ঢাকা, শনিবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

৭৫তম জন্মদিনে

হাসান আজিজুল হকের সাথে আলাপ

শিল্প-সাহিত্য / সাক্ষাৎকার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২১১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২, ২০১৪
হাসান আজিজুল হকের সাথে আলাপ

হাসান আজিজুল হক এই জীবনে সাক্ষাৎকার একেবারে কম দেননি, অনেক কথাও বলেছেন। তার কথার আলাদা গতি আছে, প্রেম-বাসনা আছে।

তিনি যেন এক কথামুখর মানব। তার সাথে কথা বলে কখনও ক্লান্তি আসে না। যেন আমাদের সংস্কৃতির এক জার্নি তিনি আমাদের জন্য বয়ে বেড়াচ্ছেন। আজ তার ৭৫তম জন্মদিন। আমরা যেন কোনো না কোনোভাবে উদ্ভাসিত হচ্ছি। তাকে আমরা ভালোবাসার চেয়েও ভালোবাসি। তিনি আমাদের মনোমন্দিরে চিরদিন স্পষ্ট হয়ে থাকুন। তার সাথে টেলিফোনিক কিছু কথাবার্তাই এখানে দেয়া হলো। - কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর


কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর: আপনাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা। ৫-৬ দিন পরই আপনার ৭৫তম জন্মদিন! আপনাকে অগ্রিম স্বাগতম,— হাসান ভাই, আপনি কেমন আছেন?

হাসান আজিজুল হক: অনেক দিন পর কথা বলছো, এই ভালো-মন্দ নিয়ে আছি আর-কি।

কা.জা: আপনার শৈশব সম্পর্কে জানতে চাই,— আপনি বর্ধমানের সেই যবগ্রাম স্কুলেই তো ভর্তি হয়েছিলেন?

হা.আ.হ: হ্যাঁ, জমিদার মহীন্দ্র চন্দ্র নন্দী নামে এক জমিদার, খুব দানশীল ছিলেন,— আমাদের গ্রামেই বিয়ে করেছিলেন, তার স্ত্রী স্বর্ণকুমারী দেবীর নামে স্কুল। তারা ছিলেন শুদ্র সম্প্রদায়ের।

কা.জা: শুদ্র সম্প্রদায়ের জমিদার?

হা.আ.হ: হ্যাঁ, মোগল আমলে তা হতো, কিন্তু ইংরেজরা এসে সব ওলটপালট করে ফেললো হাহাহা। নানান ব্যাপার এর সাথে যুক্ত হলো।

কা.জা: আপনার শরীর স্বাস্থ্য কেমন?

হা.আ.হ: এক রকম চলছে— তুমি তো ডাক্তার, তোমাকে তো বলাই যায়,— দেখো, আমি তো সামাজিক মানুষ, সবসময় লোকজন আসে, আড্ডা হয়, কথাবার্তা চলে। আরেকটা সমস্যা হচ্ছে! তোমাকেই বলিই না হয়!

কা.জা: হ্যাঁ, হ্যাঁ, বলেন হাসান ভাই— প্লিজ।

হা.আ.হ: আমার কিন্তু হাঁটতে সমস্যা হয়। পা কাঁপে, কী যে হচ্ছে, নিওরো মেডিসিনের ডাক্তার দেখিয়েছি,— কিন্তু...

কা.জা: তারাও তেমন কোনো সমাধান দিতে পারছেন না?

হা.আ.হ: কী জানি, কিছুই তো বুঝতে পারছি না।

কা.জা: তারপর বয়সের তো নিজস্ব কিছু সমস্যা থাকে। ন্যাচারেল কিছু বিষয় থাকে।

হা.আ.হ: তা আছে, আগে স্ত্রী ছিলেন, এখন তার প্যাটার্ন তো একটু চেঞ্জ হবেই। এই আর-কি।

কা.জা: বাসার বাইরে যাওয়ার টাইমে, সাথে লোক থাকে তো আপনার?

হা.আ.হ: হ্যাঁ, তা থাকে। বাসায় তো দুই মেয়ে থাকে। বড়ো মেয়ে বিয়ে-থা করেনি। ছোট মেয়ের অন্য কোনো সমস্যা নাই, তবে কিছুটা ইন্টেলেকচুয়ালি হ্যান্ডিক্রাফ। তারা আমার সাথেই আছে।

কা.জা: এটা আপনার জীবনের এই প্রান্তে বিরাট একটা সাপোর্ট তাহলে! আপনার অন্য ছেলেমেয়েরা কোথায় আছে?

