ঢাকা, শনিবার, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

বনলতা সেনের সান্নিধ্য

ড. ফজলুল হক সৈকত | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৪৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ২২, ২০১১
বনলতা সেনের সান্নিধ্য

‘বনলতা সেন’ বোধ হয় জীবনানন্দ দাশের (১৮ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৯-- ২২ অক্টোবর ১৯৫৪) সবচেয়ে পাঠকপ্রিয় কবিতা। এ পর্যন্ত কবিতাটির নিবিড় পাঠ তেমন একটা হয়নি।

অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সমালোচক এটিকে প্রেমের কবিতা বিবেচনা করে খুঁজেছেন বনলতা নামক নারীর জন্ম-পরিচয়, পারিবারিক বৃত্তান্ত, কবির সাথে পরিচয়-সম্পর্ক আর মিলন-বিরহের ব্যাপারাদি। কেউ বলেছেন বনলতা কবির কাব্যলক্ষ্মী, কেউ বলেছেন নাটোরের অপরূপ সুন্দরী বনলতার সাথে কবির সাক্ষাৎ হয়েছিল নাটোরে বনলতাদের বাড়িতেই, কারো মতে বা কবি তাকে দেখেছিলেন কলকাতা যাবার পথে ট্রেনের কামরায়। নাটোর থেকে এক পরিবার একদা বরিশালে এসে জীবনানন্দদের বাড়ির পাশে স্থায়ী বসতি স্থাপন করে, সে পরিবারের যুবতীকন্যা বনলতার চোখে দৃষ্টি রেখে অভিভূত হয়েছিলেন কবি এমন ধারণাও প্রচলিত।

গবেষক-সমালোচক ছাড়াও সাধারণ জনমনেও বনলতা-বিষয়ক বোধ-আগ্রহের কমতি নেই। নাটোরে ‘বনলতা উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়’, ‘বনলতা ফিলিং স্টেশন’ প্রভৃতি সেবা ও বাণিজ্যমুখি প্রতিষ্ঠান দাঁড়িয়ে যাবার ব্যাপারটিও সচেতন পথিক-দর্শকের মনে কম আগ্রহ জাগায় না।
    
http://www.banglanews24.com/images/PhotoGallery/2011October/2514620111022154340.jpgবাস্তবিক অর্থে, কবিতাটিতে জীবনানন্দ অনেকগুলো বিষয়ের সমন্বয় ঘটিয়েছেন চিত্রশিল্পীর রঙ-প্রয়োগের চাতুর্যে। একটি সমতল ক্যানভাসে তিনি এঁকেছেন সভ্যতা আর জীবনের বিচিত্রসব প্রান্ত। হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্যের ডানায় ভর দিয়ে কবি অগ্রসর হয়েছেন মানুষের প্রত্যাশা-প্রাপ্তি, বিস্ময়-বিভ্রান্তি আর জীবন-অবসানের আহ্বানের দিকে। পথে স্পর্শ করেছেন রহস্যময়তা, অতিশব্দের মাহাত্ম্য, স্বস্তি এবং আনন্দের হাতছানি। বহুদিনের পরিক্রমায় অনেক গলি-বাঁক পেরিয়ে পথশেষের মোড়ে দাঁড়িয়ে জীবনানন্দ উপলব্ধি করেছেন মানবিক শূন্যতাবোধের গভীর-অবস্থান। পৃথিবীর নানান প্রান্ত আর পাহাড়-সমুদ্রের উচ্ছ্বাস অতিক্রম করে, ঐতিহ্যের সকল শক্তি ও সৌন্দর্য বিলীন হবার ইতিহাস কপালে এঁকে পথিককবি সন্ধান পেয়েছেন এক অনাবিষ্কৃত সত্যের; জাগতিক কৃত্রিম-কাঠামো শোভার অন্তরালে প্রকৃতির অকৃত্রিমতায়, তার ছায়াতলে রয়েছে ক্লান্তিমোচনের মহৌষধ। বনের লতা-পাতায় খুঁজে পেয়েছেন স্বস্তির সঠিক ঠিকানা। আর এই উপলব্ধি প্রকাশের জন্য তিনি নির্ভর করেছেন প্রতীক-প্রয়োগের ওপর। লতা-পাতার সঙ্গে জাগতিক বংশ-পদবি যুক্ত করে তার সৌন্দর্যকে দান করেছেন মানবীয় পরিচিতির প্রলেপ। স্থানের নাম জুড়ে দিয়ে আমাদের-- পাঠকের, সংশয় কিংবা বিশ্বাসকে বাড়িয়ে দিয়েছেন বহুগুণ।

