ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

মুক্তমত

শ্রীলঙ্কায় আবার জাতিগত সংঘাতের পদধ্বনি?

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৩০ ঘণ্টা, মার্চ ৬, ২০১৮
শ্রীলঙ্কায় আবার জাতিগত সংঘাতের পদধ্বনি? শ্রীলঙ্কার কান্দিতে উগ্রপন্থি বৌদ্ধদের সহিংসতা। ছবি- সংগৃহীত

শ্রীলঙ্কাকে বলা হয় ‘পার্ল অব দি ইন্ডিয়ান ওশান’। মহাসাগরীয় অথৈই নীল জলরাশির মাঝখানে উজ্জ্বল মুক্তার মতো জেগে আছে দেশটি। ২০০৯ সালে সিংহলি বনাম তামিল জাতিগোষ্ঠীর মধ্যকার ২৬ বছর স্থায়ী গৃহযুদ্ধের অবসানের পর ৮/১০ বছর শান্তিতে থেকে দেশটি আবার অশান্তির আগুনে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে।

সংখ্যাগুরু বৌদ্ধ ও সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যকার উত্তেজনায় সেখানে ১০দিনের জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। সেখানে আবার জাতিগত সংঘাতের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে।

ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শক্তি শ্রীলঙ্কাকে স্বাধীনতা দিয়ে চলে যাওয়ার সময় দেশটির নাম দিয়েছিল ‘স্থিতিশীলতার মরূদ্যান’। কথাটি যে মোটেও সত্য ছিল না এবং অতিকথন ছিল, তা অচিরেই প্রমাণিত হয়েছে সিংহলি-তামিল সংঘাতের সময়। সেই অস্থিরতা থামলেও সেখানে এখন অস্থিতিশীলতার প্রধান কারণ হয়ে জাতিগত বৈরিতা কাজ করছে। যার সর্বশেষ প্রকাশ ঘটেছে অতি ক্ষুদ্র মুসলিম জাতিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রবল সংখ্যাধিক্যের সিংহলি বৌদ্ধদের মারমুখী অবস্থান।

শ্রীলঙ্কার জনগণনায় বৌদ্ধ প্রাধান্য প্রশ্নাতীতভাবে নিরঙ্কুশ। ১৯৮১ সালে দেশটির মোট জনসংখ্যার ৬৯.২৯ শতাংশ ছিল বৌদ্ধ। তিন যুগ পর ২০১২ সালে সেখানে বৌদ্ধ প্রাধান্য বেড়ে হয়েছে মোট জনসংখ্যার ৭০.১৯ শতাংশ, যা দেশটির আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নিরঙ্কুশ বৌদ্ধ প্রাধান্য ও প্রভাবের স্পষ্ট প্রমাণ বহন করে।

উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, শ্রীলঙ্কার বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ জাতিতে সিংহলি, যাদের সাথে বছরের পর বছর লড়াই হয়েছিল তামিল সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের। দেশটির জনমিতিতে অপরাপর জনগোষ্ঠী-ধর্মগোষ্ঠীর সংখ্যাগত চিত্রটিও সিংহলি জাতি এবং বৌদ্ধ প্রাধান্যকে পরিষ্কারভাবে প্রতিফলিত করে। ১৯৮১ সালে দেশটির জনসংখ্যার ১৫.৪৭ শতাংশ ছিল হিন্দু, ৭.৫৫ শতাংশ ছিল মুসলমান এবং ৭.৬১ শতাংশ ছিল যৌথভাবে ক্যাথলিক ও অন্যান্য খ্রিষ্টান গ্রুপ।

২০১২ সালে শ্রীলঙ্কায় হিন্দু জনসংখ্যা ১২.৫৮ শতাংশ, মুসলমান ৯.৬৬ শতাংশ এবং ক্যাথলিক ও অন্যান্য খ্রিষ্টান গ্রুপ ৭.৬২ শতাংশ। ১৯৮১ সালে অ-বৌদ্ধ ধর্মীয় জনসংখ্যা যেখানে ছিল ৩০.৬৩, একত্রিশ বছর পর ২০১২ সালে সেটি কমে হয়েছে ২৯.৮৬ শতাংশ। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ক্রমহ্রাসমানতার ফলে জাতিগত বা ধর্মগত গোষ্ঠীর দিক থেকে শ্রীলঙ্কার সংখ্যাগুরু বৌদ্ধ ধর্মানুসারী সিংহলি জাতির সামনে কোনও বিপদ বা প্রতিপক্ষ থাকার কথা নয়। তথাপি দেশটিতে মুসলমান সংখ্যালঘুরা আক্রান্ত হচ্ছে কেন?

