ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

উৎপল পাঠের কিছু নোট: পুরী সিরিজ পর্ব | জহির হাসান

ধারাবাহিক রচনা ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭২৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২, ২০১৬
উৎপল পাঠের কিছু নোট: পুরী সিরিজ পর্ব | জহির হাসান কবি উৎপলকুমার বসু (৩ আগস্ট ১৯৩৯ - ৩ অক্টোবর ২০১৫)

অরফ্যান ছেলের দল এবারেও ক্যাম্প পেতেছিল
জানুয়ারি মাসে তারা রেখে গেল শক্তিশালী ঘড়ি
অথচ উৎপল একা পুরীর মন্দির সারাবার
হাতচিঠি পেয়েছিল—তবু হাত হতাশ হয়েছে!
তোমার পাগল তুমি বেঁধে রাখো...
(শক্তি চট্টোপাধ্যায়, চতুর্দশপদী কবিতাবলী, ১৯৭২)

১.১
পুরী সিরিজ প্রকাশিত হয় ১৯৬৪ সালে। উৎপলকুমার বসুর পুরী সিরিজের কবিতা তাঁরে দানিয়াছে খ্রিস্টের সম্মান।

এই বইয়ের ছোট-বড় সবে মিলি কবিতা আছে ১৬টি (উৎসর্গের কবিতাখানিসহ)। এই বইখানি তিনি জন্ম দিয়া ইংল্যান্ড-ফ্র্যান্সে হিজরত করছিলেন। প্রচার আছে এই বহিখানা আত্মপ্রকাশের পর প্রায় ১০/১২ বছরের মতো দীর্ঘ সময় তিনি তেমন কিছুই লেখেন নাই। নানা পদের মিথ চালু আছে পুরী সিরিজ নিয়া। তার এই চটি সাইজের ছোট কবিতা পুস্তিকাখানি পুরাকালে তরুণ কবিরা মাথার কাছে রাইখে ঘুমাইত!

কী এমন ছিল এ-হেন একখান ‘চটি’ বইয়ে। লোকজন ‘চটি বহি’ গোপনে পড়ে! উৎপলের ‘চটি বহিখানি’ প্রকাশ্যে পড়া হইত। সেইকালে চটি বহিতে গোপন রসময় খবর থাকিত। চটি বহির মতোই পুরী সিরিজে রসময় গোপন একটা খবর ছিল হয়ত। সেই গোপন মোকামের বহুবর্ণ রস, আধুনিক কবিতা রসিকদিগের অফুরান টানের কারণ, তার কবিতার কলকব্জা ধরি টানাটানি করিলে যদি কিছু আন্দাজ করিবার পারি আমরা।



এই রূপ শোনা যায়, উৎপল যখন ইংল্যান্ডে তখন বর্ধমান শহরের কোনো এক কাব্য রসিক শ্রীমান সুব্রত চক্রবর্তী বাহাদুরের বাড়িতে স্টিলের আলমারির মধ্যে গয়নার বাক্সের মধ্যে পুরী সিরিজের একখান অরিজিনাল কপি সংরক্ষিত ছিল। তা সবাইকে বলা হতো অমুকের নিকট উহার একখানা সংরক্ষিত আছে। উৎপলভক্ত কোনো রসিক তাঁর বাড়িতে গেলে গয়নার বাক্সে রাখা ওই বহিখানির দর্শন পাইতে জুতা খুলি ঘরে ঢুকতে হইত



