ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

ফকরুল চৌধুরীর গল্প

জিন পরী দেও দানো

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮০৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ৮, ২০১১
জিন পরী দেও দানো

ভুবন ভরা আলোর নাচন। ভূমিতে হুমড়ি খাওয়ার আগে শূন্যতায় ভাসছে, যেন ছেড়া তুলো।

চাঁদনি রাতের এমন ঘোলাটে আলো-আধারিতে চরকা বুড়ির উদয়। দূর থেকে দেখলে নিথর, কাছে এলে ঢুলু ঢুলু। যেন চরকা ঘুরাচ্ছে আর আলতো উবুর হয়ে গুন গুন গান করছে। থমকে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা দেখছিল ছলিম আলী। ছলিম আলী থমকে দাঁড়াতেই ব্রেক কষলো হাফিজ খান। বুড়িকে ঘিরে কয়েক জন। কয়েকটি রিক্সা রাস্তার পাশে, যেন পরিত্যাক্ত। তারপর, ফুটপাথ থেকে উঠে যাওয়া সিঁড়ি পেরিয়ে সার সার দোকান, ওরা সাটারে পিঠ ঠেকিয়ে বসে। ঠাণ্ডা কাঁটা-হাওয়া শরীরে বিঁধছিল। পা ছড়িয়ে দিয়ে আকাশের দিকে চোখ দুটো ছেড়ে দেয়। তারারা, যেন জোনাক পোকা, মিটি মিটি করছে। আর ম্লান আলো চুইয়ে চুইয়ে শূন্যতায় ছড়িয়ে পড়েছিল। মানুষগুলোকে লাগছিল আজব। কলেটেপা। যেন সামনে এক বিশাল ক্যানভাস, সেখানে প্রদর্শিত হচ্ছিল অ্যানিমেশন মুভি।

বুড়ি চিতই পিঠা বানাচ্ছিল, স্টোভে আগুন জ্বলছে। ছলিম আলী মনে মনে একটু হাসল, আর বলল, এই হলো চাঁদের দেশের পিঠাওয়ালি। বুড়ি চিতল পিঠা বানায়। বুড়ির চিতই পিঠা খেতে হয় ধনিয়ার ভর্তা, সর্ষে ভর্তা কিংবা শুটকি ভর্তা দিয়ে। একজনের মুখাবয়বে ঘূর্ণি তুলছিল, চোখ বেয়ে পানি পড়ছিল-- সে খেয়েছিল সর্ষে ভর্তা। একজনের দুই কানে জ্বালা হচ্ছিল, ডানেবায়ে ঢুলছিল, সে খেয়েছিল সর্ষে ভর্তা। একজনের পেট থেকে সবকিছু বের হবে হবে করছিল, আদতে কিছুই হয়নি, একটু পর পর কাশি দিচ্ছিল-- সে খেয়েছে ধনিয়া ভর্তা। নানা স্বাদের খাবারগুলো নানা পদের লোকগুলো খায়। খেয়ে তরতাজা হয়। হালকা শীতল ঝাপটা তুড়ি মেরে উড়িয়ে মজমা বসায়। চায়ের কাপের উষ্ণতার সঙ্গে সিগারেটের ধুয়া তোলে। কয়েকজন চরকা বুড়িকে ঘিরে রঙ-তামাশা করে। বলে-- খালার বাড়ি কই। খালা উত্তর দেয়-- ফরিদপুর। একজন বলে, খালা তোমার রূপবান নাতনি কই। খালার নির্লিপ্ত উত্তর : হারামজাদা। উপস্থিতগণ হো হো করে হাসে।                       

