ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

তোমায় নতুন করে পাব ব’লে | অর্পিতা বন্দ্যোপাধ্যায়

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০০২ ঘণ্টা, আগস্ট ৬, ২০১৬
তোমায় নতুন করে পাব ব’লে | অর্পিতা বন্দ্যোপাধ্যায়

‘আজ নয়ন মেলিয়া এ কি হেরিলাম
                 বাধা নাই কোনো বাধা নাই-
আমি বাধা নাই

দেখিনু কে মোর আগল টুটিয়া
ঘরে ঘরে যত দুয়ার জানালা
                 সকলি দিয়েছে খুলিয়া...’

মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। অনির্দেশ্য কালের দিকে ছুটে চলার আকাঙ্ক্ষা।

কিংবা অপেক্ষা, প্রহরবিহীন অপেক্ষা, আজীবন ও সার্বজনীন অপেক্ষা। তেমনি কোনো অপেক্ষা থাকে মনে... যে অপেক্ষায় আলো হয়ে থাকেন রবি ঠাকুর, যাকে সমস্ত দুখের ধন নিবেদন করে দেওয়া যায় কোনোরকম শর্ত ছাড়া। তিনি প্রাণের ঠাকুর। আসলে বড়বেলার সব পেরিয়ে আসার মধ্যে কোথায় যেনো সাঁকো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন তিনি, হাত বাড়িয়ে রাখেন গীতবিতানের পাতায় পাতায়... আমরা তাকে ঘিরে, তাকে জড়িয়ে পেরিয়ে আসি ছেলেবেলা, মেয়েবেলা, কৈশোর, যৌবন।

পেরিয়ে চলার এই চিরকালীন নিয়মে, পঁচিশে বৈশাখ চলেছে জন্মদিনের ধারাকে বহন করে মৃত্যুদিনের দিকে... সেই অন্তহীন বেদনাকে ঘিরে থাকে হারিয়ে ফেলার, হারিয়ে যাওয়ার বাইশে শ্রাবণ। আসলে তাকে হারিয়ে আরও বেশি করে আঁকড়ে ধরি তাকেই। মফস্বলের ইশকুলবেলার বেণী বাঁধার দিন থেকে পাশে থাকেন রবি ঠাকুর। তিনি সবার। তিনি কাউকে পাপ দেন না, কাউকে অভিশাপ দিয়ে ভয় দেখান না, তাকে ডাকতে গেলে কোনো মন্ত্র লাগে না... কালো মেয়ে, ধলো মেয়ে, সবার কাছে একমুখ দাঁড়ি নিয়ে স্মিত হাসির আড়ালে জেগে থাকে এক বিশ্বাস, আশ্রয়, নির্ভরতা। হারমনিয়াম নিয়ে গান করতে বসা পাড়ার অর্চনাদি যখন চোখ বুজে ‘হাতখানি ওই বাড়িয়ে ধরো, দাওগো আমার হাতে’ গাইতো- তার আজীবনের নষ্ট হওয়ার যন্ত্রণা, পুড়ে যাওয়া মুখ, আইবুড়ো থাকার গালিগালাজ অতিক্রম করে যেনো পার হয়ে যেতো ওই চ্ছোট্ট শহরের সীমানা। বন্ধু যেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছেন অমলিন আশ্বাস নিয়ে। আমাদের যৌথ পরিবারের একুশজনের ভাত-ডালের ব্যবস্থা করতে করতে বাবা যখন ক্লান্ত, হেরে যাওয়া দিনের শেষ আলোটুকু ধরা থাকতো মায়ের গলার সুরে আর ওই রবি ঠাকুরের গানে- ‘আসবে যদি শূন্য হাতে, আমি তাইতে কি ভয় মানি, জানি, জানি বন্ধু জানি, তোমার আছে তো হাতখানি...আজি বিজন ঘরে...’।  

