ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

উপন্যাস

নীল উড়াল: দশম পর্ব

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৫৩ ঘণ্টা, আগস্ট ৩০, ২০১৭
নীল উড়াল: দশম পর্ব নীল উড়াল

নায়ক ম্যাকগিল ভার্সিটির অধ্যাপক-লেখক-অভিবাসী বাংলাদেশি। ফরাসি সুন্দরী মার্গারেট সিমোনের প্রণোদনায় দেশে মাদকচক্র নিয়ে গবেষণাকালে ঘটনা মোড় নেয় রোমাঞ্চকর বাঁকে। আসে ধুরন্ধর বন্ধু-অস‍ৎ ব্যবসায়ী এনামুল, সুন্দরী স্টাফ রোকসানা, মধুচক্রের জেনিফার-মলি-পরী, ক্লিনিকের অন্তরালের মিসেস খোন্দকার, রমনার শফি মামা ও ফুলি, ‘উড়াল যাত্রা’র সাইফুল, বিড়ালের কুতকুতে চোখের তরুণ সাংবাদিক ফরমানউল্লাহ এবং ছোটখালার রহস্যময় মেয়ে অন্তরা। প্রেম ও বেঁচে থাকার যুগল উড়ালে কাহিনী আবর্তিত হতে থাকে।

১০.
খুবই খারাপ লাগছে। চারদিকের কষ্ট ও বিষণ্নতা মনে হয় আমাকেও মোষের মতো কালো মেঘের অন্ধকার বর্শা হাতে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।

এই স্মৃতি ও শৈশবের নস্টালজিক শহরে এখন কারা বাস করছে? এদের তো আমি চিনি না। প্রতিদিন চেনা রাস্তায় বের হয়ে বাড়িগুলো দেখি; অফিস, আদালত, ভবন দেখি। মনে হয় সবখান থেকে অদৃশ্য কালো চিমনি দিয়ে ভস ভস করে বের হচ্ছে পিঙ্গল ধোঁয়া। কষ্ট তৈরি হচ্ছে। এই শহর এখন কষ্টের অত্যাধুনিক ও স্বয়ংক্রিয় কারখানা।

নীল উড়াল: নবম পর্ব

মার্গারেটকে মেইল করেছিলাম। আশ্চর্য! মেয়েটি মনে হয় কম্পিউটারের সঙ্গেই ঘর-সংসার করে। তার মতো এতো দ্রুততম সময়ে কাউকে উত্তর দিতে আমি আজ পর্যন্ত দেখি নি। অন-লাইন লেডি! সে উত্তর দিয়েছে:

‘তোমার মনে অবস্থা বুঝতে পারছি। যে মাইন্ডসেট নিয়ে তুমি বহু বছর পর তোমার নিজের দেশে কাজ করতে গিয়েছো, সেখানে অবস্থা সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। তোমার মাইন্ডসেট ভেঙে গেছে। মনের উপর চাপ পড়ছে। এখন যদি তোমার মন শক্ত না রাখো, তবে তুমি কাজ করতে পারবে না। নিজেই আক্রান্ত হয়ে গেলে গবেষক বা চিকিৎসকের পক্ষে বড়ই বিপদ। সমস্যার সমাধানের চেয়ে নিজেই একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। তুমি সে-ই পালাবদলে আছো। বরং ভালো হয়, কয়েক দিন কাজ বন্ধ রাখো। অন্য কিছু পড়, ভাবো। তারপর সুস্থির হয়ে আবার কাজ করো। নানা চমকে তোমার কাজের লাইন অব অ্যাকশনকে গুলিয়ে ফেলবে না। আর হ্যাঁ, তোমাকে     একটি নতুন বিষয় পাঠাচ্ছি। ঘটনাটি আলেকজান্ডারের মৃত্যু নিয়ে। এতে নেশার কথা আছে। মৃত্যু, কষ্ট, হতাশার মধ্যে জীবনের     দীপশিখা রয়েছে। সময় করে পড়ে নিও। খুব ভালো থাকবে। ’

