ভরা শীতকাল। বাংলাদেশের সর্বোত্তরের জেলা।
কয়েক বছর থেকেই রুস্তম আলীর অসুস্থ স্ত্রী চলৎশক্তিহীন। এবারকার শীতে তার প্যারালাইসিসটা আরও বেড়ে গেছে। কয়েকবার তো তার মৃত্যুর খবর গ্রাম-ময় ছড়িয়ে পড়েছিল। রুস্তম আলীর হাতে টাকা নেই, তাই তার অসুস্থ স্ত্রীর চিকিৎসাও শীতে আক্রান্ত প্রকৃতির মতো ঝিমিয়ে পড়েছে। একই চালার নিচে পাশের বিছানায় নিশ্চল পড়ে থাকা স্ত্রীকে দেখে মনের গহীনে জেগে ওঠা বিকৃত অনুভূতি নিয়ে ঘুমাতে না পেরে সারারাত জেগে থাকে রুস্তম আলী। মাঝে মাঝে মাথাটা তার স্ত্রীর শরীরের মতোই ভারী হয়ে নিশ্চল হয়ে পড়তে চায়, জেঁকে ধরে মাথার ভেতর দৌড়-ঝাপ খেলতে থাকে জীবনসত্য, চিন্তা এবং জীবনে ব্যর্থতার দায় অনুভবের ফলে সৃষ্ট বিকৃত অনুভূতিগুলো। মৃত্যু ভয়ে প্রচণ্ড ভীত মানুষ যখন দূরারোগ্য কোনো ব্যধিতে আক্রান্ত হয়ে তার মৃত্যুকে নিশ্চিত জানতে পেরে অপেক্ষা করে মৃত্যুর জন্য, তখন সেই রোগীর মানসিক অবস্থা কী হয়? মানসিক যন্ত্রণায় মাঝে মধ্যে সেই অনুভূতিটাকে কল্পনা করে রুস্তম আলী। আজকের রাতটাও তার জেগে জেগেই কেটে যায়।
ভোর রাতেই শীতের পিঠা বানাতে বসেছে রুস্তম আলীর দুই মেয়ে আর বড় ছেলে মুন্না’র বৌ। বাড়িতে এক মৃত্যুপথযাত্রী সত্ত্বেও পিঠার ধুম! দীর্ঘদিনের অসুস্থ মানুষের প্রতি হয়তো এক ধরনের শৈথিল্য চলে আসে নিকটাত্মীয়-পরিজনের। সয়ে যায় সব যন্ত্রণা। রোগীর প্রতি রুটিন মাফিক কিছু দায়িত্ব পালন ছাড়া হয়তো নির্বিকার চিত্তে নিজের বেঁচে থাকাটাই স্বাভাবিক ধর্ম হয়ে ওঠে মানুষের। একসময় হয়তো অবচেতন মনে অসুস্থের মৃত্যুও সকলের কাছে কাম্য হয়ে ওঠে। সুতরাং জীবন কোলাহলকে স্বাভাবিক গতিতেই চলতে দেয়া উত্তম। এদের বেলায়ও থেমে নেই আনন্দভোজন। কিন্তু রুস্তম আলী শীতের সকালের গরম পিঠা খেতে ছেলের বৌয়ের আহবান উপেক্ষা করে চাদর মুড়ি দিয়ে বেরিয়ে পড়ে। রাতেই সে ভেবে রেখেছে। সুদের উপর টাকা নিয়ে স্ত্রীর চিকিৎসাটা করাতে হবে। তাই টাকা নিতে বেরিয়ে যায় জালাল উদ্দিনের বাড়ির উদ্দেশ্যে। জালাল এ এলাকার একমাত্র সুদের কারবারি। বহু সামন্তের ডুবে যাওয়া নাকের উপর পূর্ণরূপে ভাসতে চাইছে জালালের দাদন ব্যবসার নবতরী।
ঘন কুয়াশা যেন ভোর হওয়াটাকে মেনে নিতে চাইছে না। সূর্যের দেখা নেই। চারিদিকে ঘন সাদা কুয়াশা। দশ হাত দূরের সবকিছুকেই চাঁদনী রাতের কালো ভূত বলে ভ্রম হয়। রাস্তার দু’পাশের সারি-সারি গাছের পাতার বুকে জমে থাকা শিশির পতনের শব্দ যেন হালকা রাগের বৃষ্টির গানের মতো ছন্দ তুলে অনবরত বেজে চলেছে। শুধু চোখ দু’টো বের করে একটা কালো রঙের শাল-চাদরে সর্বাঙ্গ ঢেকে নিচু দৃষ্টিতে কুয়াশায় ভেজা ধূলো মাড়িয়ে স্ত্রী-টাকা-চিকিৎসা ভাবতে ভাবতে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে রুস্তম আলী। মুক্তোর মতো জমে থাকা কুয়াশার ফোঁটা ফোঁটা পানি পাতা থেকে পাতায়, তারপর ধরিত্রীর বুকে পতনের গানের চেনা ছন্দটা রুস্তম আলী কি শুনছে! অথবা জানতে পারছে কি গাছের পাতার বুকে ঝুলে থাকা মুক্তোর দানাগুলো খসে ধুলোয় পড়ে কোথায় মিলিয়ে যায়! রেখেছে কি মুক্তোর দানার মতো জমাট বাঁধা শিশিরকণাগুলোর রহস্যময় জীবনের খবর।