আমার দিনবদলের কথা বলা নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া কাকার ঘরের আলমারি ভর্তি মেডেল, কাপ আর রবীন্দ্রনাথ। আমি এক আকাশ বিস্ময় নিয়ে ভাবতাম, এতো বই সব রবীন্দ্রনাথের? ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে ঝাপসা হয়ে আসা চোখের দৃষ্টি এড়িয়ে আঁচলে চোখ মুছতো মা, আর বারান্দায় বেড়ে যেতো লাঠির শব্দ, দাদুর পায়চারি করার গতি। বাইশে শ্রাবণ রবি ঠাকুরের পাশাপাশি হারিয়ে গিয়েছিল আমার কবিতাপাগল ছোটোকাকাও। তাই রেডিওতে ‘আমার প্রাণের পরে চলে গেল কে’ যখন আমাদের পুরনো বাড়ি, পলেস্তারা খসা দেয়াল, সদর, রোয়াক ছাড়িয়ে আকাশে ছড়িয়ে পড়তো, তখন অর্চনাদির শাদা শাড়ি সব স্বপ্ন মুছে দাঁড়িয়ে থাকতো জানলায়। তখন আমাদের হারমনিয়াম ছিলো না, তবে তানপুরা ছিলো। ছোটোপিসির বিয়ে হয়েছিল এক বনেদি বাড়িতে। কোনো এক গোধূলি বেলায় মেয়ে দেখতে এসে ‘চরণ ধরিতে দিওগো আমারে’ শুনেই নাকি পাত্রী পছন্দ করেছিলেন পাত্রের পিসেমশাই। বিয়ের সময় তাই হারমনিয়াম নিয়ে গিয়েছিল ছোটোপিসি। তার আধুনিক শ্বশুরালয়ে অবশ্য সে হারমনিয়ামের পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটেছিল প্রাগাধুনিক নিয়মে... বাড়ির বউ আবার গান করবে কি লো? তাহলে হেশেল সামলাবে কে? অষ্টমঙ্গলায় এসে ছোটোপিসি নিজের ঘরে গিয়ে উপুড় হয়ে কেঁদেছিল, ভিজে গেছে গীতবিতানের হলুদ হয়ে যাওয়া  পাতা... ২৫ নং, ৫৬ নং, ১৬০, ৩৮০...। বড় হতে হতে বেশ পরিচয় হয়ে গিয়েছিল একমুখ দাড়ি আর স্মিত হাসির ওই মুখের সঙ্গে। শিশু ভোলানাথ আবৃত্তি করে আমিও পেয়েছি মেডেল। অতএব, রবি ঠাকুর আমাদের লোক, কাকার-পিসির-মায়ের সব্বার কাছের লোক। তাই আমার দাবি একটু বেশি। পাশের বাড়ির মন্টুর সঙ্গে চিরদিনের আড়ি করে দি ‘আমরা সবাই রাজা’ গানের জন্য। ওই গান তার দিদি আগে শিখেছে, তাই ওই গানটা ওদের, আর কেউ গাইতে পারবে না! শুনে মা বলেছিল, ইশ, ওটা রবীন্দ্রনাথের গান। সেই শুরু, আমার রবিজীবনযাপন, কবিজীবনযাপন।

পড়ন্ত বিকেলবেলার রোদ যখন জাফরিকাটা জানলা বেয়ে এসে নকশা কাটে পুরনো মেঝেতে, আমি গীতবিতান খুলে বসি... পাতা ওল্টাই, হলুদ পাতা, জীর্ণ পাতা... আর সেই পাতা থেকে উঠে আসে নিরুদ্দেশ হওয়া ছোটোকাকা, অর্চনাদি, ছোটোপিসি, মা,বাবা, ঠাকুরদা, দিদি, আমার স্কুল, বিনুনি, ছেলেবেলা...। হারিয়ে যেতে যেতেও পথ রুদ্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকেন রবি ঠাকুর। আমার প্রাণের ঠাকুর। প্রতিদিন ফিরে ফিরে যায় প্রাণের পরশখানি নিতে। সেই আমার পুজো, আমার শ্রাবণ দিনযাপন।

বাংলাদেশ সময়: ১০০২ ঘণ্টা, আগস্ট ০৬, ২০১৬
এসএনএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।