ছলিম আর হাফিজ পায়ে পা তুলে সিগারেট ফুকছে। তবে তাদের দৃষ্টি সার্চলাইটের মতো আশপাশ পর্যবেক্ষণ করছে। পৃথিবীটা যে এক আজব রঙ্গশালা ইতিমধ্যে তারা বুঝে গেছে। দিনের রঙ্গের চেয়ে রাতের রঙ্গ তাদের ভালো লাগে। তারা প্রতিরাতে রঙ্গ-ভ্রমণ করে। ফকিরাপুলের গরমপানির গলিতে আবাস। ছলিম ইউনিভার্সিটি পাস দিয়ে চাকুরি করার কথা ভাবছে গত ৫ বছর ধরে, এখন পর্যন্ত কোথাও অ্যাপ্লাই করেনি। আর হাফিজ জগন্নাথে পড়ে। বয়সের ঢের ব্যবধান সত্ত্বেও, তারা বন্ধু। তাদের মধ্যে অনেক মিল। অমিলও আছে।

একটি গুরুত্বপূর্ণ অমিল হলো, তারা যে গরমপানির গলিতে থাকে একথাটি ছলিম লুকিয়ে রাখতে পছন্দ করে। আর হাফিজ উচ্ছ্বাসের সঙ্গে তা জাহির করতে পছন্দ করে। যেমন, অনেক দিন পরে হঠাৎ কারো সঙ্গে দেখা, সে বন্ধু হোক কিংবা মুরব্বী, জিজ্ঞেস করলো : হাফিজ কেমন আছো ? হাফিজ কোনো রকমে বলবে, ভালা আছি। তারপর তৃপ্তি সহকারে বলবে, আমি গরমপানির গলিতে থাকি। এই জায়গার বিশেষত্ব তো সবাই জানে। যদি কেউ না জানে তখন সে রসিয়ে জায়গার মহত্ব প্রচার করে। বলে-- দেহ ও মনের উত্তেজনা প্রশমন স্থান। তারপর হাফিজ তাকে বাসার ঠিকানা দেবে, ফোন নম্বর দেবে এবং তার বাসায় কদমবুসি দিলে সে ‘যার পর নাই’ খুশি হবে জানিয়ে বিদায় নেয়। কিন্তু কেউ আসে না।

তাদের পাশে এসে দু’জন বসে, তরুণ। ফিটফাট পোশাক, গোবেচারা চেহারা। চুপচাপ। গোবেচারা একজন মাউথ অর্গানে গান তুলছে, ও চাঁদ সুন্দর প্রিয়া আমার...। আর বাকি ৩ জন তন্ময় হয়ে থাকে। ছলিমের কান্না কান্না ভাব হয়। যেকোনো সময় অশ্রুপাতের সম্ভবনা রয়েছে বুঝতে পেরে হাঁটুর ফাঁকে মুখটি লুকিয়ে রাখে। ভালো-লাগা কষ্ট উপভোগ করে। নিজেকে মাঝিহীন এক নৌকোর মতো প্রকৃতির কাছে সপে দেয়। যায় যাক, যেখানে সেখানে। হঠাৎ জলের ঘূর্ণাবর্ত, নৌকোটা দুলে ওঠে।

গোবেচারা দুইজনের হাতে পিস্তল, চোখের পলকে একটি প্রাইভেট কারের পথরোধ করে, এর মধ্যে হয়ে গেছে ২ রাউন্ড গুলি ছোড়া। তড়িঘড়ি করে ড্রাইভার ছাড়া বাকি লোকগুলোকে রাস্তায় নামিয়ে ভো করে গাড়িটি অদৃশ্য হয়ে যায়। কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপার। ছলিম ও হাফিজ চাক্ষুষ এই ম্যাজিকে তন্ময় হয়। গাড়ির যাত্রীরা ব্যাপারটি যেন তখনও বুঝতে পারেনি, রাস্তার পাশে স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কিছুক্ষণ মাত্র। তারপর এক তরুণীর ভয়ার্ত কান্না। তাকে জড়িয়ে ধরে এক মহিলা, সম্ভবত তার মা। একটি বাচ্চা অবাক হয়ে তাদের দেখে। আর পুরুষটি তাদের সান্ত¡না দেয়, তার মুখাবয়বে হাসি-কান্নার মাঝামাঝি ভাব। অতঃপর তারা ফুটপাতে এসে লেপ্টে বসে। তাদের ঘিরে ছোটখাট একটি জটলা, নানা মন্তব্য।

