হুমায়ূন ভাইয়ের অসুস্থতার খবর শুনে মনটা বিষন্ন হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু তিনি তো ভেঙে পড়ার মানুষ নন।
এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের রূপকার রফিকুল ইসলাম, কন্ঠশিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন, কবি কাজী রোজী এঁরা ক্যান্সারের সাথে যুদ্ধ করে সুস্থ-সুন্দর-স্বাভাবিক জীবনযাপন করছেন। সে তুলনায় হুমায়ূন ভাইয়ের অসুখ কিছুই না। কোনো অপারেশনই লাগবে না।
নিউ ইয়র্কে ২০০৯-এর জুনে হুমায়ূন ভাইয়ের সাথে দেখা হয়েছিলো। নিউ ইর্য়কের জ্যাকসন হাইটস-এ মুক্তধারার বইমেলা। কলকাতা, ঢাকা, লন্ডন, টরেন্টো এবং যুক্তরাজ্যের লেখকদের সমাবেশ। অনুষ্ঠানে হাসান আজিজুল হক, সমরেশ মজুমদার, জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, হুমায়ূন আহমেদ থেকে শুরু করে বিশ্বনাথ চৌধুরী, সৌম্য দাশগুপ্ত মঞ্চ আলোকিত করেছেন। আর গানের অনুষ্ঠানে লোপামুদ্রা মিত্র, মেহের আফরোজ শাওন থেকে শুরু করে ক্লোজআপের নবীনরা মঞ্চ মাত করেছেন।
অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় দিনে শাওনের গান। দর্শকশ্রোতা মুগ্ধ হয়ে আলোছায়ায় তার গান শুনছেন। সেই সময় হুমায়ূন আহমেদ তাদের ছেলে নিষাদকে কোলে নিয়ে হৈচৈ-হাততালির মধ্যে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করছেন। আগে মঞ্চে কোলে নিয়ে অনুষ্ঠানও করেছেন।
আমি প্রথমে খেয়াল করিনি। পরে তার ডাক শুনে সাড়া দিলাম।
বহুদিন পর খুব কাছে পেলাম হুমায়ূন ভাইকে। কারণ, তিনি যতটা জনপ্রিয়তা অর্জন করছেন, ততটাই আমার সাথে দূরত্ব বাড়ছে। সেই সাথে ঢাকা-টরেন্টোর দূরত্বও যেনো সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলেছে। অবশ্য অন্য ২-১টি কারণও আছে, তা পরে উল্লেখ করছি।
ছেলেকে ডান কাঁধ থেকে বাঁ কাঁধে নিয়ে আমার খোঁজখবর নিলেন। লেখালেখির কথা জানতে চাইলেন। টরন্টোতে আসার আমন্ত্রণ জানালাম। বললেন, এবার না। উল্টো তিনিই ঢাকায় গেলে অবশ্যই বাসায় যাবার নিমন্ত্রণ জানালেন। দু মাস পর ঢাকায় গিয়ে ফোন করতেই বললেন, `চলে আসো। চলে আসো। আড্ডা দেবো`। গেলাম। ধানমন্ডির বাসায় গিয়ে দেখি, ড্রইংরুম ভর্তি লোকজন, লেখক-সাংবাদিক, প্রকাশক। তিনি পাটি বিছিয়ে আড্ডা দিচ্ছেন। কিন্তু সে আড্ডায় কেন যেন প্রাণ পেলাম না, যে প্রাণের ছোঁয়া পেতাম বিটিভিতে প্রথম ধারাবাহিক `বহুব্রীহি` অথবা `এইসব দিনরাত্রি`র স্ক্রিপ্ট পাঠ/মহড়ার আয়োজনগুলোতে; আতাহার খানের শ্যামলীর বাসায় কিংবা আজিমপুরের বাড়িতে অথবা ভার্সিটির হলে প্রভোস্টের বাসভবনে।
ওই যে বললাম, দূরত্ব। অথচ তার সাথে পারিবারিক সম্পর্ক আশির দশকের শুরু থেকে। তার দুই সহোদর, একজন মুহম্মদ জাফর ইকবাল তখন নিউ জার্সিতে। নিয়মিত চিঠিপত্র যোগাযোগ আর ছোট ভাই শাহীন অর্থাৎ আহসান হাবিব আমার সমবয়সী, ঘনিষ্ঠ বন্ধু। থাকি একই পাড়ায়, পল্লবীতে। প্রতি রোববার সেখানে মিনি আড্ডা। খালাম্মার সৌজন্যে চা-মুড়ি স্মৃতিসঞ্চয়।
