ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

দূরে বসে বৈশাখের অনুভূতিমালা

ফারজানা খান গোধূলি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৫৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৩, ২০১২
দূরে বসে বৈশাখের অনুভূতিমালা

হোয়াই ইয়োর মম ডাজ ওয়্যার এ ডট ওন হার ফরহেড?
দ্যাট শি কামস টু স্কুল টু পিক মি আপ, আই ক্যান ইজিলি স্পট অন হার।

এই বাস্তব জোকটাই এখন একটি ট্রাভেল এজেন্সির জনপ্রিয় টেলিভিশন বিজ্ঞাপন।

আমেরিকাতে বসবাসকারী সাউথ এশিয়ানদের কাছে এটি বেশ পছন্দের। এখানে জন্ম ও বেড়ে ওঠা বাচ্চারা জানে না তাদের পিতামাতার জন্মভুমি, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, সাজ-পোশাক ও খাদ্যাভ্যাস। বাচ্চাদের সাথে বড়রাও ভুলে যাবার আগে দেশ যান নিজেদের সংস্কৃতি ও সাজ-পোশাক পরিচিত করান বাচ্চাদের-- দুই বাক্যের এই বিজ্ঞাপন তুলে ধরেছে আপন ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও সাজ-পোশাক সঠিকভোবে জানানো শেখানো কতটা প্রয়োজন। বৈশাখের মূলমন্ত্র নতুন কে স্বাগতম। অন্যায়, মন্দ, অশুভ ও খারাপকে পেছনে ফেলে, সামনে এগিয়ে যাবার আহ্বান।

আমাদের দেশের প্রধানরা অবশ্য ভাল ও নতুনকে স্বাগত জানিয়ে সামনে এগিয়ে যাবার বদলে পিছিয়ে যাচ্ছেন, অতীত নিয়ে বসে আছেন। পরচর্চা, পরনিন্দা, স্বজনপ্রীতিতে ব্যস্ত। যারা হতে পারেন আমাদের জাতির সংস্কৃতি ধারক ও বাহক, উনারাই ব্যস্ত কাদা ছোড়াছুড়ি নিয়ে। একে অন্যের প্রতি কটূক্তি ও গালাগালি করে সময় পার করছেন। নতুন বছর কে স্বাগত জানাতে আনন্দিত হৃদয়, প্রচন্ড গরমে লোডশেডিংয়ে ত্রাহি ত্রাহি প্রাণ। ঘামে জবজব শরীর নিয়ে ঘরে ফিরে পানির জন্য আইঢাই জান। তবুও বৈশাখের আগমনে ভালো কিছুর প্রত্যাশা করে মন। নতুন কিছুর অপেক্ষায় থেকে বলি, ‘‘এসো, হে বৈশাখ এসো এসো। ’’
একথা পুরো নিশ্চিত না হয়েও বলা যায় যে, আমাদের অনেকেই জানেন না বৈশাখের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও আমাদের জীবনে এর আবেদনই বা কত।

আমি ইতিহাসবেত্তা নয় কিন্তু হাজার বছরের বাঙ্গালী সংস্কৃতি, ... বাংলাদেশ ভ্যান সেন্দেল, বাঙ্গালীর ইতিহাস আদিপর্ব, বাংলা ও বাঙ্গালীর ইতিহাস, ভারতবর্ষের ইতিহাস, বঙ্গ বৃত্তান্ত, বঙ্গের স্থাপত্যরীতি, তৎকালীন মুসলিম সমাজ, উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ ও বং থেকে বঙ্গাব্দ পড়ার সাথে সাথে আমার মা-বাবা , শিক্ষক ও মুরব্বীদের কাছ থেকে বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও সাজ-পোশাক ও খাদ্য সম্পর্কে জানার ভিত্তিতে কিছু লেখা ও বলা যায় বইকি।