আমরা মাতৃগর্ভের অন্ধকার থাকি আসি। আমি কে? আমরা কারা? এইসব আদি সওয়ালের কোনো শেষ জওয়াব নাই। এই যে অন্ধকার বা অজানার থাকি যাত্রা একটা সেন্সর জীবন থাকি আমরা প্রকাশিত হই। একটা পর্ণজীবন থাকি আসি এইখানে পোশাক পরি। আমরা গোপন করি আমাদের ব্যক্তিগত দিন-রাত্রি। সেইসব মনোদৈহিক বাসনা, কথকতা, স্তব্ধ সাব-কনসাসের জিনিসপত্র যখন ভাষার মধ্যে আসে ভাসে তা তো এক ধরনের  ন্যাংটা নতুন কিছু। তাহা চটি’র মর্যাদা পায় বটে। পুরী সিরিজের কবিতায় এইসব সাব-কনসাসমার্কা জিনিস বহুত ছিল। তার একটা গোপন কদর ছিল সেইকালে।

এই রূপ শোনা যায়, উৎপল যখন ইংল্যান্ডে তখন বর্ধমান শহরের কোনো এক কাব্য রসিক শ্রীমান সুব্রত চক্রবর্তী বাহাদুরের বাড়িতে স্টিলের আলমারির মধ্যে গয়নার বাক্সের মধ্যে পুরী সিরিজের একখান অরিজিনাল কপি সংরক্ষিত ছিল। তা সবাইকে বলা হতো অমুকের নিকট উহার একখানা সংরক্ষিত আছে। উৎপলভক্ত কোনো রসিক তাঁর বাড়িতে গেলে গয়নার বাক্সে রাখা ওই বহিখানির দর্শন পাইতে জুতা খুলি ঘরে ঢুকতে হইত। ঘরে ঢুকি গয়নার বাক্স খুলি কিছুক্ষণ দেখার ও পড়ার সুযোগ দেয়া হইত। তারপর আবার সেই বাক্সে পুরী সিরিজরে পুরি রাখা হইত। এইভাবে বায়োস্কোপ দেখার মতো বাংলা কবিতার যে বইখানি রূপ নিছিল সে হইল পুরী সিরিজ। আর পরকালে উৎপলের নামই হই গেল পুরী সিরিজের কবি।

পুরী সিরিজের সংস্করণ শেষ হই গেলে ফটোকপি যুগে ফটোকপি হইতে ফটোকপি হাতে হাতে উৎপল-আগ্রহী তরুণ কবিগণ পরম যতনে চির নতুন কবিতার সুবাস নিবার লাগি সংগ্রহে রাখিত।

এই হইল পুরী সিরিজ বইয়ের প্রতি তার আধুনিক পাঠকের মরমী টান। আধুনিক পাঠকের ধর্মরে উদ্ধার করা যাবে তার কবিতার প্রেম থাকি। ঈশ্বর হত্যাকারী আধুনিক মানুষ তার আত্মিক টানাপোড়েন বিকল্প ঈশ্বর নির্মাণের মধ্যে ঈশ্বরের নাস্তি প্রশমনের পথ খুঁজি ফিরতেছে। সেই খোঁজ-খবরও আমরা পুরী সিরিজের জনপ্রিয়তার কারণের মধ্যে পাব হয়ত।

উৎপল ইংল্যান্ডে থাকাকালীন তার কানে এই খবর পৌঁছায় যে এই ক্ষুদে বহিখানি কবিতা পড়ুয়া পাবলিকের কাছে অতি আদরের জিনিস হই উঠছে। ততদিনে উনি দেশে ফিরছেন। লিখছিলেন, পুরী সিরিজের সেকেন্ড পার্ট বা বলা যায় ধারাবাহিক অংশ। সেই বহির নাম রাখা হইল ‘আবার পুরী সিরিজ’ (১৯৭৮)। এই পুস্তকে ৪২টি কবিতা অন্তর্ভুক্ত হয়, যার মধ্যে অধিকাংশ কবিতাই সিরিজ কবিতা।   আরেকট তথ্য হইল  দুই বহি একে অপরের পিঠাপিঠি  ১৪ বছরের ছোট-বড়।