আমার মনে হয়, হুমায়ূন ভাই আমার ওপর একটু রাগ। প্রথম কারণ হতে পারে, ইনকিলাব ও পূর্ণিমায় তার লেখালেখির প্রতিবাদ করেছিলাম। দ্বিতীয়ত, আমার সম্পাদিত `সূচিপত্রে’ তাকে নিয়ে সেলিম কামালের সমালোচনামূলক লেখা প্রকাশ।
নব্বই দশকের শুরুতে এক দুপুরে ঢাকা স্টেডিয়ামের দুই বইয়ের দোকান ঘুরে আমি আর হুমায়ূন ভাই লাঞ্চ সেরে নিলাম। তার হাতে স্ক্রিপ্ট। দেবেন পূর্ণিমায়। প্রতিবাদ করে বললাম, আপনার বাবাকে ’৭১-এ রাজাকাররা হত্যা করেছে, আপনি ভয়াবহ দিন কাটিয়েছেন। বই লিখেছেন। আপনি মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের একজন শক্তিশালী লেখক। পূর্ণিমাতে লেখা আপনার সাজে না।
আমার কথাগুলো চুপচাপ শুনে বললেন, আমার পাঠক দরকার, পয়সার প্রয়োজন, এবং পৃষ্ঠপোষকতা চাই। কথাগুলো বলেই দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলেন।
আমি তখন প্রযুক্তিবিদ মোস্তফা জব্বারের সাপ্তাহিক `ঢাকার চিঠি`র যুগ্ম সম্পাদক। জব্বার ভাইকে ঘটনা বললাম। তিনি একটা রিপোর্ট তৈরি করে ছেপে দিতে বললেন। আমার মনে হয়, বিষয়টি হুমায়ূন ভাই সহজভাবে নেননি। অথচ ক বছর পরই, জাহানারা ইমাম হলের নামকরণ নিয়ে সিলেটের অভিমুখে ট্রেন যাত্রার প্রতিবাদের সময় ইনকিলাব হুমায়ূন ভাইকে ঠিকই ছোবল দিতে চেষ্টা করেছে। জাফর ভাই ও হুমায়ূন ভাইকে ছাড়েনি, বরং নিউজ ছেপে মৌলবাদীদের খেপিয়ে দিয়েছিল।
১৯৮৭-এ বিউটি বুক হাউস থেকে প্রকাশিত আমার গল্পগ্রন্থ ‘তুমি’ উৎসর্গ করি হুমায়ূন আহমেদ এবং ইমদাদুল হক মিলনকে। উৎসর্গপত্রে লিখি ‘দুই জনপ্রিয় কথাশিল্পীকে’ কিন্তু বাংলাবাজারের প্রুফ রিডারেরা তা ‘দুইজন প্রিয় কথাশিল্পী’ করে দেয়। একটি স্পেসের ফলে ‘দুই জনপ্রিয়’ হয়ে যায় ‘দুইজন প্রিয়’ কথাশিল্পী। একটা স্পেস কী করতে পারে তার প্রমাণ উৎসর্গপত্রটি। আর সেভাবেই অনেকগুলো ধারাবাহিক স্পেস তৈরি হয়ে গেছে হুমায়ূন ভাইয়ের সাথে। তবু বিদেশে বসে স্টার বাগর্সের কফিশপে আড্ডার বিষয় হয়ে ওঠেন হুমায়ূন আহমেদ। টরন্টোয় আমাদের জমজমাট আড্ডায় আমি, সিদ্বার্থ হক, মাসুদ খান- আমরা ‘মাতাল হাওয়া’ নিয়ে মেতে উঠি। `কাঠপেন্সিল` নিয়ে কথা বলি।
সম্প্রতি দেশে ফিরে গেলেন অন্যদিন-অন্যপ্রকাশ-অন্যমেলা-অন্যমিডিয়ার মাসুম রহমান। তিনি এ বছরের শেষ দিকে থেকে ফিরে আমাকে প্রথম ফোন দিয়ে বললেন, ‘দুলাল ভাই, টরন্টোতে আবার বইমেলা করতে হবে। হুমায়ূন ভাই আসবেন। ’ টরন্টোর বইমেলা থেকে পিছিয়ে গিয়েছিলাম, হুমায়ূন ভাইয়ের কথাশুনে এক পা এগুলাম। কয়েকজনের সঙ্গে আলোচনা হলো। একটি মিটিংও হলো। শেষ পর্যন্ত ‘অনিবার্য করণে’ বইমেলা হলো না, আসা হলো না হুমায়ূন ভাইয়ের। এলে হয়ত আবার সেই হারানো দিনের প্রাণের ছোঁয়া পেতাম। জানি না, কানাডায় কবে আসবেন।
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল
কানাডা থেকে
বাংলাদেশ সময় ২১৫৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২২, ২০১১