বাঙালি সংস্কৃতি ৫ হাজার বছরের পুরনো না কি এক হাজার বছর আগেও বাঙালি জাতির অস্তিত্ব ছিলো কিনা আবার কোনো কোনো বিশেষজ্ঞের মতে, বাঙালি সংস্কৃতি অতো পুরনো নয়। ইতিহাসবিদদের মধ্যে মতবিভক্তি আছে। অনেক গবেষণায় হয়েছে এ বিষয়ে । আমি আমাদের বাঙালি সংস্কৃতি কত বছরের পুরানো তা নিয়ে লিখছি না; সেটা নিয়ে ইতিহাসবিদরাই লিখুন।
আমরা বাঙালি। আমাদের নিজস্ব ঐতিহ্য আছে। আমরা আমাদের বুকে ধারণ করি সেই ঐতিহ্য। ধারণ করি বাংলা নববর্ষ পহেলা বৈশাখকে। পহেলা বৈশাখ শুধু হাসি-আনন্দ, বাঁধভাঙা উল্লাসের দিন নয়, এ দিনটির মর্মার্থ বুঝতে হবে। এ দিনটি আমাদের সত্তার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের হাতে আমাদের লোকজ ঐতিহ্য তুলে দিতে হবে। এ ধরনের কথা সব সময় আমরা শুনে আসছি। আবার এমন কথাও শুনেছি: আমাদের সময় এই ছিলো, আমাদের সময় ওই ছিলো। আমাদের ছোটবেলায় এই করেছি, সেই করেছি। এখনকার ছেলেমেয়েরা জানে না সেসব বা দেখেনি সেসব।

কিংবা: আমরা ছোটবেলায় এই করতাম, ঐ করতাম। এখনকার ছেলেমেয়েরা বড়দের সম্মান করে না, সালাম দেয় না। ভদ্রতা জানে না। বা আমরা এই করেছি সেই করেছি, তোমরা কি করো?--- এমন হাজারো কথা শুনতে হয়। একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, যুগের পর যুগ, প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই সব শুনে আসছে। তার মানে সময়ের সাথে সব কিছুর পরিবর্তন হচ্ছে। আগে বিদেশ থেকে চিঠি আসতে সময় লাগতো প্রায় এক মাস, আর আজ সেকেন্ডে সেকেন্ডে, মিনিটে মিনিটে পৌছে যাছে ইমেল। মন চাইলেই দেখা যায় হাজার হাজার মাইল দূরে থাকা মানুষটিকে। মোবাইল ফোনের কল্যাণে চাইলেই যেকোন স্থান থেকে যে কোন সময় কথা বলা যায়। সময়ের সাথে, চাহিদার প্রয়োজনে, বদলে যাচ্ছে সব কিছু। সেই সাথে যোগবিয়োগ ঘটছে সংস্কৃতিতেও।

মায়ের মুখে শুনেছি ছোটবেলায় উনারা ভাইফোঁটা দিতেন; সেইদিন বাড়িতে উৎসব হতো এবং বিবাহিত হিন্দু নারীর পাশাপাশি মুসলিম বিবাহিত মহিলারাও সিঁদুর পরতেন। কারণ সিঁদুর না থাকলে অবিবাহিত মনে করে দুষ্ট পুরুষরা মেয়েদেরকে উত্যক্ত করতো। বলা বাহুল্য, সেযুগেও বখাটেরা উত্ত্যক্ত করত। যদিও তা আজকের জামানার ইভটিচিংয়ের তুলনায় নেহাতই দুদ-ভাত। আমি চমকিত হলাম জেনে যে, আমার মায়েদের শৈশবে ভাইফোঁটা ছিল। ছিল সিঁদুর, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে। কিন্ত আমি আমার ছোটবেলা থেকে দেখে ও জেনে আসছি ভাইফোঁটা বা সিঁদুর হিন্দুধর্ম পালনকারীদের জন্য। ইদানি পহেলা বৈশাখ পালনকেও হিন্দুয়ানি বলে চালানোর অপচেষ্টা চলছে। পহেলা বৈশাখ না হিন্দু না মুসলিম না খ্রিস্টান না বৌদ্ধদের, পহেলা বৈশাখ বাঙালিদের। সর্বস্তরের বাঙালির উৎসব।