‘কায় বারে?’—হঠাৎ ডাকে সম্বিত্ ফিরে আসে রুস্তম আলীর। দাঁড়িয়ে পড়ে সে। মাথা তুলে সামনে তাকাতেই আলম আবার বলে ওঠে, ‘কুণ্ঠে যাছিস্ বারে এত সাকালে কুয়াশা খানত্। ’
‘যামু একটু জালালের কাছে। অর নগত্ খুব দরকার আছে। ’ উত্তর দেয় রুস্তম আলী।
‘কিতায় বারে? টাকা পাইসার দরকার না কি। টাকার কেস্ ছাড়া তো র্অঠে কাহ যায় না। ’
‘তোর চাচীর অসুখটা কয়দিন থেকে বেশি হইচে। ’ আলমের প্রশ্নের উত্তরে জানায় রুস্তম আলী।
‘যে ঠাণ্ডা পইছে বারে। হাম্রা চেংরা লোক্লায় সহিবা পারি না, ঠক্ঠকায় কাঁপেছি, আর তুম্রা বুড়া লোক্লা কেঙ্কো সহিবেন্। যা বারে। মুই কুনিক্ ওত্তি যাম্। ’—বলেই পার্শের রাস্তা ধরে এক মুহূর্তে কুয়াশার গহীনে অদৃশ্য হয়ে যায় আলম।
জালালের বাড়ির দিকে যেতে যেতে রুস্তম আলী ভাবতে থাকে, ‘যে করেই হোক দুই হাজার টাকা নেয়নই লাগব। দুই হাজার টাকার সুদ মাসে কত হবো? দুইশ টাকা। কোনো ব্যাপার না। কী করবার আছে আমার। জমি জায়গা যা আবাদ করি তাতে এতগুলো মুখের সংসার চলে না। কামও নাই। মুন্না’র মায়ের চিকিৎসাটাও করান লাগবো। কী যে করি। ’
বিবিধ উপায় ভাবতে ভাবতে রুস্তম আলী জালালের বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছে। হঠাৎ পথে জালালের স্ত্রীর সঙ্গে দেখা। রুস্তম আলী জালালের স্ত্রীর দিকে ভালো করে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। তার মুখমণ্ডলে কোন ভাষা লুকিয়ে আছে তা বোঝার সাধ্য রুস্তম আলীর নেই। ছেঁড়া জোড়াতালি দেয়া ময়লাযুক্ত একটা কাপড় পরনে। কাপড়ের একটা প্রান্ত দিয়ে মাথা ও কান ঢেকে ওগুলোকে শীত থেকে বাঁচাতে চেষ্টা করেছে। পাড় বরাবর ছেঁড়া কাপড়টায় সেলাই না থাকায় ডান পাশের কানটা একটুখানি বেরিয়ে আছে। প্রায় হাঁটু পর্যন্ত ঝুলে পড়া একটা সোয়েটার গায়। আধা পাকা ময়লা চুলগুলো যেন কাপড়ে ঢাকা চুড়ুই পাখির বাসা। পায়ে স্যান্ডেল নেই। দেখতে পাগলের মতো। কিন্তু রুস্তম আলী জানে, সে পাগল নয়।
‘কুণ্ঠে যাছিস্ ভাবি? ভাই বাড়িত্ আছে?’ বলে রুস্তম।
‘আ যাছু কনেক্ পঁচাগড়। তোর ভাইট্ঠে যাবো? কিতায় রে। বাড়িটাতে আছে। যা কেনা। ’—হাড় কাঁপানো শীতে আক্রান্ত অনিচ্ছা জনিত কাঁপা কাঁপা গলায় জবাব দেয় জালালের বৌ—মতির মা।
কথার সুযোগে রুস্তম আলী আরেকটি প্রশ্ন করে, ‘এত সাকালে পঁচাগড় কিতায় যাবো গে ভাবি?’
