তখন থেকে টেবিলের ওপর মোবাইলটা নেচে যাচ্ছে। হ্যা বেজে যাচ্ছে না নেচে যাচ্ছে।
আজ তার সময় হয়েছে বলে কি আজই তিতলিকে ফোন ধরতে হবে। অ্যাহ কি আমার চাকুরিরে, ওনার ট্যুর পরেছে বসের সাথে। যেনো আর কেউ সরকারি চাকুরি করে না আর কারো বসের সাথে ট্যুর পরে না। তাই বলে কি দু’মিনিটের জন্য কোন ফোন করা যায় না? অথচ সেদিন রাতে খালাতো বোনের বিয়েতে গেছে তিতলি। সারাক্ষণ মেসেজ পাঠিয়ে যাচ্ছে, কখন ফিরবে বাড়িতে, অনলাইনে আসবে না আজ সে? মায়ের চোখ বাঁচিয়ে লেডিস রুমে যেয়ে তিতলিকে রিপ্লাই করতে হলো, আজ দেরি হবে ফিরতে, তুমি ঘুমিয়ে পড়ো সোনা। তখন কি আহ্লাদ সায়ানের, তুমি আমার দুচোখে উড়ে এসে না বসলে আমার ঘুম আসে না জান। তার দুদিন পরেই এমন আচরণ! সায়ানকে ভীষণ একটা শাস্তি দিতে ইচ্ছে করছে তিতলির, ভীষণ। কিন্তু তিতলির পৃথিবীতে এমন কোন শাস্তিই নেই যা তিতলিকে না আঘাত করে সায়ানকে করে। এই যে ফোন তুলছে না সায়ানের, তিতলির কি কম কষ্ট হচ্ছে, কম কষ্ট? দুদিন পরেই টিউটোরিয়াল, পনের নাম্বার তাতে, সামনে থার্ড ইয়ার ফাইনাল। তাতে যোগ হবে এই নম্বর কিন্তু আজ তিনদিন হতে চললো সে পড়ায় মনই দিতে পারছে না।
ক্লাশে বসে থাকে ঠিকই, লেকচার ঢুকে না কিছুই তার কান দিয়ে। সবার চোখ বাঁচিয়ে মাঝে মাঝেই মোবাইল চেক করে, মেসেজ এসেছে কিনা। সায়ানের সাথে ঝগড়া হলে সে ঠিকমতো খেতে পর্যন্ত পারে না। মা বারবার জিজ্ঞেস করলেন আজ, ঐটুকু খেয়ে উঠে গেলি? সামনে পরীক্ষা তাই বাঁচোয়া, নইলে বাসার সবাই ভাবতো কি হয়েছে তিতলির? কিন্তু তাতে সায়ানের কি? তার তো তিতলির মতো মনের ছাপ মুখে পড়ে না। সে মহানন্দে অফিস করে যায়। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে, কান্না পাচ্ছে এখন, তিতলি নিজেকে সামলানোর জন্য পিসিটা অন করলো। ভাবলো কিছুক্ষণ গেম খেললে হয়তো মনটা একটু হালকা হবে। তারপর ঠিক করে মন দিয়ে পড়তে বসবে। করবে না করবে না ভেবেও কখন যেনো মেসেঞ্জারে লগ ইন করে ফেললো। আর যায় কোথা, সায়ান ওকে ধরে ফেললো। এই এক সমস্যা তিতলির, সায়ান পাশে থাকলে তার মাথা আর হৃদয় আলাদা ভাবে কাজ করে না। সায়ান তার মাথার বারোটা বাজিয়ে ফেলে। মাথা অফ হয়ে শুধু মন কাজ করতে থাকে তার। যেভাবেই হোক, যতো কাণ্ডই ঘটুক সায়ান তাকে ঠিক বুঝিয়ে ফেলবে। সে কিছুতেই আর রাগ করে থাকতে পারবে না।