উল্লেখ্য, সাতচল্লিশে দেশভাগের পর থেকে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী ভিন্ন সংস্কৃতি আর ভিন্ন ভাষা নিয়ে এদেশের মানুষের ওপর কিরূপ আগ্রাসন চালিয়েছে; অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক উভয় আগ্রাসন। বাঙালি জাতির ঐতিহ্য সংস্কৃতিকে নির্মূল করার ষড়যন্ত্র চলতে থাকে সর্বত্র। কিন্তু বাঙালির মেধা-মনন-চিন্তাশক্তি এবং সর্বোপরি মনোবলের কাছে হেরে যায় সেসব বিধ্বংসী চক্রান্ত।
বাঙালি জাতির স্বকীয়তাবোধ এতো প্রবল ছিল যে, পাকিস্তানি সামরিক আমলাতন্ত্রের হাজারো বাধা বিপত্তি অত্যাচার-নির্যাতন উপেক্ষা করে তারা নববর্ষ উদযাপন করেছে। এদেশের শত্রুরা এ উৎসব বন্ধ করে দিতে বহু চেষ্টা করেছে। সেসব কথা বিস্মৃত হওয়ার নয়। সম্মিলিত আন্দোলনে পহেলা বৈশাখ সরকারি ছুটির দিন হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ১৯৬৭ সালে ঢাকায় রমনা বটমূলে বর্ষবরণ উৎসবের শুরু হয়। সেই উৎসব উদ্দীপনা পরিমাপ করার ভাষা কারো জানা নেই। এখনকার মতো হাজার হাজার লোকের সমাবেশ সেদিন হতো না, কিন্তু বাঙালির মনে যে আবেগ কাজ করতো তা হলো অধিকারবোধ। সংস্কৃতির ওপর ক্রমাগত হামলায় বাঙালির প্রতিটি উৎসব হয়ে উঠেছিল প্রতিবাদমুখর। এদেশের শত্রুদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার জন্য, প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য এ উৎসব প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর করে তোলা হয়। এ উৎসব বাঙালি জাতির স্বাধিকার আন্দোলনকে আরো বেগবান করে তোলে। বাঙালি একাত্ম হয়ে এবং ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আপন সত্তা নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য বাঙালি জাতীয়তাবোধ, সংস্কৃতি ও কৃষ্টির পক্ষে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। বাঙালির এ জয়লাভে তারা ভীত হয়ে পড়ে এবং অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় এবং পহেলা বৈশাখের সরকারি ছুটির ওপরও এ সময় আঘাত আসে। সমগ্র বাঙালি এর সমুচিত জবাব দেয় মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং সেই সঙ্গে স্বাধীন বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখ উদযাপনও কণ্টকমুক্ত হয় এবং পাকাপোক্ত স্থান করে নেয়। আর তাই বাঙালির জাতীয় জীবনে পহেলা বৈশাখ উদযাপন বাঙালির সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।

সংস্কৃতি জীবনবিচ্ছিন্ন কোনো বিষয় নয়। এ জীবন জনমানুষের জীবন। সংস্কৃতির এ মানুষ শ্রমনির্ভর, এ মানুষ উৎপাদন এবং সর্বোপরি মাটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এদের শ্রমের ফলে যে উৎপাদন, সে উৎপাদন থেকে গড়ে ওঠে সমাজের ভিত্তি। তাই সংস্কৃতির শেকড় জনমানুষের অন্তরে প্রোথিত। স্বাধীনতার পর নবউদ্যমে নববর্ষ উদযাপন করা হয়। ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে দিয়ে শুভ সূচনা করা হয়। কিন্তু স্বাধীনতার বিরুদ্ধ-শক্তিরা হাত গুটিয়ে বসে থাকেনি। সুযোগের অপেক্ষায় ছিল কখন থাবা বিস্তার করা যায়। ১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে দেশকে আবার পাকিস্তানি ধারায় ফিরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করা হয়। সংস্কৃতির মাঝে সুকৌশলে অপসংস্কৃতির বিষ ঢুকিয়ে দেয়া হয়। সুস্থ সংস্কৃতিচর্চাকে তারা ব্যাহত করে প্রতি পদক্ষেপে।

