিত হয় সুফিয়া কামালের জন্ম শতবর্ষ। এ উপলক্ষে তার জন্মদিনে আমরা ছেপেছিলাম  ১৯৭১ সালে লেখা তার জন্মমাসের দিনলিপি।

 

এবার ২০ নভেম্বর সুফিয়া কামালের প্রয়ানদিবসকে সামনে রেখে তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বাংলানিউজের পাঠকদের সামনে তুলে ধরা হলো সুফিয়া কামালের একাত্তরের নভেম্বরে লেখা দিনলিপির  পুরোটাই 

 

 

 

sufia kamal১৯৭১

৪ নভেম্বর, বৃহস্পতিবার

 

আজ দুলুর ফোন পেলাম। ওরা ভালো আছে। আল্লাহর কাছে শোকর। কবে কার সাথে যে কোথায় দেখা হবে জানি না। বেঁচে থাক, ভালো থাক, খবর পাই তাই কত সান্ত্বনা। বিব্বুর খবরও পেলাম। ওরা জীবনে সুখী হোক। সারা দেশময় কি তাণ্ডব লীলা আজও চলছে। কবে আল্লাহ এর অবসান করবেন, কে জানে।

 

৫ নভেম্বর, শুক্রবার ১৯৭১

 

রাত ৮টা

আজ ফজরের নামাজ পড়ে শুয়েছি, ৫টা বেজে গেল, ঘুম এল স্বপ্নে দেখলাম, লুলু টুলু খুশী হয়ে বলছে, মা আনিস ভাই এসেছেন। দেখলাম আনিস তার বড় মেয়েটিকে নিয়ে এসে ক্লান্তিতে শুয়ে পড়ল। মেয়েটির হাতে একটা ভুট্টা, চঞ্চল মেয়েটি। সেটা পুড়িয়ে খাবে বলে আবদার করছে। দাদী ছিলেন। তিনি নিয়ে গেলেন রান্না ঘরে ভুট্টাটি পুড়িয়ে দিতে, আনিসকে জিজ্ঞাসা করলাম, এতদিন কোথায় না ঘুরলাম। অনেক কথা বল্লেন, যদি আল্লাহ বাঁচিয়ে রেখে আবার দেখা করবার সময় দেন, সবকথা বলা ও শোনা হবে। স্বপ্নের সত্যতাও প্রমাণ হবে, এই আশা করে আছি।

 

৭ নভেম্বর, রবিবার ১৯৭১

 

গতকাল সন্ধ্যা ৭টায় ও আজ সন্ধ্যা ৬টার সোভিয়েত বিপ্লব দিবস উৎসব উপলক্ষে ১২ নং রাস্তা ও গুলশানের রিসেপশন সমাবেশে যোগদানের জন্য গেলাম। অনেকের সাথে দেখা হলো। আজ বৌমা নার্গিস জাফর হোস্টেলে গেলো। কি যে দুঃখ বোধ হচ্ছে, রোজ সন্ধ্যায় যে আসত হাসি মুখটি নিয়ে, আর কবে যে আসবে, কে জানে, রোজ ত আসতে পারবে না। মেয়েরা ছেলেরা দূরে; বৌমাটাও দূরে চলে গেল। ভালো হোক, ভাল থাকুক সবাই এই-ই প্রার্থনা আল্লাহর কাছে।

 

৮ নভেম্বর, সোমবার ১৯৭১

 

আজ হেনা এল, টাকাটা দিয়ে বাঁচলাম। লন্ডন থেকে বুড়নের চিঠিতে জানলাম, ওরা তিন বোন রেনু খালার বাড়ী বেড়িয়ে এল এক সপ্তাহের ছুটিতে। আল্লাহ ওদেরে শরীর স্বাস্থ্য রুজী হায়াত ইজ্জত রক্ষা করুন এই দোয়া করি। বৌমা ফোন করেছিল। কি নিঃসঙ্গ যে সন্ধ্যাটা লাগে। কাল রাতে নেপুর ৩টা বাচ্চা হয়েছে। যে খুশী হত আজ কাছে নেই। আল্লাহ যেন আবার খুশীতে হাসিতে অবলা পশুর দরদীকে এনে দেন।