উৎপল পুরী সিরিজের কবিতা আধুনিক পাঠকের কাছে কদর পাইছিল জানার পর ২য় খণ্ড (উপন্যাসের মতো) তথা আবার পুরী সিরিজের কবিতাগুলিনরে নিংড়ায়ে বার করি নিজেরে যথেষ্ট রিপিট করছিলেন। ফলে আগের মতোই সাকসেস হইলেন। ফলে পুরী সিরিজ হেলান দিয়া দাঁড়ায় রহিল আবার পুরী সিরিজের গায়। সেইকালে আধুনিক মননের মধু অবারিত হইলে ভোমরার বসন্তকাল দীর্ঘয়ায়িত হইতে লাগিল।

উৎপল অন্তরের কী কী মাল তাক করা আছিল তার মারফত দূরবর্তী সন্দেশ যদি কিছু পাওয়া যায় এবং সেই সাথে আপাতত এইখানে পুরী সিরিজের কবিতাগুলিরে কেন্দ্রে বসায়ে মোর আন্দাজগুলিন লিখিবার খায়েস করতেছি।

১.২
কোনো এক ইংরেজ যুবক ভারতে তখন বেড়াইতে আসছিল। উনি আমার সাথে এক সাক্ষাৎকারে কইছিলেন সেই কথা। সেই প্রথম ভারতে মার্কার পেন আসছিল। তার সূত্রে প্রাপ্ত হই পুরী সিরিজের প্রচ্ছদপট কবি উৎপলকুমার বসু নিজে হাতের লেখায় তৈয়ার করছিলেন। এই প্রচ্ছদ নিয়া আমার সহিত তার আলাপের পর উৎপলকুমার বসুর কবিতাসংগ্রহের দেজ পাবলিশিং-এর জানুয়ারি ২০০৬ সালের পরিবর্ধিত দ্বিতীয় সংস্করণে পুরী সিরিজসহ তার সকল বহির কভার ছাপাইছিলেন। মাশাল্লাহ ইহাও একটা প্রাপ্তি!

১.৩
উৎপলের কবিতা পাঠকমাত্রই অবগত আছেন যে, তার প্রতিটি বহির থাকে একটা উৎসর্গপত্র। এই নিয়া তার সাথে মোর কথা হয়। উনি কইছিলেন, মধ্যযুগের কবিতায় দেখবে ভণিতা থাকে, মঙ্গলকাব্যে থাকত দেবদেবীর বন্দনা। আমি কইছিলাম, আপনার ক্ষেত্রে আপনার বইয়ে ‘উৎসর্গ’ জিনিসটা সেই রকম। তবে তা আধুনিকতায় মোড়ানো। মানে বন্দনা না রহে তাতে। দেবদেবীরা উৎখাত হইছে এইখানে। এইখানে দেবদেবীর বন্দনার জায়গায় লৌকিক চিন্তা-বস্তুর বন্দনাগীতির জায়গা দখল করিয়াছে। উৎসর্গপত্রের কবিতাটির খ্যাতিমান লাইন দুটি হইল : র‍্যাবোর কবিতার উৎপলকৃত অনুবাদ—‘বসন্তে এনেছি আমি হাবা যুবকের হাসি’। অন্য লাইটি হইল—‘আর কী চাইতে পারো কলকাতায় তাঁতকল ছাড়া তুমি চেয়েছো কবিতা’। এই ধরনের প্রবাদবাক্য প্রতিম বাক্য কবিতায় উনি গুঁজি দেন।