আবারো ফিরে আসি পহেলা বৈশাখে, বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস বৈশাখের ১ তারিখ, বাংলা সালের প্রথম দিন, যা হল বাংলা নববর্ষ, দিনটি বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে নববর্ষ হিসেবে বিশেষ উৎসবের সাথে উদযাপিত হয়। ত্রিপুরায় বসবাসরত বাঙালিরাও এই উৎসবে অংশ নেয়। যার ফলে এটি বাঙালিদের সর্বজনীন উৎসব। বিশ্বের সকল প্রান্তের সকল বাঙালি এদিনে নতুন বছরকে বরণ করে নেয়। ইদানীং ঘটা করে বাংলা বর্ষবরণ করা হয় তা অতীতে ছিলো খুবই ছোট আকারে, এ ক্ষেত্রে ইতিহাস বলে, মোঘল সম্রাট আকবরের সময়কাল থেকেই পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন শুরু হয়। সে সময় প্রত্যেককে চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সকল খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে হত। এর পরদিন অর্থাৎ বৈশাখ মাসের ১ তারিখে ভূমিমালিকরা নিজ নিজ অঞ্চলবাসিদের মিস্টিমুখ করাতেন । এ উপলক্ষে বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করা হত। এই উৎসবটি পরে একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয় । যার রুপ বিবর্তিত হতে হতে বর্তমানে এই পর্যায়ে এসেছে। সে সময় একটি হালখাতা তৈরী করা ছিল প্রধান কাজ। হালখাতা বলতে একটি নতুন হিসাব বই বোঝানো হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে হালখাতা হলো বাংলা সনের প্রথম দিনে দোকানপাঠের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া। গ্রাম, শহর বা বাণিজ্যিক এলাকা, সকল স্থানেই পুরনো বছরের হিসাববই বন্ধ করে নতুন হিসাববই খোলা হয়। হালখাতার দিনে দোকনদাররা তাদের ক্রেতাদের মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করেন। এই প্রথাটি এখনও বেশ কিছু ব্যবসায়ী মহলে প্রচলিত আছে, বিশেষত স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের মাঝে।

গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে ১৪ই এপ্রিল অথবা ১৫ই এপ্রিল পহেলা বৈশাখ পালিত হয়। আধুনিক বা প্রাচীন যে কোন বর্ষপঞ্জিতে এই বিষয়ে মিল রয়েছে। বাংলাদেশে প্রতি বছর ১৪ই এপ্রিল এই উৎসব পালিত হয়। বাংলা একাডেমীর নির্ধারিত বর্ষপঞ্জি অনুসারে এই দিনটিকেই নির্দিষ্ট করা হয়েছে। বাংলা বর্ষপঞ্জির সঙ্গে হিজরী ও খ্রিস্টীয় সালের মৌলিক পার্থক্য হলো, হিজরী সন চাঁদের হিসাবে এবং খ্রিস্টীয় সাল ঘড়ির হিসাবে চলে। এ কারণে হিজরী সালের নতুন তারিখ শুরু হয় সন্ধ্যায় নতুন চাঁদের আগমনে। ইংরেজি-দিন শুরু হয় মধ্যরাতে, আর বাংলা সালের দিন শুরু হয় ভোরে, সূর্যোদয়ে। কাজেই সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় বাঙালির পহেলা বৈশাখের উৎসব।