 

১৩ নভেম্বর, শনিবার ১৯৭১

 

এতদিন, কতদিন পর, আজ একটু হাতে লেখা পেলাম-- ৩ তারিখে লেখা। আজ দেখে তবু মনটা কত তৃপ্তি লাভ করল। আল্লাহ তুমি নেগাহবান। আরতুকে ফিরিয়ে দাও। রুমী ইকু কে কোথায় আছে। মায়ের বুকে তোমার রহমত বর্ষণ কর ওরা বাছাদের বুকে যেন পায়।

 

 

১৪ নভেম্বর, রবিবার ১৯৭১

 

আজ দুপুরে আবার একটু তন্দ্রার মধ্যে যে স্বপ্ন দেখলাম। বহু দিন পর ‘ও’ এসে আমাকে নিয়ে যেতে চাইল। গেলাম না। স্বামী সন্তানকে রেখে যেতে পারি না ত। কি গভীর মমতায় মাথায় একটি চুমু রেখে ও চলে গেল। ও-কে তাও জানি না, অথচ কত যুগ থেকে সে আছে, আসে স্নেহে প্রেমে মমতায় মধুর হয়ে।

 

 

http://www.banglanews24.com/images/PhotoGallery/2011November/sufia 3320111119133056.jpg১৭ নভেম্বর, বুধবার ১৯৭১

 

আজ কি দিন! আজ ২৭ শে রমজান, রোজার মাসের শ্রেষ্ঠ দিবস। কালরাত গেছে হাজার রাতের চেয়ে শ্রেষ্ঠ রাত। আর রাত পোহালে আজ সকাল বেলা ৮টায় হারালাম আমার শ্রেষ্ঠ ধনকে। আমার বাপ আমার দুলুর জীবনের সাথী, আমার আদরের গৌরবের ধন জামাই কহ্হার চাটগাঁর রেডিও অফিসে যাবার পথে গুলী খেয়ে আজ চিরতরে ছেড়ে গেল তার দুলুকে, তার সন্তানদের, তার মা বোনকে আমাকে। আজ ৫টা থেকে ঢাকায় কারফিউ। কোনো মতেও একটা টিকিট পেলাম না আমার বাবার মুখখানি শেষ দেখা দেখতে চাটগাঁ যাবার জন্য। ফোন। শুধু ফোনে ফোনে খবর পেলাম সব শেষ। বেলা ২টায় শাহ্ গরিবুল্লাহর মাজারে আমার বাবা শুয়ে থাকল গিয়ে। আল্লাহ! তুমি আছ ত? কি করলে? কি চেয়েছিলাম তোমার কাছে? এই তোমার বিচার? এই তোমার দান?

 

 

২৭ নভেম্বর, শনিবার ১৯৭১

 

আজ ১-১০-এর প্লেন এ চাটগাঁ থেকে ফিরে এলাম। ১৮ তারিখে চাটগাঁ গিয়েছিলাম। এই ক-দিনের স্মৃতি কি করুণ, কি কাতর, কি যে অবর্ণনীয়। এই  ক’দিন পৃথিবী আমার কাছে মুছে গেছিল। আমার দুলুর সাদা কাপড়। আমার কওসর, মোরাদ, সিমিনের শোকার্ত মুখ। ‍জুনেদের বিষণ্ন ক্লান্ত অবসরহীন সমস্ত ব্যাপারকে গুছিয়ে করার চেষ্টা, আমার বাবার কবর, তার বৃদ্ধ মা, বিধবা বোনের আত্মীয়স্বজন, অনাত্মীয় বন্ধু-বান্ধবদের সমবেদনা সহানুভূতি সব ছাড়িয়ে আমার বাবার, আমার সাধের, গৌরবের জামাইয়ের শেষ শয়ন সমাধি দেখে এলাম। আরও কি যে বাকী আছে জানি না। আল্লাহ ওর সন্তানদের মানুষ করে দিন, এই প্রার্থনা।

 

 

সূত্র : একাত্তরের ডায়েরী- সুফিয়া কামাল

 

বাংলাদেশ সময় ১৩৩০, নভেম্বর ১৯, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।