সম্ভবত তাঁর সৃষ্ট স্বপ্নময়তার ভুবনে পাঠকের বিশ্বাসী বিচরণকে নিশ্চিত করতে চেয়েছেন তিনি এই কৌশল আরোপের মধ্য দিয়ে। কবিতাকে কিংবা শিল্প-সাহিত্যকে যদি আমরা বাজারের অন্যসব পণ্যের মতো  বিবেচনা করি, তাহলে দেখবো নিজের উৎপাদিত পণ্যের বাজারজাতকরণের জন্য জীবনানন্দের মার্কেটিং পলিসির কী দারুণ প্রয়োগ। আর তাইতো, “বনলতা সেন” শেষপর্যন্ত বাজারে অবিক্রিত আইটেম হয়ে পড়ে থাকে না; বিকোচ্ছে সন্তোষজনক মূল্যে; দাম পাচ্ছে বিচিত্র ও ইতিবাচক বহুতর মূল্যায়নের পথ ধরে। কবি জীবনানন্দের বর্ণনা-চতুরতায় সাধারণ দৃশ্যবস্তু ধারণ করেছে মানবীয় অস্তিত্ব। আর তখনই, তাঁর বিবরণ ইতিহাস না হয়ে হলো কবিতা আর পাঠকের জন্য পাঠ-বিভ্রান্তির পূর্ব-অনির্ধারিত পরিপ্রেক্ষিত। জীবনানন্দের বিমুগ্ধ পাঠক বনলতারূপী রমণীর অন্বেষায় আজও কেবল দোল খেতে থাকে কবির সভ্যতাক্লান্ত-বিবৃতির নাগরদোলায়।

“বনলতা সেন” কবিতাটির শুরু এরকম:

হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।

দূর ‘সিংহল সমুদ্র’, ‘মালয় সাগর’, ভারতবর্ষের প্রাচীন রাজা অশোক আর বিম্বিসার এবং এ অঞ্চলের অতি-প্রাচীন ‘বিদর্ভ নগর’ পারি দিয়ে কবি প্রবেশ করেছেন বিশ শতকের প্রথমার্ধে বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যিক ধস, ফলত চাকরিবাজারে অনিশ্চয়তাঘেরা জীবনযন্ত্রণায়। ব্যক্তিগত জীবনের অর্থনৈতিক টানাপড়েন আর সমাজ-রাষ্ট্রের সমূহ বিপদ তাঁকে বিচলিত-বিভ্রান্ত করে তুলেছিল। বিশ্ব আর্থ-রাজনৈতিক আবহ তখন জীবনানন্দের কবিতার শরীরে ঢুকে পড়ে স্বাভাবিক উপাদান ও শক্তি হিসেবে।

অতঃপর কবি যাপিতজীবনে চলার পথে মোহাচ্ছন্নতা আর বিভ্রান্তির কথা লিখেছেন ঐতিহ্যের নিবিড় পতনের ধ্বনি-মাধুর্যে। কবিতাটির দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে গিয়ে পুরুষপাঠক পড়ে দারুণ মুশকিলে। হারিয়ে-যাওয়া সভ্যতার গভীর অন্ধকার আর প্রিয়তমার চুলের কালোর অতলতার বিভ্রমে আটকে যায় তার চিন্তন-বিলোড়ন। প্রাচীন নগরী ‘বিদিশা’ তখন তার বস্তু-পরিচয় ঝেড়ে ফেলে নারীর কোমলকান্তির মোড়ক পরিধান করে নেয়; পথভোলা পথিককে দিক-নিশানা বাতলে দিতে-আসা অভিভাবকের দায় ও দায়িত্ব গ্রহণ করে।

প্রেমকাতর কবিতা-পাগল হৃদয়ের জন্য কবি নির্মাণ করেন ভালোবাসা আর আশ্বাসের বিরাট ভূমি। জীবনানন্দ লিখছেন:

চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের ‘পর
হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’
পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।
(বনলতা সেন)