পহেলা বৈশাখ উদযাপন বাঙালির একদিনের ঐতিহ্য নয়। বাঙালির কৃষ্টির সঙ্গে সংস্কৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে আছে এ দিনটি। এটি কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়। ধর্ম ভেদ থাকা সত্ত্বেও প্রত্যেক বাঙালি এ দিনটি আড়ম্বরের সঙ্গে উদযাপন করে। বাঙালির নববর্ষ বহুমাত্রিকতায় পরিপূর্ণ। বাংলাদেশের অনেক অঞ্চল এই বৈশাখের প্রথম দিনে নানা রকমের আয়োজন করে থাকে। বাঙালির ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে মেলা বসে। সে মেলায় আসে লোকজ বাংলার নানা রকমের জিনিসপত্র। খাওয়া হয় ইলিশ মাছের সঙ্গে পান্তাভাত। বসে বাউল গানের আসর। জারি, সারি, পুঁথিপাঠ ইত্যাদির আয়োজন করা হয়। দেশের কোথাও কোথাও এ বৈশাখী মেলা চলে মাসব্যাপী।

আমাদের প্রকৃতি ও সমাজ, অর্থনৈতিক কর্মকান্ড আমাদের জীবনাচার সবকিছুর সঙ্গেই নববর্ষের যোগ রয়েছে। নববর্ষ মানুষের মাঝে গড়ে তোলে মেলবন্ধন। আজকের এই কম্পিউটার, ইন্টারনেট, ই-মেইলের যুগেও আমাদের ব্যবসায়ী সম্প্রদায় পহেলা বৈশাখে সাড়ম্বরে শুভ হালখাতা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। পুরনো বছরের লেনদেন চুকিয়ে তারা নতুন করে নতুন বছরকে স্বাগত জানান। হালখাতা পহেলা বৈশাখের মুখ্য বৈশিষ্ট্য হলেও বাংলাদেশে নববর্ষে নতুন পোশাক পরা, কিছুটা ভালো খাওয়া-দাওয়া, অতিথি আপ্যায়ন, আত্মীয় ও বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে শুভকামনা বিনিময় করতে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়ানো, খেলাধুলা ও ষাঁড়ের লড়াই, পায়রা ও ঘুড়ি ওড়ানো, নদীতে নৌকাবাইচ এবং মেলা থেকে শখের নানা সামগ্রী ও মিষ্টান্ন সংগ্রহ এবং অবশ্যই নাগরদোলায় চাপা দিনের কর্মসূচির অংশ। ঐতিহ্যিক এসবের সঙ্গে আমাদের রমনার বটমূলে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুশিল্পীদের ব্যতিক্রমধর্মী ‘মঙ্গল মিছিল’ দিয়ে বর্ষবরণ করাটা আমাদের বর্ষবরণের মূল আকর্ষণে পরিণত হয়েছে। নগরজীবনে নগরসংস্কৃতির আদলে অত্যন্ত জাঁকজমকের সঙ্গে নববর্ষ উদযাপিত হয়। নববর্ষকে স্বাগত জানাতে তরুণীরা লালপেড়ে সাদা শাড়ি, হাতে চুড়ি, খোঁপায় ফুল, গলায় ফুলের মালা এবং কপালে টিপ পরে আর ছেলেরা পরে পাজামা-পাঞ্জাবি। এ দিন সকালবেলা মাটির সানকিতে ইলিশ মাছ দিয়ে পান্তা ভাত খাওয়ার ধুম পড়ে যায় পিঠা-পায়েসের দোকানগুলো জমজমাট হয়ে ওঠে। রাজধানীর টিএসসির আশপাশে বসে বিরাট মেলা। নববর্ষের শুরুতে শহরে পান্তাভাত দিয়ে এখন শুরু হলেও গ্রামে (নানির কাছে শোনা) নানারকম ভেষজ রস মিলিয়ে তেতো এরকম তরল পান করার মধ্য দিয়ে দিনটি শুরু হতো। যা অধিক স্বাস্থ্যকর। পান্তা ভাত খাওয়ার মাঝে ঐতিহ্য রক্ষার যে চেষ্টা তাতে আমাদের খেটে খাওয়া মানুষদের স্মরণ করার চেষ্টা বলে মনে হয়। নববর্ষ উদযাপনের ইতিহাস সুপ্রাচীন। প্রাচীন উৎসবের মধ্যে পুণ্যাহ, হা-ডু-ডু, বলীখেলা, হালখাতা খোলা ইত্যাদি যুক্ত হয়ে আছে। এগুলো সবই আমাদের লোকজ ঐতিহ্য। হাজার বছর ধরে গ্রাম-বাংলার মানুষ এ ঐতিহ্য ধারণ করে আছে মনে-প্রাণে। নববর্ষ পালন করে নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ সবাই।