প্রথমে মতির মা খানিকক্ষণ একটু ইতস্তত বোধ করে। তারপর জবাব দেয়, ‘কিতায় যাছু জানিন্ না। তোক্ আরো কহিবা নাগে। তোর ভার্ই ব্যব্সাখান্ জানিন্ না। আজান্টা পইল্ মন্তরে ঠেলিবা ধইল্যে। বিছানা খানত্ অহিবায় না দেয়। পঁচাগড় একদিন ভিখমাগিবা না যাইলে খাবা দিবা নাহায়। ডাঙ্ঘায় বাড়ি তকা নিগ্লায় দিবে। ’
কথাগুলো শুনে খুব অবাক হয় রুস্তম আলী। যদিও রুস্তম আলী আগে থেকেই অবগত ছিল মতির মায়ের ভিক্ষাবৃত্তি সম্পর্কে। কিন্তু সে যে স্বামীর চাপে বাধ্য হয়ে এ পেশায় নেমেছে এইটুকু জানা ছিল না রুস্তম আলীর। জালালের বৌকে পাশ কেটে যাওয়ার জন্য রাস্তা দিয়ে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে রুস্তম আলী মনে মনে ভাবে, ‘হায়রে জগৎ! কালে কালে আর কী দেখাবি বল। ’ মুহূর্তেই রুস্তম আলীর নিঃশ্বাস যেন ছোট হয়ে আসে। বুকের ভেতর ভারী ভারী অনুভব করে। চিন্তাগুলো মাথার ভেতর কেমন যেন গুলিয়ে যায়। গায়ে কাঁটা দিয়ে ঝাঁকুনি মারে তার শরীর। পুনরায় একটা অপূর্ণ দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে চাদরটা গায়ে ভালোভাবে জড়িয়ে নিয়ে আবার চলতে শুরু করে রুস্তম আলী। ঐতো সামনেই জালালের বাড়ি।
‘জালাল ভাই বাড়ি আছিস। এ... এ... জালাল ভাই। ’ বাড়ির বাইরে থেকে ডাকে রুস্তম আলী।
‘কায়রে?’ বাড়ির ভেতর থেকে সাড়া দেয় জালাল।
‘মুই রুস্তম। কুনিক্ বাহিরত্ আয়। তোর নগৎ কাথা আছে। ’
‘কিরে, এত সাকালে ঠাণ্ডাখানত্ মোর্ঠে! বাড়ি তকা আসিলো। কিতায় কহেক্দি। আয় আয় বাড়ির ভিতরত্ আয়। ঠাণ্ডাখান্ কি পড়িবা ধইছে কয়দিন তকা দেখিচিস্না। মানুষলা কেঙ্কো বাঁচিবে কহেক্দি। ’—বলতে বলতে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গিয়ে টিনের ছাপড়া ঘরের বারান্দায় একটা বেঞ্চ পেতে বসতে দেয় রুস্তম আলীকে। জালাল নিজেও বেঞ্চটির অপর প্রান্তে বসে।
‘কহ, কী মনে করে আসিলো। মোর বাড়িত্ তো কাহয় দরকার ছাড়া আইসে না। মুই আছু বাদে গ্রামের লোক্লা বিপদ-আপদ হাতে উদ্ধার পাছে। ’ চিবুক কুঁচকে যাওয়া মুখে একটা বিমূর্ত হাসির রেখা এঁকে গর্বের ভঙ্গিতে বলল জালাল।
‘হ্যাঁ ভাই, তুই ঠিকে কহিছিস্। মুইহ বিপদত্ পড়েই আইচ্চু তোরঠে। হামার মুন্না’র মায়ের অসুখটা বেশি হইছে। চিকিৎসা তো মেলা কোন্নু, ভালো হইল্ নাই। ভাবেচু এইবার একটা ভালো বড় ডাক্তার দেখাম্। মোর তো অবস্থাটা জানিস্। হাতত্ টাকা নাই। ঐতানে তোরঠে আসিনু। ভাবিনু, ভার্ইঠে যায় দেখু। কিছু টাকা যদি পাইল্ যায়। ’ কথাগুলো নিতান্ত বিনয়ের স্বরে বলে রুস্তম আলী।