তিরিশি (বিশ শতকের তৃতীয় দশকের) কবিদের বড় সাফল্য তাঁরা প্রেম ও প্রেমিকাকে কল্পনার রঙিন আকাশের ধোঁয়াশা থেকে বাস্তবে নামিয়ে আনতে পেরেছেন; জীবনানন্দেও তার ব্যতিক্রম দেখা যায় না, বরং তাঁর বিবরণে সে উপস্থিতি যেন আরো উজ্জ্বল এবং নিকটতর। শুদ্ধ প্রেম ও নিষ্ঠায় বাঙালির বিশ্বাস রয়েছে; তারা প্রেমিক বা প্রেমিকার জন্য হৃদয়ের সবচেয়ে গোপন ও প্রিয় অধ্যায়টি অতিযত্নে সংরক্ষণ করতে ভুল করে না। মানুষ বারবার প্রেমে পড়তে পারে; আবার কেবল একজনকে ঘিরেও আবর্তিত হতে পারে তার প্রেমের ঘর-বারান্দা। কবিরাও তাই প্রেমের কবিতায় অনেকের ছবি যেমন আঁকতে পারেন; তেমনি একজনকে নিয়েও লিখতে পারেন অনেক কবিতা।

জীবনানন্দের বনলতাকে নিয়ে আমাদের যেমন রয়েছে হাজারো প্রশ্ন ও সংশয়; জীবনানন্দের মনেও বারবার ছায়া ফেলেছে বনলতার মুখ (না-কি ছায়া কিংবা মায়া!)। একটি উপন্যাসে এবং পরে পাঁচটি কবিতায় তিনি বনলতাকে হাজির করেছেন নানানভাবে ও ভঙ্গিতে। কারুবাসনা (রচনাকাল: ১৯৩৩) উপন্যাসে জীবনানন্দ লিখেছেন:

‘সেই বনলতা-- আমাদের পাশের বাড়িতে থাকতো সে। কুড়ি-বাইশ বছরের আগের সে এক পৃথিবীতে: বছর আষ্টেক আগে বনলতা একবার এসেছিল। দক্ষিণ শনের ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে চালের বাতায় হাত দিয়ে মা ও পিসিমার সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বলল সে। তারপর আঁচলে ঠোঁট ঢেকে আমার ঘরের দিকেই আসছিল। কিন্তু কেন যেন অন্যমনস্ক নত মুখে মাঝপথে গেল থেমে, তারপর কিড়কির পুকুরের কিনারা দিয়ে, শামুক গুগলি পায়ে মাড়িয়ে, বাঁশের জঙ্গলের ছায়ার ভিতর দিয়ে চলে গেল সে। নিবিড় জামরুল গাছটার নিচে একবার দাঁড়াল, তারপর পৌষের অন্ধকারের ভিতর অদৃশ্য হয়ে গেল।
তারপর তাকে আর আমি দেখিনি।


বাঙালি জীবনে প্রেমের অবকাশ ও সম্ভাবনা সংকীর্ণ বলে অনেক সময় কল্পনার নারীকে নিয়েও রচিত হয়েছে প্রেমের কবিতা; সামনে কেউ নেই, হয়তো কখনো ছিল না, তবু কবি তাঁর রক্তমাংসস্বপ্নের প্ররোচনায় লিখতে থাকেন কম্পমান পদাবলি। তাই বাঙালির কবিদের দয়িতার নাম আমাদের কাছে অজানা কিংবা অস্পষ্ট রয়ে যায়; যেমনটা জানা যায় কীটস- বোদলেয়ার বা রিলকের প্রেমিকা বা প্রেমিকাদের নাম। জীবনানন্দ কার বা কাদের উদ্দেশ্যে লিখেছিলেন যন্ত্রণা ও মধুমাখা কবিতাবলিতে এমন প্রশ্নের কোনো উত্তর মেলে না।

জীবনানন্দের কবিতায় আছে কল্পনামাখা প্রেমের অবারিত শস্যভূমি। এই প্রেমিক-কবি প্রেমকে জীবনের মতো গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছিলেন;  তাঁর কাছে প্রেম কোনো বিশেষ বয়সের সাময়িক উন্মাদনা ছিল না তা ছিল জীবনেরই নামান্তর ও রূপান্তর। জীবনের যাবতীয় সাফল্য-ব্যর্থতায় প্রেমবিষ বা প্রেম-অমৃতে তাঁর অবিচল আস্থা; তিনি বিশ্বাস করতেন সময়ের অন্ধকার দূর করতে পারে কেবল প্রেমিকার দেহসূর্য। জীবনানন্দ তাঁর দয়িতাদের সবচেয়ে শরীরী কিংবা অশরীরী করে তুলেছিলেন নাম ধরে ডেকে ডেকে; বনলতা সেন, অরুণিমা সান্যাল, সুদর্শনা, সুরঞ্জনা প্রভৃতি নাম তাঁর দয়িতাদের নারী (শরীরী) নয়, নিসর্গের (অশরীরী) গোত্রভুক্ত করেছে। বনলতা সেনের সৌন্দর্য: “চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা/ মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য। ”-- এ বিবরণে বনলতা হয়ে উঠেছে প্রাচীন ধূসর ভারতীয় ইতিহাসের মতো বিমূর্ত, আর প্রাচীন ভাস্কর্যের মতো নিষ্প্রাণ। বনলতা এমন এক নারী, যাকে নাটোরের পিচঢালা বা ধূলোমাখা রাস্তায় দেখা যায় না; শয্যায় পাওয়া যায় না-- শুধু সন্ধ্যার নির্জন অন্ধকারে নির্বাক মুখোমুখি বসে থাকে অদৃশ্য-অধরা নারীর অস্পষ্ট ছবি হয়ে।