ছলিম আলী ও হাফিজ খান দীর্ঘশ্বাস ফেলে। উঠে দাঁড়ায়। ঢিলেঢালা হাঁটতে থাকে। নটরডেম কলেজ পেরিয়ে, যেখানটায় অফিসপাড়া, রাস্তার পাশে আচমকা থামতে হয়। ছলিম আলীর শরীরে কাঁপুনি ওঠে। হাঁটায় গতি ছিল, ছিল ভারী লম্ফ-ঝম্ফ। সোডিয়াম আলোয়, তার ছায়া বিভিন্ন আকার ধারণ করছিল। কখনো দীর্ঘাকৃতি, কখনো পায়ের গোড়ালিতে ঘুর ঘুর। সে গুণ গুণ করছিল। কখনও গলা ছেড়ে গাইছিল। কখনও থমকে দাঁড়াচ্ছিল। এবং হাসছিল একা একা। মাঝেমধ্যে চোখের সামনে আচানক কিছু ঘটলে এরূপ করে। কিছুক্ষণ আগেও, এক রিক্সাঅলা যখন ধীরে ধীরে প্যাডেল চাপছিল এবং দরদী সুরে গাইছিল : মন মাঝি তোর বইঠা নেরে আমি আর বাইতে পারলাম না... তখন সে প্রথমে অবাক হয়, পরে মৃদু হাসে। সেই সাথে ভেতরে একটা বেদনাও যেন চিমটা কাটে, বহুদূর থেকে আগত একটা বাতাসের ঝাপটা অনুভব করে, একটা নদীর অবয়বও চোখে ভাসে, আরো কত কী! অতঃপর ঘোরের মধ্যে, এক্কাদোক্কা করে হাঁটছিল, তখন সমবেত বাঁশির তীব্র শব্দ, তাকে ঘিরে তরঙ্গের ঘূর্ণি তোলে। তাকে থামতে হয় এবং ঝিম মেরে থাকতে হয়। অনুভব করে, জালে আটকা মাছের মতো সে ধরা পড়েছে। তাই ছটফট না করে নিয়তিকে মেনে নেয়। চুপটি মেরে যাত্রী ছাউনিতে আশ্রয়। ভাবনা এরকম, একটু ঘুমিয়ে নেবে।