উৎপল একবার বিনয় মজুমদারের কবিতা নিয়া কথা তুলছিলেন এই কয়ে যে উনি সামান্যধর্মী বাক্য লিখেন—তা ধর্ম ও নৈতিকতার পক্ষ অবলম্বনের নামান্তর! ফলে উনি নবী বটে, আর ঊন-কবি! সেই দোষে কবি উৎপল নিজেও কম দোষী নয়। যদিও উৎপলের ট্রিটমেন্ট এসব ক্ষেত্রে হাস্যরসের মধ্যে ফেলি এইসব সিরিয়াস ধর্মেরে বিপদ-আপদে রাখেন, যেইটা বিনয় মজুমদারে গিয়া পাওন যায় না। যাহোক, কবিরা উন-মাত্রায় নবী বটে ফলে এই প্রবাদবাক্য কিছু কিছু লিখলে দোষ নাই। উৎপলের ফিউশন তৈয়ার করার মধ্যে নানা ‘র’ জিনিস উনি দিয়া খাঁটি মাল হিসেবে, প্রোডাক্ট হিসাবে পাওনের কোশেশ করেন। কবিত্ব-নবিত্ব দুই মহান এক ঘাটেই জল খান, শুভ সন্ধ্যা কাটান সুন্দরের লগে।

উৎপল র‌্যাবোর উদ্ধৃত লাইনখানা তার কবিতায় ব্যবহার করায় তারে কমলকুমারের মতো ফরাসি সিনট্যাক্সে কবিতা লিখছেন এই অভিযোগ তোলা হইছে বহু মহল থাকি। গল্প-উপন্যাসে ভাষা নিয়া যেই খেলা খেলছেন কমলকুমার সেই একই গোছের খেলাধুলায় মনোযোগ দিছিলেন উৎপলকুমার। উৎপল কমলকুমারের ভীষণ ভক্ত ছিলেন। কমলকুমারের অন্তর্জলী যাত্রার ভাষা ওনারে মুগ্ধ রাখিছিল সারা জীবন কওয়া যায়। কমলকুমার দেশ-জাতির অতীত সাংস্কৃতিক ভাব-সম্পদে মুগ্ধতাপাশে আবদ্ধ হইবার চাইছিলেন। নতুন আখ্যান রচিবার চাইছিলেন, যাতে করি শৈলীর রূপে-অন্তরে ঔপনিবেশিক-পূর্ব অতীতের সেই সম্পদ পুনর্জীবিত তথা সংযোগ করবার চাইছিলেন। মমতা, ভক্তি, প্রীতি, বাৎসল্য বাঙালির আদি জিনিসের সেবা করতে চাইছিলেন তিনি। আমি এইখানে উৎপলের কমলকুমারভক্তি প্রকাশক একটা লেখার ২/৩টা অংশ তুলি দিচ্ছি। তাতে আশা করি উৎপলে কমলকুমারের আসন টের পাওন যাবে।

‘ঢুকলেন কমলকুমার মজুমদার। স্নান করে, পাট ভাঙা ধূতি পাঞ্জাবি পরে এসছেন। আমরা বেজায় খুশি হলুম। আড্ডার স্টার উপস্থিত। ভাব দেখে মনে হলো গ্যাঞ্জাম বহুক্ষণ চলবে। এবার খোস-গল্প রূপান্তরিত হবে সাহিত্যচর্চায়। আর যদি কেউ ভারী সাহিত্য-আলোচনা করবেন বলে স্থির করে থাকেন তবে কমলকুমার তাঁকে বোঝাবেন ফরাসি চিত্রপরিচালক জাঁ রেনোয়াকে তিনি কিভাবে বাঙালির মোচা-কাটার  কৌশলটৌশল দেখিয়ে স্তম্ভিত করেছিলেন। ফরাসি রান্নার মতোই বাঙালির মোচা, এঁচোড় আর ছাচি কুমড়োর ছক্কা কি সভ্য রন্ধনশৈলীর আরো কয়েকটি উচ্চ শিখর নয়?’