হা.আ.হ: মেজোমেয়ে ঢাকায় আছে— স্বামীসহ। ছেলে রাজশাহী ভার্সিটিতেই বায়োক্যামিস্ট্রির টিচার হিসাবে ছিল, এখন বউসহ জাপান আছে, পিএইচডি করছে।

কা.জা: আপনার লেখালেখির কী অবস্থা? অনেক দিন হলো আপনার গল্প পাচ্ছি না।

হা.আ.হ: গল্প তো লিখতেই পারছি না, তো পাবে কোত্থেকে?

কা.জা: কেন হাসান ভাই, লিখতে পারছেন না মানে!

হা.আ.হ: গল্প বোধ হয় আমাকে পরিত্যাগই করেছে হাহাহা! অন্যকিছু লিখছি।

কা.জা: তাহলে বড়ো কোনো লেখায় হাত দিয়েছেন,— আত্মজীবনী বা উপন্যাস?

হা.আ.হ: উপন্যাস লেখার কথা ভাবছি।

কা.জা: তা হলে তো ভালো কাজই হয়। তা কবে নাগাদ শুরু করবেন?

হা.আ.হ: তরলবালা : বঙ্গরমণী গাঁথা নামের উপন্যাসটি আর-কি। তা আবার শুরু করবো, এই বছরের মাঝামাঝি সময়ই শুরু করবো ভাবছি।

কা.জা: সেটা তো সাত খুনের সেই ঘটনার কথা! এর ভাষাও তো ব্রাহ্মণবাড়িয়া এলাকার, এ সম্পর্কে কিছু বলুন।

হা.আ.হ: আমি তো নিদারাবাদে চলে গেছিলাম। নুরুদ্দীন জাহাঙ্গীররা আমাকে গাড়িতে করে নিয়ে গিয়েছিল।

কা.জা: এবার আপনার পুরস্কারপ্রাপ্তি নিয়ে কিছু কথা বলি,— আচ্ছা, আপনি বাংলা একাডেমী পুরস্কার কখন পেলেন?

হা.আ.হ: সেটা ১৯৭০ সালে!

কা.জা: তখন আপনার বয়স কত— আপনার কয়টি গ্রন্থই বা তখন প্রকাশিত হয়েছে?

হা.আ.হ: আমার বয়স তখন কত হবে? এই ধরো ২৯-৩০। তখন মাত্র দুটি গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য আর আত্মজা ও একটি করবীগাছ।

কা.জা: সেটা তো একটা ঘটনা বটে! আপনি তখন থেকেই গল্পসাহিত্যকে আলোকিত করা শুরু করলেন? আচ্ছা, আপনি আর গল্প লিখবেন না? আমরা আপনাকে বেইসিক্যালি গল্পকারই বলতে চাই।

হা.আ.হ: কিভাবে বলি, এখন তো গল্প লিখতে পারছি না। গল্প আসতেও পারে।

কা.জা: এখন কী লিখছেন।

হা.আ.হ: এখন লিখছি আত্মজীবনীর ৪র্থ খণ্ড। এই গ্রন্থমেলায় ‘আমার রবীন্দ্রনাথ ও ভাষাভাবনা’ প্রকাশ করছে কথাপ্রকাশ; ‘এই পুরাতন আখরগুলি’ প্রকাশ করছে ইত্যাদি প্রকাশনা।

কা.জা: আত্মজীবনীর এটাই কি শেষ পর্ব?

হা.আ.হ: জানি না, দেখি, ডি-মা-ন্ড কত হয় হাহাহা। আমি এমন কী করেছি যে কথা বলতে হবে। তবে আমি চেষ্টা করেছি সবকিছুর মূল শুদ্ধ তুলে আনতে। তা আর এমন কি?

কা.জা: না না, হাসান ভাই, আমরা তো পড়বো। আচ্ছা, পুরস্কারের আলাপটা শেষ করি। ফিলিপস পুরস্কার আপনি কখন পেলেন?

হা.আ.হ: সেটা আর্লি এইটিজে মনে হয়! তা ভুলেও গেছি। সেটা কিন্তু আমি নিজে আনতেও যাইনি,— জানো?

কা.জা: তাই নাকি? আচ্ছা, আনন্দবাজার পুরস্কার নিয়ে আপনার মন্তব্য কী? এটা তো আপনার ব্যক্তিত্বের সাথে ঠিক যায় বলে মনে হয় না।

হা.আ.হ: আচ্ছা, এটা আমি মন থেকে নিতে পারি? তা তো নিইনি। ইলিয়াসও নিতে চায়নি।

কা.জা: তারপরও তো নিলেন হাসান ভাই!