Shopnokothযেয়ে দেখে বেশ কিছু ডানাকাটা পরী। কেউ শুয়ে, কেউ এলিয়ে, কেউ বসে। একজন সুরেলা কণ্ঠে গান করছে। কেউ সাজুগুজু করছে। পোশাকে তারা স্বল্পবসনা। ছলিম অসহায় বোধ করে, এদিক-সেদিক তাকায়। হাফিজ খান গেল কই! শরীরের ভার বইতে পারছে না। টলোমলো। পড়েই গেল কোমল কিছুর ওপর। কতগুলো হাসি ফোয়ারা তুলল। কিছুক্ষণ পর ধাতস্ত হয়ে চোখ খুলল। কেউ তার মুখে পানির ছিটা দিয়েছে বুঝতে পারল। পরীদের এক বৃত্তের মধ্যে সে পুতলা হয়ে আছে। ভীষণ ক্লান্তি বোধ করে। পরীরা হাস্যরসাত্মক মজারু মন্তব্য ছুড়ছে। কেউবা তার গতর নিয়ে মস্করা করছে। গান করছে-- রূপে আমার আগুন জ্বলে, যৌবন ভরা অঙ্গে...। এরই মধ্যে সে ঢলে পড়ে। তখন আকাশের তারারা মিটিমিটি করছিল, ছায়ামানুষেরা হাঁটছিল। অপ্সরীরা তাকে ঘিরে মজা করছে। মাথাটা ভার হয়ে আসে। খস্স্ করে একটি গাড়ি থামলো। নেমে এলো দু’জন। পরীরা রসের ভা-র খুলে তাদের অভ্যর্থনা জানালো। সবাই হাসিমুখ করে তাদের সামনে নিজেদের উপস্থাপন করল। অতঃপর যাচাইবাছাই ও দরদাম করে গাড়িঅলারা দুই পরীকে নিয়ে গেল। গাড়িটা স্টার্ট দিয়ে কিছু দূর যেতেই বাঁশির হুইসেল। পুলিশ গাড়িটাকে থামালো। তাদের মধ্যে কয়েক সেকেন্ডের একটি ব্যাপার ঘটল। কিছু কথা হল, দূর থেকে বুঝা গেল না; তবে ব্যাপারটি অনুমান করা গেল। তারপর যা হয়, গাড়িটা যেমনে এসেছিল তেমনি সসম্মানে চলে যায়। আর ছলিম আলীর চোখও বুজে আসে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে বিশাল এক শাপলা ফুল। একে ঘিরে মাছেরা খেলা করছে। কতিপয় ছিন্নমূল মানুষ শাপলার নিচে জলজ পরশে ঘুমিয়ে পড়েছে। আরো কিছু সহায়সম্বলহীন মানুষ বিক্ষিপ্তভাবে হাঁটছে। চায়ের দোকানের এখনো কয়েকটি ঝাপড়ি বন্ধ হয়নি। সেখানে আবছা আলোয় চা পান চলছে। কথা হচ্ছে মৃদু লয়ে। কিছু রিক্সা চলছে। অধিকাংশ খালি। কয়েকটিতে আবার পরীরা বসে আছে। নৈশবিহারে নাগর খুঁজছে। আর রাস্তার পাশে সার বাধা গাড়িগুলোতে ছোট ছোট জোনাকির দেখা মেলে। অধিকাংশই স্থির। জোনাকির টানে পরীরা যায়। গাড়িতে ওঠে। তারপর জোনাকির আর দেখা মেলে না। গাড়ি থেকে একটি ছায়া নেমে আসে। এদিকসেদিক তাকায়। অতঃপর অনির্দিষ্টভাবে হাঁটতে থাকে। অবশ্য মনে মনে একটি উদ্দেশ্য আছে, সে একজনকে খুঁজছে। কেননা সে দলছুট হয়ে পড়েছিল, ইচ্ছে করেই। এক পরীকে নিয়ে সে খানিকের জন্য উধাও হয়েছিল। কাজ সারা। ক্লান্তি বোধ করছে। তখনই সামনে যাত্রীছাউনিটা দেখে হাঁটতে লাগল। এক্কেবারে খালি। টেবিলে লেপ্টি মেরে বসে পড়ল। কয়েকটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে অনুভব করল, ক্লান্ত হলেও চোখে ঘুমের আলামত নেই। পাশ থেকেই অস্ফুট কেউ একজন তার নাম ধরে ডাকছে। ডানদিকে তাকাতেই মুচড়ে ওঠা একটি অবয়ব চোখে পড়ে। কাছে যেতেই চিনতে পারে। লজ্জিত ও অপরাধীর মতো স্থির হয়ে থাকে। ছলিম ঝট করে উঠে দাঁড়ায়। হাফিজের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে। অতপর রাস্তায় নেমে হাঁটতে থাকে। হাঁটাটা তারা বেশ উপভোগ করছিল। গান গাওয়ার মুড পেয়ে বসে। কি গাইবে তার জন্য স্মৃতি নাড়া দিচ্ছিল। তখনই একটি গাড়ি এসে তাদের গতি রোধ করে। ভাবে, এ আবার কোন দেও দানো।