‘ব্যক্তিগতভাবে চলচ্চিত্রে অনূদিত কমলকুমার আমার প্রত্যাশা জাগায় না। সেটা অবশ্য আমার নিজের দোষে। যেমন, আমি চাই না, কপালকুণ্ডলাকে চর্মচক্ষে দেখতে, চাই না ইন্দ্রনাথের দিদি অন্নদাকে দেখতে, চাই না অন্তর্জলী যাত্রার যশোবতীকে দেখতে। এই নারীদের অস্তিত্ব ও রঙের অনেকটাই আমার মনের। কমলবাবু বলতেন—মাছরাঙা পাখির রঙ অর্ধেকটা বনের, আর অর্ধেকটা মনের। ’

উৎপল কবিতায় প্রায়ই আধুনিকতার আবেশ সহকারে এইসব বাঙলামালের গোড়ায় পানি ঢালছেন প্রথমে, পরে সতীনাথ ভাদুড়ীর ধুলার জগতের যেন নতুন নতুন উৎপলীয় তাৎমাটুলি-ধাঙড়টুলির বাস্তবতা নির্মাণ করার মধ্যে ভক্তির উৎসারণ ঘটাইছিলেন। ফলে আমরা দেখি তার ভাদুড়ী-ভক্তি। তার জীবনের সকল কবিতা দুই মলাটের মধ্যে রাখা আছে যেইখানে সেই কবিতাসংগ্রহ তিনি উৎসর্গ করছেন সতীনাথ ভাদুড়ীকে। লিখলেন এইভাবে—‘সতীনাথ ভাদুড়ীর সম্মানে এই কবিতাসংগ্রহ উৎসর্গ করা হলো। ’

সতীনাথ ভাদুড়ীকে কেন এত সম্মান দিবার গেলেন উৎপল? বুঝতে হইলে একটু সতীনাথের ইস্টিশনে গিয়া কয়দিন কাটাইতে হবে আমাদের। তারপর এই সম্মানের কারণ বুঝা যাবে। উৎপল মানস পরিমণ্ডলে সতীনাথ আর কমলকুমার ব্যাপক ব্যাপার এই জিনিসটা মাথায় না রাখলে বোধ হয় সহজে উৎপলের কাব্যবিশ্বাসের ধারে কাছে ভিড়া যাবে না। রামায়ণের আদলে লেখা ‘ঢোঁড়াই চরিত মানস’। বলা হই থাকে তুলসীদাসজীর লেখা রামায়ণের নাম ‘রামচরিতমানস’। ‘ভারতবর্ষের মধ্যে রামচরিতমানসই সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় বই। রামচরিত্র মানস সরোবরের ন্যায় বিশাল। এর ভিতর রামকথারূপ হাঁস ঘুরে বেড়ায়। ’

সতীনাথের এই উপন্যাসের জীবন আর উৎপলের শৈশব-কৈশোরে দেখা ও যাপিত জীবনের তেমন দূরত্ব নাই। প্রভেদ এইটুকু যে উপন্যাসে ভাষার ভিতর প্রতিফলিত সীমিত জীবন।

শৈশব, কৈশোর স্মৃতিসত্তা ইতিহাসের সাহিত্যিক উদযাপনের মধ্য দিয়া কত আয়োজন আমরা উৎপলে পাই।

‘আমার ছেলেবেলা উত্তর বাংলার গণ্ডগ্রামে কেটেছে বলে রবীন্দ্রনাথের গানের সঙ্গে বেশ কিছুটা বড় হয়ে ওঠার পর পরিচয় হয়। আমরা দম-দেওয়া কলের গানে শুনতাম শচীন দেববর্মন, কানা কেষ্ট এবং অবশ্যই আব্বাসউদ্দীন। শেষোক্ত গায়ক ছিলেন আমাদেরই অঞ্চলের লোক। ’ গণ্ডগ্রামের লোক উৎপল কলকাতায় প্রবাসী মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক যেন। এই নিয়া তিনি অবশ্য আক্ষেপ করছেন আরেক জায়গায়।