মার্গারেট মেয়েটি এত পজেটিভ। ফোর্সফুল। বিপদে কাজ করার কঠিন নার্ভ আছে তার। ওর চিঠি পড়ে বেশ ভালো লাগল। আলেকজান্ডারের ফাইলটা এখনই পড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। আমি মার্গারেটের পাঠানো ফাইল পড়তে থাকি:

...মানুষ আর বিভিন্ন পশু, পাখি, জন্তু, জানোয়ারের মধ্যে ফারাক কোথায়? সকলেই তো প্রাণী!  তারপরেও মানুষ আলাদা। বিবেকবান। এবং মানুষ অমর হতে চায়। পিপীলিকা চায় না। মাছি বা মশারাও চায় না। বিশ্ব ইতিহাসের সন্ধিক্ষণ নিয়ে ইতিহাসবিদ জোসিয়া ওবের গবেষণা করে অমরেচ্ছু মানুষদের নিয়ে একটি বই লিখেছেন। নাম ‘আই উইশ আই হ্যাভ বিন দেয়ার’। ভাবানুবাদ করলে দাঁড়ায়, ‘আমি আশা করি তোমাদের মধ্যে বেঁচে থাকব’। বইটিতে আলেকজান্ডারের কাহিনীটি চমকপ্রদ। মহাবীর আলেকজান্ডার যখন সিংহাসনে আরোহণ করেন, তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ২০। এত অল্প বয়সে সিংহাসন ও রাজকার্য সামলানো তাঁর পক্ষে কঠিন হয় নি। কারণ, লিওনিদাসের মতো একজন যোগ্য প্রশিক্ষকের কাছ থেকে তিনি শরীর বিষয়ে দীক্ষা লাভ করেছিলেন। মাত্র ১৩ বছর বয়সে দর্শন, নীতি শাস্ত্র, যুক্তি শিখেছিলেন মহান গ্রিক পণ্ডিত অ্যারিস্টটলের কাছ থেকে। মূলত এসব সুশিক্ষার কারণেই আলেকজান্ডার প্রচণ্ড শারীরিক দৃঢ়তা ও মানসিক শক্তির পরিচয় দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। পিতার মৃত্যুর পর পরই থিবিস আর এথেন্সের গ্রিকরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে মেসিডোনিয়ার এই তরুণ নৃপতির বিরুদ্ধে।

তারুণ্যের প্রাবল্যে আলেকজান্ডার এত দ্রুততার সঙ্গে প্রতিপক্ষকে দমন করতে তাদের দোরগোড়া এসে হানা দেন যে, তাঁরা বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না, স্বয়ং আলেকজান্ডার সদলবলে পৌঁছে গেছেন। এর পর থেকে পরবর্তী ১১ বছর তিনি সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য স্বদেশের বহুদূর উষ্ণ সমতল  থেকে সুদূরের হিন্দুকুশ পর্বতমালা পর্যন্ত ধাওয়া করে পৌঁছে যান। অনেক রাজা-বাদশাহ প্রতিরোধের চেষ্টা করে ছিন্ন-বিছিন্ন হয়ে যায় আলেকজান্ডার বাহিনীর আক্রমণে। অনেকেই পালিয়ে সরে যান, যে পথ দিয়ে তিনি আসছেন, সে পথ থেকে।

আলেজান্ডারের সেনাবাহিনী ইউরোপ থেকে এশিয়া পর্যন্ত ২১ হাজার মাইল পথ বিজয়ীর বেশে পরিক্রমণ করে। অবশেষে অনেক রাজ্য জয় করে তিনি নিজ গৃহের দিকে পা বাড়ান। ফিরে যেতে চান প্রিয় স্বদেশে। কিন্তু যাত্রার মাঝখানে প্রচণ্ড জ্বরে আক্রান্ত হলেন তিনি। তাঁকে নিয়ে যাওয়া হলো তৎকালীন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শহর পথিপার্শ্বের রূপকথার নগরী ব্যাবিলনের রাজপ্রাসাদে। কয়েক দিন আগেই রোগের লক্ষণ দেখা দিয়েছিল। তিনি যখন ব্যাবিলনে পৌঁছান, তখন একেবারেই নাজুক তাঁর অবস্থা। রাত জেগে নেশা গ্রহণ ও মদ্যপানের কারণে সম্ভবত রোগের মাত্রা বেড়ে যায়। তিনিও রোগের কবল থেকে সাময়িক মুক্তির জন্য নেশার কোলে আশ্রয় নেন।