তারা হল ক্যাবল টিভির সাংবাদিক, আদর করে কেউ বলে চোঙ্গা সাংবাদিক। মাউথস্পিস নিয়ে কচি এক ছোকরা, তার পেছনে একজন কাঁধে ক্যামেরা হাতে ফ্লাশ। দেখা মাত্র চোখের পলকে তারা দেয় ভো দৌড়। তাদের সঙ্গে আরো কয়েক জন দৌড়াচ্ছে। জানতে চাচ্ছে ব্যাপারটি কি? কয়েকজন কাছের গলিতে গা ঢাকা দিচ্ছে। ছলিম আলী আর হাফিজ খান চরকা বুড়ির কাছে এসে থামে। বন্ধ দোকানের সার্টারে হেলান দিয়ে কিছুক্ষণ ধরফরায়। তারপর দু’জন হো হো করে হেসে ওঠে। পাশে শুয়ে থাকা দুটি কুকুর নড়েচড়ে ওঠে, ঘেউ ঘেউ করে। কুকুর দুটি একটু তফাতে গিয়ে আবার শোয়। তারা আর কোনো শব্দ করতে ভয় পায়। পরস্পরের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। রাস্তার দিকে তাকাতেই চোখে চমক ওঠে। সে গাড়িটা, চরকা বুড়ির চিতই পিঠার দোকানে। বুড়ি ঘোমটা মেরে ইন্টারভ্যু দিচ্ছে। কয়েক জন উপস্থিত খদ্দেরও সাক্ষাৎকার দিল। সাক্ষাৎকার দেয়ার সময় তারা শরীরটাকে সটান করে রেখেছিল, কথা বলছিল হাত নেড়ে আর নিশ্চয়ই ভদ্রলোকের ভাষায়। তারপর ছোকরা ছেলেটি নিজেই কিছুক্ষণ বাতচিত করল, আর ক্যামেরাম্যান তা ধারণ করল। তারপর গাড়িটা ভো। লোকগুলো আগের মতো নিজেদের মধ্যে ফিরে গেল।

রাত গভীর। ইন্টারসিটি বাসগুলোর নড়াচড়াও কমে আসছে। রিক্সা আর ভবঘুরের রাজত্ব এখন। আশপাশের হোটেলগুলোতে মানুষের আনাগোনা বেড়েছে। কেউ ধাই করে হোটেলে ঢুকছে, কেউ ইতস্ততভাবে। রাস্তায় বিক্ষিপ্তভাবে পরীরা ঘুরছে। মুখে স্নো পাউডার মেখে, মাইম খেলুড়ে সেজেছে। কেউ সরাসরি কথা বলছে, কেউ চারদিকে ঘুরঘুর করছে; কখনো পরীরাই হাতছানি দিচ্ছে। গানে নাচে নাগর খুঁজছে। দামে রফা হলে-- আশপাশের কোন খুপড়ি কিংবা হোটেলে অভিসার। ক্রমে পরীদের সংখ্যা বাড়ছে। কিছু জিন দৈত্যও আছেÑ এরা হঠাৎ আসে। ছলিম আলী ও হাফিজ মিয়া রাস্তা পেরিয়ে সোজা হাঁটতে থাকে। কচুরিপানার মতো মানুষের আনাগোনা। আপনমনে চলছে। যেন জোম্বি। রাস্তার পাশে দেয়াল ঘেষে কিছু খুপরি, বেশির ভাগই অস্থায়ী। কেউ আবার শুধু মশারি টাঙ্গিয়ে শুয়েছে। কয়েকটি খুপরির বিশেষ ব্যাপার রয়েছে, সেগুলো ঘিরে কিছু মানুষ। বিরতি দিয়ে একজন আসে, একজন যায়। যাওয়ার আগে আকারে ছোট চেহারার দৈত্যের মতো একজনের হাতে কিছু ধরিয়ে দিতে হয়। অদূরে কর্তব্যরত পুলিশ নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করছে।