গ্রামে এ দিনটির শুভ সূচনা হয় নারীর কল্যাণমাখা হাতে আঁকা আল্পনায়; ঘরের দরোজায় আমপাতা যুক্ত মঙ্গলঘট, পরিচ্ছন্ন নিকানো ঘরদোরের মধ্য দিয়ে। চিড়ে, দই, গুড়, ফল দিয়ে সকালের নাস্তা । দুপুরে সুক্তো, নানা প্রকার শাক, সজনে ডাঁটা, কাঁচা আম দিয়ে রান্না করা ডাল দিয়ে ভাত খেয়ে, নতুন কাপড় পরে বাবার হাত ধরে ছেলেমেয়েদের মেলা দেখতে যাওয়া। চড়কদোলায় চড়া, লোকগান শোনা, মাটির পুতুল, কাঠের গাড়ি কিনে, মুড়ি, মুড়কি, বিন্নি ধানের খই রঙিন গামছায় বেঁধে ভেঁপু বাজাতে বাজাতে সন্ধ্যায় ঘরে ফেরা। এ আমাদের পহেলা বৈশাখের ঐতিহ্য। এই আনন্দ এই অনুভূতির সঙ্গে একাত্ম হওয়ার জন্য শহরেও পহেলা বৈশাখ উদযাপন করা হয় কিছুটা গ্রামীণ আদলে। এভাবেই লোকজ বর্ষবরণ-প্রথাগুলোকে অনুসরণের মাধ্যমে নগরজীবনে গ্রামীণ ঐতিহ্য অনেকটা সংরক্ষিত হচ্ছে।

আবার ফিরে আসি শুরুতে, প্রবাসী বাঙ্গালিরা আজ অনেক মহাসমারোহে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান করেন, যা অনেক আনন্দের কথা। কিন্তু উনারা কি সন্তানদের নিজ জন্মভুমি্র, ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি-সাজ-পোশাক ও খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে জানান, নাকি শুধু সেজেগুজে, ইলিশ পান্তা খেয়ে একটা দিন পার করে দেন? তাদের সন্তানরা জানে না পহেলা বৈশাখের ঐতিহ্য। যেমন জানে না আমাদের দেশীয় ইংরেজি স্কুলে পড়ুয়া ছেলেমেয়ারা। যাদের কাছে পহেলা বৈশাখ শুধু ‘ফান’ করার দিন, পাল্লা দিয়ে দামি বুটিক শপ থেকে পোশাক কিনে, পিজ্জা, পাস্তা বা সারমা খেয়ে হৈ হৈ করা। বাবা-মা খবর রাখেন না। ইংরেজি স্কুলে পড়ছে সন্তান, বাংলা ঠিক মতো বলতে পারে না। তারা অবাঙ্গালি-উচ্চারণে বাংলা বলে, যা বাবা-মায়ের মুখ ‘উজ্জ্বল’ করে সোসাইটিতে। আর এদের মধ্য দিয়েই আমাদের সংস্কৃতিতে সুকৌশলে অপসংস্কৃতির বিষ ঢুকিয়ে দেয়া হয়। সুস্থ সংস্কৃতিচর্চাকে তারা ব্যাহত করে প্রতি পদক্ষেপে।

Fajzana-khan-godhulyফারজানা খান গোধূলি
ওয়াশিংটনপ্রবাসী সাংবাদিক।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।