এ অবস্থায় কিছু সময়ের জন্যে জ্বর খানিকটা প্রশমিত হলেও পরে তা প্রকট আকার ধারণ করে। তিনি নড়াচড়া করার শক্তি পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেন। তাঁর কথা বলার মতো শক্তিও আর অবশিষ্ট থাকে নি। তবে রাজকীয় সিলমোহর অঙ্কিত আংটিটি তাঁর উত্তরাধিকারী কোনও এক সেনাপতির হাতে পরিয়ে দেওয়ার মতো শক্তি তখনও তাঁর শরীরে ছিল। অই আংটিটি তিনি কাকে পরাতে চান, তা জানতে চাওয়া হলে তিনি নাকি ফিসফিস করে বলতে সক্ষম হয়েছিলেন, ‘যে সবচেয়ে শক্তিশালী’। তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বিকাল চারটা থেকে পাঁচটার মধ্যে কোনও এক সময়ে। তারিখটা ছিল খ্রিস্টপূর্ব ৩২৩ সালের ১১ জুন। তখন এই বিশ্বজয়ীর বয়স মাত্র ৩৩। তাঁর মৃত্যুশয্যায় উপস্থিত ছিলেন তাঁর সেনাদলের সদস্যরা, স্ত্রী ও খোজারা; মেসিডোনিয়া, গ্রিস, পারস্য ও স্থানীয় ব্যাবিলন বা আজকের ইরাকের মানুষ। কী কারণে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল, তা নিয়ে নানাজনের নানা মত রয়েছে। অনেকেই মনে করেন, আলেকজান্ডারের মৃত্যু হয় ম্যালেরিয়া বা টাইফয়েড জ্বরে; মদ বা মাদকের বিষক্রিয়া কিংবা পশ্চিম নীলনদ অঞ্চলের ভাইরাসে।

গুজব ছিল, মাদকের সঙ্গে ধীরে ধীরে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয় তাঁকে। হত্যাকারী হিসাবে অ্যান্টিপাটারের প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করা হয়। অ্যান্টিপাটার ছিলেন অত্যন্ত নামকরা একজন সেনা অধিনায়ক। আলেকজান্ডার যখন এশিয়ার উদ্দেশ্যে দেশ ছাড়েন, তখন অ্যান্টিপাটারের হাতে মূল রাজ্য মেসিডোনের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছিল। কথিত আছে, অন্তিম সময় টের পেয়ে মৃত্যুশয্যায় আলেকজান্ডার তাঁর সেনাপতিদের ডেকে বলেছিলেন, ‘আমার মৃত্যুর পর আমার তিনটি ইচ্ছা তোমরা পূরণ করবে। এতে যেন কোনও ব্যত্যয় না ঘটে। আমার প্রথম অভিপ্রায় হচ্ছে, শুধু আমার চিকিৎসকেরাই আমার কফিন বহন করবেন। আমার দ্বিতীয় অভিপ্রায়, আমার কফিন যে পথ দিয়ে গোরস্থানে নিয়ে যাওয়া হবে, সেই পথে আমার কোষাগারে রক্ষিত সোনা, রুপা ও অন্যান্য মূল্যবান পাথর ছড়িয়ে দিতে হবে। আমার তৃতীয় এবং শেষ অভিপ্রায়, আমার কফিন বহনের সময় আমার দুই হাত কফিনের বাইরে ঝুলিয়ে রাখতে হবে। ’ আলেকজান্ডারের মৃত্যুশয্যায় উপস্থিত লোকজন মহাবীরের এই অদ্ভুত অভিপ্রায়ে বিস্মিত হন। কিন্তু এ ব্যাপারে তাঁকে কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পাচ্ছিলেন না কেউ। তখন তাঁর একজন প্রিয় ও বিশ্বস্ত সেনাপতি তাঁর হাতটা তুলে ধরে চুম্বন দিয়ে রাজকীয় সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে বলেন, ‘হে মহামান্য, অবশ্যই আপনার সব অভিপ্রায় পূর্ণ করা হবে। কিন্তু কেন আপনি এই বিচিত্র অভিপ্রায় ব্যক্ত করলেন?’