হা.আ.হ: হ্যাঁ, তা নিলাম। দেখো, আমি সামাজিকতাকে অগ্রাহ্য করতে পারি না। রিফিউজ করতে পারি না, তাই না-নেয়ার নাটক-টাটকও আমার করা হয় না। তবে আমি চেষ্টা করি, যাতে এই সমস্ত পুরস্কার আমার ওপর কোনো ইফেক্ট তৈরি না করে। আনন্দবাজার থেকে আমার প্রতিক্রিয়া জানতে চেয়েছিল। আমি বললাম, আলাদা করে কী আর প্রতিক্রিয়া হবে! তোমরা আমায় পুরস্কার দেয়া দরকার মনে করছো, এটাই আমার প্রতিক্রিয়া হিসাবে নিয়ে নাও হাহাহা। আচ্ছা ভালো কথা, তুমি তো সাবিত্রি উপখ্যান নিয়ে লিখেছিলে?

কা.জা: তা লিখেছিলাম। কেন বলুন তো!

হা.আ.হ: সেইখানে তুমি যে লিখলে, উপন্যাসটির বর্ণনার ধরনে ধর্ষণকে কিছুটা প্রলুব্ধ করার চেতনা কাজ করতেও পারে, তা কিন্তু ঠিক নয়।

কা.জা: আমার তো মনে হয়েছিল হাসান ভাই।

হা.আ.হ: কিন্তু আমি সেইভাবে চিন্তাই করিনি। তাতে একধরনের ভুল বোঝাবুঝি হতে পারে। আমি কিন্তু অনেক তথ্য যোগাড় করেই লিখেছি। আমি পুরো রায়টা নিয়ে ছিলাম। তা কিন্তু উপন্যাসে আছেও।

কা.জা: যাই হোক, আমার পাঠে তা মনে হয়েছিল আর-কি। আচ্ছা, হাসান ভাই, আপনি কিন্তু সাবিত্রির বর্তমান অবস্থার দিকটা আলোকপাত করতে পারতেন। আসলে মামলার কী রায় হলো, সোশ্যাল ইফেক্ট জানতে পারতেন! একধরনের ফলোআপ...

হা.আ.হ: ভালো কথা বলেছো। তা করার ইচ্ছা আমার আছে। নিশ্চয়ই কিছু না কিছু পাওয়া যাবে—  দেখি।

কা.জা: আচ্ছা, ভাষা কি কেবল পুরানা সিস্টেমের স্কুল-কলেজেই যাবে, প্রতিষ্ঠানের সাজেশন নিয়ে বুদ্ধির ভাব নিয়ে চলবে? স্বাধীন দেশের মানুষের মুখের কাছে যাবে না?

হা.আ.হ: তাও যেতে পারে, যাচ্ছে তো; তবে জোরজবরদস্তি করে কিছুই হবার নয়, শিখিয়ে পড়িয়ে দিয়ে নয়। ভাষা হচ্ছে নদীর তীব্র স্রোতের মতো, ভিতর থেকে বদলে যাবে। মনে রাখতে হবে, এ হচ্ছে জীবনের রসায়ন, যন্ত্রের ফ্যাক্টরি নয়,— বুঝেছো?

কা.জা: মুসলিম অধ্যুষিত বাংলাদেশের ধর্মীয় সংস্কৃতির আলাদা একটা আবহ আছে, কিন্তু কেউ কেউ বলেন, বাংলাদেশের সেই ইমেজ আপনার লেখায় থাকে না।

হা.আ.হ: আমি ভাই অত হিসাব-টিসাব করি না। মুক্তমনের মানুষ, আমার মুক্তমনই সব ঠিক করে দেয়।

কা.জা: এই যে রাজনৈতিক সংঘাত, জ্বালাও-পোড়াও-লাঠিচার্জ-হত্যা-বোমাবাজি-নিপীড়ন— এর কোনো চাপ কি আপনি অনুভব করেন?

হা.আ.হ: ভালো কথা বলেছো,— আমার তো মনে হয়, এইসবের কঠিন একটা চাপ আমার ওপর পড়েছে। জীবনের উপর থেকে সমস্ত মায়া-মমতা কেমন উঠে যাচ্ছে!

কা.জা: বুঝেছি, আপনার সাথে কথা বলা মানেই একটা সাংস্কৃতিক ইতিহাসকে স্পর্শ করা,— আপনি দীর্ঘজীবী হোন হাসান ভাই।

হা.আ.হ: তোমার সাথে কথা বলতেও ভালো লাগছে— ভালো থেকো।

বাংলাদেশ সময়: ১২২৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।