‘সেত্তো রে। টাকা তো আছে। তোর কত নাগিবে কহেক্দি। ’ জানতে চায় জালাল।
‘হাজার দুই দিবা পারিবো না! হোবে কি ?’ রুস্তম আলী বলে।
‘দুই হাজার!’ শব্দটা শুনে মাথা চুলকাতে চুলকাতে জালাল একটু ভেবে বলে, ‘পারিম্, কনেক্ দেখিবা নাগিবে। তুই বস্। মুই আইসেচু। ’
কিছুক্ষণ পর হাতের মুঠোয় রাবারে বাঁধা কয়েকটি এক টাকা দুই টাকার নোটের বান্ডিল ও একটা সাদা কাগজ নিয়ে ঘরের ভেতর থেকে বের হয়ে আসে জালাল। এক টাকা দুই টাকার নোটের বান্ডিলগুলো দেখে রুস্তম আলীর মনে পড়ে যায় জালালের বৌয়ের সঙ্গে রাস্তায় সাক্ষাৎ হওয়ার ঘটনাটা। কী যেন ভাবতে গিয়ে রুস্তম আলী অস্ফুট স্বগোতোক্তি করে, ‘না। আমি ওগুলো নিয়ে কিছু ভাবতে চাই না। আমার এখন টাকার দরকার। শুধু টাকা পাইলেই আমি খুশি। টাকা এখন জালালের। কোথা থেকে এসেছে কীভাবে এসেছে তা আমার জানার দরকার নেই। ’
জালাল রুস্তমের হাতে কাগজটা দিতে দিতে কোটরের ভেতরে থাকা চকচকে চোখে একটা দীপ্তি ছড়িয়ে বলে, ‘নে, কাগজটা ধর। কিছু মনে করিন্ না। লেখালেখি ছাড়া—আসলে টাকা পাইসার ব্যাপার তো। লেখালেখি করে নেয়া ভালো। যে দিন-কাল পইছে। আজি আর কাক্ বিশ্বাস করিবো কহেক্। তুইতো কনেকাতেক্ লেখাপড়া জানিস। ছোট করে তুইহে লেখ। ’
রুস্তম আলী কাগজ-কলম হাতে নিয়ে জালালের নির্দেশনা মোতাবেক ঋণপত্র লিখে সই করে দেয়। মাসিক সুদ শতকরা দশ টাকা। টাকার বান্ডিলগুলো রুস্তম আলীর হাতে দিয়ে জালাল গুণে দেখতে বলে। রুস্তম আলীর টাকা গোণার ফাঁকে জালাল ঋণপত্রটিতে কয়েকবার ভালোভাবে চোখ বুলিয়ে নেয়, সব ঠিক আছে কি না। দুই টাকা-এক টাকার নোটগুলো ঠিকঠাক গুণে নিয়ে রুস্তম আলী বলে, ‘ঠিকে আছে। তাহিলে ভাই আজি উঠেচু। ’
‘বস্কেনা। চা খায় যা। আ বৌমাক্ কহচু চা উটিবা। ’ রুস্তমকে চা পানের আহবান জানায় জালাল।
‘না ভাই। আজি না হায়। আরেক্ দিন আসে চা খায় যাম্। ভাবি কুণ্ঠে?’ রুস্তম আলীর উত্তরে বলা কথাগুলোর সঙ্গে থাকা প্রশ্নটা নিজের অজান্তেই কিভাবে যেন মুখ ফসকে বেরিয়ে যায়।
‘তোর ভাবি কুণ্ঠে দে গেল্। ’ বলেই জালাল নিজের স্ত্রীকে খোঁজার ইতস্তত ভান করে এদিক ওদিক তাকায়।
‘থাক্ ভাই। টাকাটা দিয়ে তুই মোর খুব উপকার কোরলো। ’ এ্যালা মুই যাও। বলে বিদায় নেয় রুস্তম আলী।
‘যা ভাই। আবার আসিস্। সময়ে ঠিকঠাক মতো দিস্ ফের। ’ চকচকে চোখের কুঞ্চিত কোণ আর শুষ্ক ঠোঁটের কোণে একটা বিগলিত রহস্যময় হাসি এঁকে সুদাসল ঠিকসময়ে পরিশোধের ইঙ্গিত দিয়ে রুস্তম আলীকে বিদায় দেয় জালাল।