চৌরাস্তার পাশে মাইজভান্ডারির গান হচ্ছে। আগরবাতির ধোঁয়া আর মোমবাতির আলোয় গান করছে এক প্রৌঢ়া, সঙ্গে একটি বালিকা। বাকিদের দেহ আন্দোলিত, দাঁড়িয়ে বসে। তাদের মাঝখানে সালু কাপড়ে তৈরি  চৌকোনা একটি স্থাপনা, এর মধ্যে একটি সিলভারের পাত্র-- সেখানে টাকা, মোমবাতি, আগরবাতি। মাঝেমধ্যেই তারা হৈ-হুল্লোড় করছে। দূর থেকে মনে হয় যান্ত্রিক দেহগুলো বাতাসে ভাসছে। হাফিজ মিয়া ফিস ফিস করে কয়Ñ জানেন, ছলিম ভাই, এহানে জিন আছে। ছলিম মাইজভান্ডারের জটলায় ঢুকে পড়ে, শরীরটা কেমন যেন হালকা হয়ে যায়, গানের তালে তালে সে নাচতে থাকে। খিচুরি খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। তৃপ্তি নিয়ে খায়, সোয়াদই আলাদা। গানের তাল লয়ের সঙ্গে নাচের দামাকা চলছে। ক্লান্তি নেই। ডানে বামে দেহ দুলিয়ে গেরুয়া মানুষেরা অবিরত নাচছে। ইয়া বড় বড় তাদের চুল, টান টান দেহ। হঠাৎ করে হক মাওলা হাঁক ছাড়ছে। কয়েকজন আবার বসে শুয়ে-- শরীর দাপিয়ে চলছে। তৃপ্তির ঢেকুর তোলে তারা মজমা থেকে বেরিয়ে আসে। দেহে উষ্ণতা অনুভব করে। কিছুক্ষণ হাঁটে, শরীর ভারি লাগে। হাঁটতে কষ্ট লাগে। জার্নি বাই রিক্সা করতে ইচ্ছে হয়। কয়েকবার ট্রাই করে। যেতে চায় না, যারা যেতে চায় তারা অনেক ভাড়া চায়। অনুরোধেও রাজি হয় না, বলে পরীদের বহন করলে অনেক লাভ। কিছুক্ষণ মেহনতের পর ঘণ্টা চুক্তিতে একটি রিক্সা নেয়। খোলা হাওয়ায় চুলে দোল ওঠে, মনেও। নয়া পল্টন ধরে কাকরাইলের দিকে যাচ্ছে। চৌরাস্তায় রিক্সাটিকে ঘিরে চার তরুণ, প্রাইভেট কার থেকে দ্রুত নেমে আসে। চেহারায় আভিজাত্যের ছাপ, কোমল, পোশাকে আশাকে অদ্ভুত- কানে দুল, হাতে ব্রেসলেট, থুতনিতে একটুখানি দাড়ি, একজনের হাতে রিভলবার, বাকিদের হাতে চাক্কু। একজনের হাত ব্যানার-কাপড়ে মোড়া, রক্তে ছয়লাব। ওরা হেসে ওঠে।

ওই কি আছে ছাড়, কুইক। ওরা আরো জোরে হাসে। ভদ্রগোছের ছিনতাইকারিরা তেড়ে আসে। ওরা তড়িঘড়ি করে স্টেডিয়াম মার্কেট থেকে কেনা দুটি চোরা মোবাইল এগিয়ে দেয়। - প্রাইভেট কার দিয়া আইছি, এসব ফকিরনি মোবাইল গিফট নেওয়ার লাইগ্যা না। নগদ কি আছে। ওরা আবার হাসে। কয়  সম্মানিত আমরা হইলাম আপনাগো ছিনতাইতো ভাই, এখনো কিছু আর্ন করতে পারি নাই, মাফ কইরা দেন। তরুণরা দু’জনের চার গালে চারটি থাপ্পর মেরে এবাউট টার্ন নেয়। যাওয়ার সময় ফকিরনি মোবাইল দুটি ওদের মুখে ছুড়ে মারে। আর কয়েকটি ইংলিশ গালি দেয়। দেও দানোর প্রস্থান পথে তারা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। ব্যাপারটি স্বপ্ন নাকি বাস্তব বুঝতে সময় নেয়। এতক্ষণ কেন হেসেছিল কারণ খুঁজে পায় না, তবে কান্নার কারণ বুঝতে পারে। ফিরতি পথ ধরে। চরকা বুড়ির পাশে লেপ্টি মেরে বসে।