বনলতার সাথে জীবনানন্দের পরিচয় কিংবা জানা-শোনা থাকা-না-থাকা নিয়ে রয়েছে অনেক বিতর্ক, অনেক আশা-নিরাশার দোলা। সত্যিকার অর্থে কবির কল্পনায়, সংসার ও পৃথিবীর যাবতীয় যাতনা থেকে মুক্তির কিংবা পলায়নের অভিপ্রায়ে, এক মোহনীয় নারীর রূপকল্প জেগে থাকতে দেখা যায় নানানভাবে। জন্ম-জন্মান্তরে যার সাথে পথ চলা যায়, এমন এক স্বপ্নমানবীর রূপ তিনি বারবার ভেবেছেন; হয়তো পৃথিবীর আলো-বাতাসে খুঁজেছেনও তাকে। মাঝে মাঝে তাঁর কল্পনায় সাজানো নায়িকার মতো দেখতে কাউকে দেখে চমকে উঠেছেনও বোধহয়; কিন্তু শরীরী বনলতাকে তিনি দেখেননি কখনো; ছুঁয়ে দেখাতো স্বপ্ন মাত্র। বাস্তবে এই অদেখা কোনো এক বনলতাকে নিয়ে কবির অভিব্যক্তি প্রকাশ পেয়েছে “একটি পুরনো কবিতা”য়।

জীবনানন্দ লিখেছেন:

আমরা মৃত্যুর থেকে জেগে উঠে দেখি
চারিদিকে ছায়া ভরা ভিড়
কুলোর বাতাসে উড়ে খুদের মতন
পেয়ে যায়-- পেয়ে যায়-- অণুপরমাণুর শরীর।

একটি কি দুটো মুখ-- তাদের ভিতরে
যদিও দেখিনি আমি কোনো দিন-- তবুও বাতাসে
প্রথম জানকীর মতো হয়ে ক্রমে
অবশেষে বনলতা সেন হয়ে আসে।

যদিও জীবনানন্দ তাঁর “দু’জন” কবিতায় লিখেছেন: পৃথিবীর পুরনো পথের রেখা হয়ে যায় ক্ষয়/ প্রেম ধীরে মুছে যায়। ” কিন্তু বনলতার প্রসঙ্গে তিনি প্রেমের অমরতাকে এক রকম প্রশ্রয়ই দিয়েছেন বলা চলে। দুনিয়ার তাবৎ সভ্যতা আর বিস্ময় কিংবা অধরা আনন্দের আড়ালে কবি দেখেছেন না-পাওয়া কোনো এক শুভবোধের ছোঁয়া। আর সে আদরের মৃদু প্রলেপে জুড়ে দিয়েছেন বনলতার কোমল হাত। পথে পথে যেন জীবনানন্দ বিজ্ঞাপনের বোর্ডে লাগিয়ে দিয়েছেন বনলতার মুখ কিংবা মুখের আদলে গড়ে-ওঠা অবিবরণীয় ছবি। ক্লান্তিহীন পথ চলার আর অন্তহীন আনন্দের সাথী হিসেবে যে মানুষকে (অবশ্যই বিপরীত লিঙ্গের) পাওয়া যায় বা মনে মনে ভাবা যায়, সে নারীর মোহময়তা যেন এই নিবিড় প্রেমলগ্ন কবির জীবনে বারবার বনলতার মুখ হয়ে ভেসে ওঠে। অন্য একটি কবিতায় জীবনানন্দ বনলতাকে তুলে ধরছেন এভাবে:

বনলতা সেন, তুমি যখন নদীর ঘাটে স্নান করে ফিরে এলে
মাথার উপরে জ্বলন্ত সূর্য তোমার,
অসংখ্য চিল, বেগুনের ফুলের মতো রঙিন আকাশের পর আকাশ
তখন থেকেই বুঝেছি আমরা মরি না কোনো দিন
কোনো প্রেম কোনো স্বপ্ন কোনো দিন মৃত হয় না
আমরা পথ থেকে পথ চলি শুধু-- ধূসর বছর থেকে ধূসর বছরে--
আমরা পাশাপাশি হাঁটতে থাকি শুধু, মুখোমুখি দাঁড়াই:
তুমি আর আমি।
কখনো বা বেবিলনের সিংহের মূর্তির কাছে
কখনো বা পিরামিডের নিস্তব্ধতায়
কাঁখে তোমার মাদকতাময় মিসরীয় কলসি
নীল জলের গহন রহস্যে ভয়াবহ...
(বাঙালি পাঞ্জাবি মারাঠি গুজরাটি)

http://www.banglanews24.com/images/PhotoGallery/2011October/prochhod-banolata-web20111022154358.jpgবাস্তবের নারী নয় বনলতা; কল্পনার শোভন ঘরে তার সামনে কেবল নির্জন অবসরে নির্বাক বসে থাকার অভিনয় করা চলে। হাত বাড়ালে তাকে ধরা যায় না। চোখ মেললে তাকে দেখা যায় না। অবশ্য এমনও হতে পারে জীবনানন্দ যে নারীকে কল্পনার দয়িতারূপে ভেবেছেন, এরকম কেউ হয়তো কোনো কালে ছিল; হয়তো মরে গেছে বহু আগে। তার অপেক্ষায় হয়তো বহুকাল স্টেশনে ট্রেনের প্রতীক্ষায় যাত্রীর মতো অমিত সময় পার করেছেন কবি। কিংবা মনের টানাপড়েনে পুড়ে পুড়ে মরেছেন, মনের মতো হৃদয়ের রানীকে না-পাবার যাতনায়। কে জানে কী রকম এক নারীর জন্য সারাটা জীবন ধরে হাহাকার করতে হয়েছে নীরব-অন্তর্মুখি এই জীবনানন্দকে; কে বলতে পারে, হয়তো ওই নারীর জন্য জীবনের সব আনন্দ বিসর্জনও দিয়েছেন কবি কুসুমকুমারী দাশের স্বপ্নপুত্র জীবনানন্দ (মা কুসুম লিখেছিলেন: আমাদের দেশে কবে সেই ছেলে হবে/ কথায় না বড়ো হয়ে কাজে বড়ো হবে!”)। জীবনের সব আনন্দ বাতাসে মিলিয়ে যেতে দেখা কবি তাই, ঘোরের মধ্যে, লিখছেন “শেষ হ’ল জীবনের সব লেনদেন” কবিতা। এই কবিতায় আমরা জীবনানন্দের বনলতাকে দেখি গভীর রাতের অনুপস্থিতি-উপস্থিতির দোলাচলের রঙিন মোড়কে:

শেষ হ’ল জীবনের সব লেনদেন
বনলতা সেন।

কোথায় গিয়েছ তুমি আজ এই বেলা
মাছরাঙা ভোলেনি তো দুপুরের খেলা
শালিখ করে না তার নীড় অবহেলা
উচ্ছ্বাসে নদীর ঢেউ হয়েছে সফেন,
তুমি নাই বনলতা সেন।

তোমার মতন কেউ ছিল না কোথাও?
কেন যে সবের আগে তুমি চলে যাও।
কেন যে সবের আগে তুমি
পৃথিবীকে করে গেলে শূন্য মরুভূমি
(কেন যে সবার আগে তুমি)
ছিঁড়ে গেলে কুহকের ঝিলমিল টানা ও পোড়েন,
কবেকার বনলতা সেন।

কত যে আসবে সন্ধ্যা প্রান্তরে আকাশে,
কত যে ঘুমিয়ে রবো বস্তির পাশে,
কত যে চমকে জেগে উঠব বাতাসে,
হিজল জামের বনে থেমেছে স্টেশনে বুঝি রাত্রির ট্রেন,
নিশুতির বনলতা সেন।