জালালের বাড়ি থেকে বের হয়ে হাঁটতে হাঁটতে রুস্তম আলী ভাবে, ‘হায়রে বিচিত্র এই জগৎ এবং জগতের মানুষ!’ আর বিচিত্র রকমের জটিল সব প্রশ্ন রুস্তম আলীর মনের কোণায় উঁকিঝুঁকি মেরে ক্লান্ত করে তোলে তার মস্তিষ্ক। রুস্তম আলী কোনো প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজে না পেয়ে শেষে নিজের অসহায়ত্বের কথা ভাবতে ভাবতে নিজের বাড়ির দূরত্ব কমাতে থাকে।
জালালের দুই ছেলে, এক মেয়ে। তিন ছেলে-মেয়েরই বিয়ে দিতে পেরে এখন সে ঝামেলামুক্ত। দুই ছেলে মতি ও খতু পঞ্চগড় জেলা শহরে রিক্সা চালায়। সকালে যায়, ফিরে রাতে। বিয়ের পর থেকেই পুত্রদ্বয় আলাদা সংসার পেতেছে। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ভালোই কাটছে তাদের দিন।
কি শীতকাল কি বর্ষাকাল, মতির মা গ্রামের রাস্তার একপাশ ধরে প্রতিদিন সকালে হেঁটে হেঁটে পঞ্চগড়ের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। একই চেহারা, একই পোশাক, চলার একই ভঙ্গি, হাতে একটা মোটা কাপড়ের তৈরি ব্যাগ; যেন প্রাকৃতিক কোনো এক অমোঘ নিয়মের সঙ্গে তার জীবনটা বেঁধে গেছে। তাই পরিবর্তনের কোনো চিত্র কারো চোখে ধরা পড়ে না। রাস্তায় হাঁটার সময় তাকে কোনোদিন কারো সঙ্গে কথা বলতে দেখা যায়নি। গ্রামের মানুষের চোখে নিত্য দিনের চেনা নিজের ছবিটা ভাসিয়ে দিয়ে নির্বাক ভঙ্গিতে পথ চলে। কখনো পথের ধারের কোনো এক গাছতলায় বসে খানিক্ষণ জিরিয়ে নিয়ে ক্লান্তি দূর করার চেষ্টা করতে দেখা যায়। প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যায় পথ চলতে দেখা যাওয়া এই পঞ্চাশোর্ধ বয়সী মহিলা একজন স্ত্রী, এবং একজন মাও বটে! কোনো পথিক এই মা’র দিকে একবার ভালো করে তাকালেই বুঝতে পারে—পৃথিবীর কারো প্রতি যেন এই চেহারাটার কোনো অনুযোগ নেই। নিজেকে নিয়ে নিজের মনের কোণায় কোনো পরিতাপ নেই—অথবা সে অনুভূতিগুলো বোঝার ক্ষমতা আল্লাহ তাকে দেয় নাই। তার জীবনের এই নিত্যগতি সম্পর্কে এখন আর দর্শকদেরও কারো কোনো কৌতূহল নেই, নেই কারো মনের কোণে কোনো প্রশ্ন। হয়তো কারো মনে কোনো একদিন ভ্রান্তিবশত প্রশ্ন জেগেছিল, ‘এর কি রোগ-শোক নেই?’ আবার মনের রহস্যময় গভীর কোণে কখন এই প্রশ্ন-উত্তর দু’টোই হারিয়ে গেছে, ভাবুক নিজেও খেয়াল করে নি। মানব বসতির এরূপ বহুবিচিত্র চিত্র নিয়ে ভাবার সময় বা মন মানবের আছে কি?