দীর্ঘ একটা শ্বাস গ্রহণ করে আলেকজান্ডার মলিন মুখে মৃদ্যু হেসে বললেন, ‘আমি দুনিয়ার সামনে তিনটি শিক্ষা রেখে যেতে চাই। আমার চিকিৎসকদের কফিন বহন করতে বলেছি এ কারণে যে, যাতে লোকে অনুধাবণ করতে পারে চিকিৎসকেরা আসলে কোনও মানুষকে সারিয়ে তুলতে পারেন না। তাঁরা ক্ষমতাহীন এবং মৃত্যুর থাবা থেকে কাউকে রক্ষা করতে অক্ষম। গোরস্থানের পথে সোনা-দানা ছড়িয়ে রাখতে বলেছি মানুষকে এটা বোঝাতে যে, ওই সোনা-দানার একটি কণাও আমার সঙ্গে যাবে না। আমি এগুলো পাওয়ার জন্য সারাটা জীবন ব্যয় করেছি, কিন্তু নিজের সঙ্গে কিছুই নিয়ে যেতে পারছি না। মানুষ বুঝুক, ধন-সম্পদের পেছনে ছোটা সময়ের মস্ত বড় অপচয় মাত্র। কফিনের বাইরে আমার হাত ছড়িয়ে রাখতে বলেছি মানুষকে এটা জানাতে যে, খালি হাতে আমি এই পৃথিবীতে এসেছিলাম, আবার খালি হাতেই পৃথিবী থেকে চলে যাচ্ছি। ’...

মার্গারেটের ফাইল অনেক বড়। এতটুকু পড়ার পর অনেক তথ্যের ভিড়ে ভেতরটা উচাটন বোধে ছেয়ে গেছে। বড়ই বিষণ্ন লাগছে। আজ মনে হয় কোনও কিছুতেই আমার মন নেই। চাদর টেনে সন্ধ্যার অসময়ে শুয়ে পড়েছি। জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে পাশের একটি নিমগাছের ঝাঁকড়া মাথার বিনুনি ভেদ করে চাঁদের থৈ থৈ জোছনা ফালাকাটা ফালাকাটা রূপালী চমকের মতো বিছানা, চাদর, বালিশ, আমার সর্বাঙ্গে ছোঁয়া দিয়ে যাচ্ছে। আলোর আনন্দের দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে রইলাম। চোখ বুজতেই ভারী অন্ধকার। করুণ, বিষণ্ন, ব্যাথাতুর শত শত মুখ চারপাশে হেঁটে বেড়াচ্ছে। নিজেকে বড় অসহায় মনে হচ্ছে। বড় অক্ষম। যেন হাত-পা বাধা। কিছুই করার ক্ষমতা নেই। এমন দুর্দৈব্যে কার কথা মনে পড়ছে? ব্যক্তি নাকি সত্ত্বা? স্মৃতির ফাঁক গলে বহু বছর আগে শোনা একটি গান হৃদয়ে মর্মরিত হয়ে বেজে উঠল:
        যা দিয়েছ তুমি অনেক দিয়েছ
        অযাচিত তব দান
        বুঝিনি মহিমা দিইনি মূল্য
        তবু দান অফুরান
        কতো করুণার কণিকা ঝরিয়ে
        নিতি মমতায় রেখেছ জড়িয়ে
        অযতনে আমি ফেলেছি ছড়িয়ে
        করো নি তো অভিমান ॥

মানুষের এমন প্রবল দুর্দিনে করুণাই একমাত্র আশ্রয়; ভালোবাসাই একমাত্র অবলম্বন; সাহসই একমাত্র সম্বল। আমি ভালোবাসা ও করুণার সন্ধানে জোছনা-মাখা আকাশের ওপারে নির্নিমেশ তাকিয়ে থাকি।

বাংলাদেশ সময়: ২১৫০ ঘণ্টা, আগস্ট ৩০, ২০১৭
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।