কবির জীবনে বনলতার উপস্থিতি-অনুপস্থিতি বিষয়ে সকল প্রশ্নের মধ্যে জড়িয়ে আছে প্রেম কিংবা স্বপ্নভঙ্গের অথবা বিরহের ব্যাপারাদি; স্ত্রী লাবণ্যের সাথে কবির সাংসারিক সাফল্য-ব্যর্থতার কতোসব গল্প। আবার পাশাপাশি আছে পৃথিবীর তাবৎ মানুষের স্বপ্নভঙ্গের না-বলা কাহিনি। বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের কবি ভারতচন্দ্র যখন লিখেছিলেন: “আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে”, তখন নিশ্চয় তিনি নিজের সন্তানাদির জন্য নয়-- দেবীর কাছে জগতের সকল মানুষের কল্যাণ কামনা করেছিলেন।

তাহলে জীবনানন্দও কি বনলতার অস্পষ্ট মুখচ্ছবি আঁকতে গিয়ে পৃথিবীর সব প্রেমবঞ্চিত বা বিরহকাতর প্রেমিক-পুরুষের মনোযন্ত্রণাকে রূপ দিতে চেয়েছেন? কে জানে সে কথা! না-কি হাজার হাজার বছরের সভ্যতার পথে প্রকৃত অর্থে আমাদের মানসিকভাবে না-এগোবার গল্পই গেঁথে তুলেছেন তিনি। আর সে কারণেই বোধকরি, আবারো জীবনানন্দের কবিতায় সভ্যতার বিবরণে ভেসে ওঠে বনলতার মুখ; তার ছবি।

কবি লিখছেন:

হাজার বছর শুধু খেলা করে অন্ধকারে জোনাকির মতো:
চারিদিকে চিরদিন রাত্রির নিধান;
বালির উপরে জ্যোৎস্না দেবদারু ছায়া ইতস্তত
বিচূর্ণ থামের মতো: দাঁড়কাক;-- দাঁড়ায়ে রয়েছে মৃত, ম্লান।
শরীরে ঘুমের ঘ্রাণ আমাদের-- ঘুচে গেছে জীবনের সব লেনদেন;
“মনে আছে?” শুধাল সে-- শুধালাম আমি শুধু “বনলতা সেন?”
(হাজার বছর শুধু খেলা করে)

প্রবল ধ্বনিসচেতন কবি জীবনানন্দ বর্তমান কবিতায় অতিশব্দ শ্রবণের প্রাসঙ্গিকতা আর তাৎপর্য বিবৃত করতে চেয়েছেন মানুষের চেতন-অনুভূতিতে নাড়া দেবার প্রত্যাশায়। সাধারণের অশ্রবণীয় শিশির-পতনের শব্দ আর মৃত্যুর নিঃশব্দ আগমন-বার্তা কবিকে এক নীরব-অন্ধকারে নিয়ে হাজির করে যেন; কবি অনুভব করেন প্রকৃতির নিয়মতান্ত্রিক চালচিত্র, জীবজন্তুর নিয়তিতাড়িত জীবনযন্ত্রণা (না-কি মরণযন্ত্রণা!)।

আমাদের বাধ্যবৃত্তিজনিত অসহায়তার আড়ালে এই কবিতায় নির্মিতি পেয়েছে আশ্বাস-বারতা, আশ্রয়-ইঙ্গিত আর সবশেষের শেষে নিথর পৃথিবীর ভয়াবহ নির্জনতা; অন্ধকারে মুখোমুখো নিরালাপ দাঁড়িয়ে-থাকার নিষ্প্রয়োজনীয়তা। কবিতাকথকের অভিমত:
সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;
সব পাখি ঘরে আসে-- সব নদী-- ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।
(বনলতা সেন)

মানুষ যখন বিভ্রান্ত-দিকভ্রান্ত কিংবা আশ্রয়-হারা হয়ে পড়ে, তখন তার একটি নিশ্চিত ঠিকানা টিকে থাকে আপন মহিমায় পৃথিবীর অপ্রতিরোধ্য নিয়মে প্রকৃতির এই উদার জমিন তাকে দাঁড়াবার, দম নেবার স্থানটুকু করে দেয় নিঃসঙ্কোচে, গিভ অ্যান্ড টেক-এর শর্ত ছাড়াই। সভ্যতার অগ্রগমন আর চালচিত্রে ‘বনলতা সেন’ কবিতায় পরিবেশিত হয়েছে অন্ধকারের চিরন্তনতা, পৃথিবীর আসন্ন স্থিরতা, সৌন্দর্য-বিস্ময় আর মানবিক অনুভূতির জটিলসব বিষয়াদি।

বাংলাদেশ সময় ১৫০৪, অক্টোবর ২২, ২০১১ 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।