এর সমর্থনে আরো উদাহরণ হিসাবে যেমন, উনার গদ্য সৎগ্রহ-১ উৎসর্গ করছেন এই রূপ বাক্য ব্যয়ে—‘ছেলেবেলায়, বিছানায় শুয়ে শুয়ে, বহু ঘুমহীন রাতে শুনেছি চৌকিদার হেঁকে যাচ্ছে ‘বস্তিওয়ালা জাগো... কোঠিওয়ালা জাগো...। ’ / ‘সেই অজানা, অদেখা, সাবধানকারী, নিশাচর মানুষটির প্রতি আমার এই অস্থিরমতি লেখা কালস্রোতে ভাসিয়ে দিলাম। ’

এই হলো উৎপলের নিবেদন। এর থাকিও আমরা তাঁর খায়েস, মানসিক ঝোঁক বুঝিবার পারি কিছু কিছু। সমাজের কোন শ্রেণির মানুষের জীবন-যাপন অতি সাধারণ তাদের সেই জীবনের প্রতি উৎপলের আকুতি, তার স্মৃতিসত্তা ফেলি আসা দিনহাটার সামান্য মানুষদের জীবনের সাথে লবণ-পানির মতো মিশি আছে। হয়ত সেই মানডেন দিনহাটায় আর ফিরা হবে না, তবু তার প্রতি ভালোবাসার অনুভূতি বয়ে বেড়ানো সারা জীবন। এই বয়ে বেড়ানোর মধ্যে চিরায়তকে স্পর্শের স্বাদ, অর্থময়তার কোনো দিক পাইছিলেন উৎপল।

‘কিন্তু ভাষা এবং অনেকাংশে সাহিত্য তো ব্রাত্যজনের হাতে নিয়ন্ত্রিত হয়। আমাদের মা তো ব্রাত্যজন। সুতরাং মাতৃভাষা বা ইংরেজিতে যাকে বলে ‘ভারনাকুলার’—তা চিরদিনই বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মুখের ভাষা। ’

‘যে যাঁর মানসিক পরিমণ্ডল নিয়েই লেখালেখি করেন। আমি সেই অর্থে একজন মার্জিনাল লোক। যে লোক এয়ার কন্ডিশন গাড়ি চেপে তাজবেঙ্গলে ডিনার খেতে যাচ্ছে, তার চেয়ে যে লোক ভিড়ের গাড়ির লোক, বা স্টেশনে শুয়ে আছে যে,—পাগল, চোরাচালানকারী, তোতলা—এদের সঙ্গেই বেশি আত্মীয়তা অনুভব করি। তবে আমি মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোক। এখানেই আমার একটা সংকট। ’

মৃত্যুর পর আপনাকে একটা বর দিলে আপনি কী যাচনা করতেন? এই রকম একটা প্রশ্নের উত্তরে লিখছিলেন, আমি চাইব, এবং পাছে ঔদ্ধত্য প্রকাশ পায় সেজন্য বলব, এটি ক্ষুদ্রের দীন প্রার্থনা—আমি যেন বারবার জেগে উঠি লোকাল ট্রেনে—বর্ধমান, বনগাঁ, মেদিনীপুর, ডায়মন্ডহারবার যাতায়াতের পথে—লোকের কথায়, হকারের ডাকে, পিকনিক-যাত্রীদের হাসিঠাট্টায়, কলহবিবাদে, থুথু-টিটানো ক্রোধে ও অনন্ত কোলাহলে।

ফলে পরবর্তী জীবনে উৎপলজী কমলকুমার শিল্পের বঙ্গীয় ধারা ও সতীনাথের এইরূপ নিম্নবর্গীয় ফোকাসে নানাবিধ চেতনারে নিজের গোড়া-শিকড়-বাকড় হিসাবে মানছিলেন। ফলে উৎপল মানসে কমল-সতীনাথের লেখনি যাপন ভীষণ রকমের আকর্ষণের বিষয়।

দ্বিতীয় পর্ব পড়তে ক্লিক করুন



বাংলাদেশ সময়: ১৬২৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২, ২০১৬

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।