রাত্রি শেষ প্রহরে। হাফিজ মিয়া চলে গেছে। ছলিম আলী আকাশের দিকে তাকিয়ে আকাশ-পাতাল ভাবছে। বুড়ির চিতই ব্যবসা শেষ পর্যায়ে। চুলো বন্ধ। বানানো ঠাণ্ডা কিছু চিতই রয়েছে। সেগুলো বিক্রি করে চলে যাবে। না হলেও সমস্যা নেই। এগুলো দিয়ে সকালের নাস্তা হবে। একটা রিক্সা এসে থামল, যাত্রী দুই পরী। আলুথালু দেহ। গতর ব্যবসা শেষে বাড়িমুখো। ধকল গেছে সারা রাত, বুঝা যায়। রিক্সাঅলা তাদের হাতে চিতই পিঠা দেয়। কামড় দেয়, ছিড়তে সমস্যা হয়। বাটির তলানিতে কিছুটা ভর্তা  অবশিষ্ট আছে, তাই খুচিয়ে খুচিয়ে বের করছে। ঘুমো-ঘুমো চোখ জলে ভিজে। কোত্থেকে বলশীল ও দেহশালী দুই দৈত্যের উদয় হয়। তারা পরীদের সামনে দাঁত বের করে অট্যহাস্য করে। পরীরা এতে ভীত হয় না। দৈত্যরা ওদের নিয়ে যেতে চায়, মেয়ে দুটি যেতে চায় না। ওরা তখন টানাটানি করে। আশপাশে যারা আছে তারা তখন আকাশের তারার সৌন্দর্য উপভোগ করে। ইতিমধ্যে একজনের শাড়ি উধাও। পরীরা ধীরে ধীরে ধরাশায়ী হয়। তারা দৈত্যদের সঙ্গে কাছের গলিতে ঢোকে।

অনিন্দ্য সুন্দরী এক পরী এগিয়ে আসছে। প্রতি শেষরাতেই আসে। বুড়িকে জড়িয়ে ধরে। অতঃপর জিনিসপত্র  গোছাতে শুরু করে। ধীরস্থিরভাবে রওনা দেয়। ছলিম আলী পেছনে পেছনে, একটু দূরত্ব রেখে। পরীটা পেছনে, চোখে চোখ লাগে, মেয়েটি মৃদু হাসে। ছলিম থায় দাঁড়িয়ে, মাথা নিচু। কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না। আবার এগুতে থাকে। আবার ফিরে তাকায়। ছলিম আলী আবার থমকে দাঁড়ায়। রাতের পর রাত চলছে এই ইঁদুর-বেড়াল খেলা।

গরম পানির গলিমুখে তারা চলে আসে। এখানে ঢোকার ও বের হবার অনেক গলি। গরমপানির স্রোতে জিন পরী দেও দানো মাছ হয়ে ভাসে। বাণে ডাকা কই মাছের মতো উছলে ওঠে। চরকা বুড়ি হঠাৎ ঘুরে ছলিম আলীকে ইশারা করে। কাছে আসার আহ্বান। সে যত এগোয় ততই বিশাল আকাশ ছোট হতে হতে তাকে সংকীর্ণ বৃত্তে আবদ্ধ করে। কাছে এলে আঁচলখোলা নাতনিকে সামনে রেখে বলে, এই ছেমরা পানি ভাঙার মুরোদ আছে। ছলিম আলী নতমুখো, আসলে তার-- সাধারণ অঙ্গ এবং বিশেষ অঙ্গ- সবই।


বাংলাদেশ সময় ১৭০৫,  এপ্রিল ০৮, ২০১১

fokrul

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।