মতি ও খতু রিক্সা নিয়ে শহরের উদ্দেশ্যে যাওয়ার পথে প্রতিদিন সকালে মা’কে পাশ কেটে চলে যায়। যাত্রী নিয়ে, অথবা খালি। প্রথম প্রথম জালাল যখন তাকে এ কাজে বাধ্য করে বাড়ি থেকে বের করেছিল—তখনও এভাবে ছেলেদের পাশ কেটে যাওয়ার সময় মতির মা ভাবত, “এই বুঝি ছেলেরা বলে, ‘মা, রিক্সায় উঠো। ” কিন্তু প্রতিদিনই তার ভাবনা তাকে হতাশায় ডুবিয়েছে, কখনো কখনো একটা পাথুরে অনুভূতি বুকটা ভারী করে তুলতো। দিন গেছে। এখন আর মতির মায়ের বুকে কোনো পাথুরে অনুভূতি বা হতাশা নেই। কারণ সে আবিষ্কার করতে পেরেছে, তাদের মা-সন্তান সম্পর্কটা বহুদিন আগেই কোনো এক শুষ্ক মরুভূমির প্রান্তরে ঝরে পড়া কয়েকফোঁটা বৃষ্টির মতোই বিলীন হয়ে গেছে, অথবা নিঃশেষ হয়ে গেছে প্রদীপের আগুন যেমন করে তেল শুষে নেয়, তেমন করেই। অশিক্ষিত মতির মা ব্যাখ্যাতীত অনুভূতির বেড়াজালে পড়ে মনেও করতে পারে না, তারই জন্ম দেয়া সন্তানদের সঙ্গে তার সম্পর্কটা নিঃশেষ হলো কিভাবে। এই বিশ্ব চরাচরের নিত্য কোলাহলের মাঝে থেকেও সে যেন আজ অভিশপ্ত জীবন নিয়ে বড়ই নিঃসঙ্গ। তাই পাশ কেটে ছেলেদের চলে যাওয়া মতির মা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে, আর কি জানি কী ভেবে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে ঠোঁট দুইটি ঈষৎ কাঁপিয়ে অস্ফুটস্বরে বলে ওঠে, ‘বাবারে, তোরা ভালো থাক। ’ আর মনের গহীন কোণ থেকে একটা শব্দ মতির মা’র দেহের ক্লান্তি আর অন্তর ফাটা দীর্ঘনিঃশ্বাসের সঙ্গে মিলে বেরিয়ে যায়, ‘শহর অনেকদূর। ’
মতির মায়ের শরীরে বুঝি ব্যথা নেই। কোনো দিন কি কোনো অসুখ অনুভব করেছিল মতির মা! তবে আজ শরীরটা খুব খারাপ লাগছিল মতির মায়ের। ঠাণ্ডায় প্রায় অবশ হয়ে যাওয়া হাত কপালে ঠেকিয়ে অনুভব করতে চাইছে নিজের শরীরের তাপের মাত্রাটা। মাথাটাও কেমন যেন ঝিমঝিম করছে। চোখ দু’টো তার আগুনে পোড়ার মতো জ্বালাপোড়া করছে। বাড়ি থেকে কিছুদূরে পেত্তানিহাটের কোণে চৌরাস্তার মোড়ে বসে ভাবছে, ‘আজি আর বুঝি শহরত্ যাবা পারিবানাহু। কিন্তু, বাড়িত্ ফিরে যাম্? না। সারাদিন বাড়ির ভিতরত্ ঢুকিবা দিবানাহায় মরাটা। দিনটা বাহিরতে কাটিবা হোবে। দিন শেষোত্ জমার হিসাব দিম্ কেঙ্কো?’ হঠাৎ তাঁর মনে পড়ল—ছেলেরা একটু পড়েই রিক্সা নিয়ে শহরে যাবে। আজ তাদের বলবে, তাকে রিক্সায় নিয়ে যেতে। রাস্তার পাশে বসে অপেক্ষা করছে কখন আসবে মতি ও খতু। কিছুক্ষণ পড়েই মতি ও খতুকে আসতে দেখে মতির মা নিজের ভেতর কোনো এক অজানা উৎস থেকে বিমূর্ত উৎফুল্লতা এবং বিশ্বস্ত নির্ভরতা অনুভব করে দাঁড়িয়ে বলে উঠল—
‘ও মতি, মতি রে। মোক্ নিয়া যা না বাপ্। ’
মতির চোখে চোখ পড়তেই মতির মা ভয় পেয়ে গেল। মুহূর্তেই যেন পৃথিবীসুদ্ধ ভয় বাড়িয়ে দিল তার হৃৎপিণ্ডের গতি। কেমন একটা প্রচণ্ড বিদঘুটে ঝড় দ্রুত সঞ্চালিত হলো। মতি একটু ইতস্তত বোধ করে পেছনে থাকা ছোট ভাই খতুকে বলল—
‘এই খতু। বুড়িটাক্ অঠায় নেত। ভাড়া নিস্। ’
‘মুই অক্ নিবানাহু। অক্ নিলে মোর সাইট্ হবানাহায়। ’ উত্তর দিল খতু।
কথাটা শুনে মতির মা’র মাথাটা কেমন যেন চক্কর মেরে অন্ধকার হয়ে এলো চোখের দৃষ্টি। কষ্টের অনুভূতির ভাষ্য প্রকাশ না পেয়ে বুকের ভেতর একটা ভারী পাথরের নিচে চাপা পড়ে রইল। মুহূর্তেই ভিজে ওঠা চোখের ঝাপসা দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল, দুটো রিক্সা আস্তে আস্তে ছোট হয়ে এক সময় মোড় ঘুরে হারিয়ে গেল। শহরের উদ্দেশ্যে পা বাড়িয়ে পরনের লম্বা সোয়েটারের ভেতর থেকে ছেঁড়া কাপড়ের একটা প্রান্ত বের করে ভেজা চোখ দু’টো সযত্নে মুছে শুকিয়ে নিল মতির মা। তারপর একটা বুক খালি করা দীর্ঘনিঃশ্বাসের সঙ্গে মনে হয় হতভম্ব মতির মায়ের সকল জাগতিক কষ্ট দূরীভূত হলো।
এক সপ্তাহ পর। স্ত্রীকে হারিয়ে বিষণ্ন রুস্তম আলী ফজরের নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে ফেরার পথে সেই চৌরাস্তার ওপর সকালের কুয়াশা ভেঙ্গে চির চেনা ভঙ্গিতে মতির মাকে শহরের উদ্দেশ্যে গমনরত দেখে জিজ্ঞেস করে, ‘ভাবি কেমন আছিস?’ কোনো উত্তর না পেয়ে রুস্তম আলীর মনে পড়ে যায়; সেই এক টাকা-দুই টাকার নোটের বান্ডিলের কথা।
তারপরও বহুদিন মতির মাকে একই ভঙ্গিতে সকাল-সন্ধ্যায় এই রাস্তায় চলতে দেখা গেছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৪৪৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ৮, ২০১৪