তিতলি কেঁদে কেটে তারপর এক সময় আবার সব ভুলে যাবে। হাঁদা সায়ানটা এসে লাইব্রেরির সামনে দাঁড়ালে তিতলি ওর সাথে না যেয়ে কিছুতেই পারে না। কতো ভাবে নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করে, কোনো দিকে তাকাবেই না সোজা লাইব্রেরিতে ঢুকবে আর বেড়োবে কিন্তু লাইব্রেরির কাছাকাছি আসতেই তার অবাধ্য চোখ দূর থেকে কাকে যেনো খুঁজতে থাকে। সায়ান পাশে এসে খুব নরম গলায় যখন ডাকবে ‘জান, কেমন আছিস” তখন তিতলি আর এড়াতে পারে না। সব ভুলে সায়ানের হাত ধরে সে উড়তে থাকে। আর ভিতরে ভিতরে তিতলি জানে, সায়ানও জানে তার এই দুর্বলতার কথা। যখন অভিমানের তীব্রতা কমে যায় তিতলি অনেক সময় নিজেও খুঁজে পায় না কি নিয়ে সে এতো রেগে গেছিলো। হ্যা, তিতলি স্বীকার করে তার রাগের কারণগুলো হয়তো খুবই সামান্য কিন্তু এই পৃথিবীর সবার কাছ থেকে পাওয়া সব আঘাত সইতে পারলেও সায়ানের কাছ থেকে সামান্যের থেকে সামান্য অবহেলাটুকুও সে সইতে পারে না। এই পৃথিবীর কারো কাছে সে হয়তো কিছুই না কিন্তু কোথাও একজন আছে যার তিতলির গলা না শুনলে ভোর হয় না, তিতলি উড়ে এসে তার চোখে না বসলে সে ঘুমাতে পারে না, মন দিয়ে অফিস করতে পারে না। তিতলিকে ঘিরে কারো দিন ও রাত আবর্তিত হয়, এই অনুভূতিটা কি কম? শুধু এই অনুভূতিটাই তিতলিকে দিন রাত হাওয়ায় ভাসিয়ে নিয়ে চলে।
মেসেঞ্জারে টুকটুক করে সায়ানের সাথে কথা বলতে বলতে কখন যে রাত তিনটা বেজে গেলো টেরই পেলো না তিতলি। সায়ান তাগাদা করলো ঘুমকাতুরে তিতলিকে শুয়ে পড়তে। সকালেই ক্লাশ আছে। ঠিক করে না ঘুমালে মন দিয়ে লেকচার শুনতে পারবে না। তিতলির পড়াশোনার ব্যাপারে খুবই সজাগ দৃষ্টি তার। তার জন্যে যাতে তিতলির পড়া নষ্ট না হয় সেদিকে খুব খেয়াল রাখে সায়ান। কথা শেষ করে শুতে যাচ্ছে, মশারি গুঁজছে এমন সময় মোবাইলটা আবার নড়ে ওঠলো, সায়ান আবার। কৃত্রিম রাগ গলায় এনে তিতলি আদুরে গলায় জিজ্ঞেস করলো, আবার কি? নরম গলায় হাসতে হাসতে সায়ান বললো, ম্যাসেঞ্জারে কথা বলে কি মন ভরে? আজ তিন দিন হলো তোর গলা শুনি না জান। তোর গলা না শুনতে পেলে আমার কি রকম অস্থির লাগতে থাকে জানিস না তুই? এখন আমার সুন্দর ঘুম হবে, মিষ্টি একটা স্বপ্ন দেখবো তোকে নিয়ে। তিতলির গলা আবার ভরে এলো অভিমান, গতো দুদিন কি সেটা তোর মনে ছিলো না? সায়ানের মতো অতো সুন্দর করে গুছিয়ে না বলতে পারলেও তিতলিরতো তাই হয়, সেটা কি সে বুঝতে পারে না? ভালোবাসা আর অভিমানের দোলাচলে এক মিষ্টি মিশ্র অনুভূতি নিয়ে ঘুমাতে গেলো তিতলি।
বাংলাদেশ সময়: ১৬০০ ঘণ্টা, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১২
সম্পাদনা: এম জে ফেরদৌস