মুসলমানদের মতো এতো ছোট ও প্রান্তিক ধর্মীয় গোষ্ঠীকে শ্রীলঙ্কার প্রবল বৌদ্ধ-প্রাধান্যে কি কারণে আক্রমনের মুখোমুখি হতে হয়েছে, সেটি গভীরভাবে খুঁজে দেখার দরকার আছে। বিশেষত, বিশ্বের অন্যান্য স্থানের ‘জেহাদি’ বা ‘বিপ্লবী’ মুসলিম ইমেজের বিপরীতে শ্রীলঙ্কার মুসলিমরা নিরিহ, ব্যবসাজীবী ও কোণঠাসা। ‘বিপজ্জনক’ বা ‘রাজনৈতিক’ তৎপরতার সঙ্গে তাদের কোনও সংশ্রবই নেই। হিন্দু-তামিলরা যেমন জাতিগত স্বায়ত্তশাসন চেয়ে লড়াই করেছিল, মুসলমানদের তেমন কোনও এজেন্ডা নেই, লড়াই করার প্রশ্নও তাদের দিক থেকে একেবারেই অবান্তর। তারপরেও শ্রীলঙ্কায় বৌদ্ধ-মুসলিম উত্তেজনা বিরাট উদ্বেগের কারণ। তামিল সঙ্কটের পর শ্রীলঙ্কায় আবার নতুন করে জাতিগত সংঘাতের ইঙ্গিত দেখা যাওয়া দক্ষিণ এশিয়ার শান্তির জন্যও এক অশনি সংকেত।

পরিসংখ্যান ও বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে যে, তামিল সঙ্কটের সময় শ্রীলঙ্কান সেনাবাহিনী ও তামিল গেরিলাদের মধ্যকার যুদ্ধ ও সংঘাতে সিংহলি ও তামিল বেসামরিক নাগরিকদের পাশাপাশি অকাতরে মারা গেছে মুসলিম নাগরিকরাও। যদিও মুসলিমরা সংঘাতের কোনও পক্ষ ছিলেন না এবং কোনও গ্রুপকে সমর্থন বা বিরোধিতা করেননি, তথাপি দীর্ঘস্থায়ী সেই গৃহযুদ্ধে তাদেরকেও প্রাণ দিতে হয়েছে। হারাতে হয়েছে ঘর-বাড়ি-সম্পদ। অথচ যুদ্ধাপরাধের যে অভিযোগ তামিলরা সিংহলি এবং সিংহলিরা তামিলদের বিরুদ্ধে উত্থাপন করে, সেখানে মুসলিম জনগোষ্ঠীর ক্ষতি ও ক্ষতের ব্যাপারটি কেউই উপস্থাপন করেনি।      

অথচ শ্রীলঙ্কায় প্রধান চারটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে বেশি অবহেলিত ও পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠী হলো মুসলমানরা। তাদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যগত চিত্র শোচনীয়। নিজেদের অধিকার ও দাবি উত্থাপনের জন্য তারা তামিল বা অন্যদের মধ্যে রাজনৈতিকভাবে সংগঠিতও নয়। শ্রীলঙ্কার সর্বত্র বৌদ্ধ-সিংহলি প্রাধ্যান্যের পরেও উত্তরের জাফনা ও মান্নার জেলাগুলো তামিল প্রাধান্য নিশ্চিত করেছে। তবে পূর্বাঞ্চলীয় একটি মাত্র জেলা আমপাইয়ে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ।

অতীতে তামিলরা উত্তর ও পূর্বাঞ্চলীয় শ্রীলঙ্কায় আলাদা হোমল্যান্ড বানাতে চেয়েছিল। সে দাবি ব্যর্থ হলেও পূর্বাঞ্চলের জনসংখ্যায় মুসলিম প্রাধান্য বৃদ্ধির ধারা লক্ষ্য করা গেছে। তামিলদের মতো মুসলিমরাও যদি সেখানে হোমল্যান্ড দাবি করে, তাহলে সেটাও হবে সিংহলিদের দুশ্চিন্তার কারণ। সিংহলিরা মোটেও সহ্য করে না যে, মিয়ানমারে নিপীড়িত রোহিঙ্গা মুসলিমরা শ্রীলঙ্কার মুসলিমদের কাছে আশ্রয় বা সাহায্য পাক। বরং সোশাল মিডিয়া ও সামাজিক বিন্যাসে একটি মুসলিমবিরোধী স্রোত চলছেই, যার বহিঃপ্রকাশ সাম্প্রতিক উত্তেজনা, সহিংসতা ও জরুরি অবস্থা ঘোষণার মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে।

দীর্ঘদিনের জাতিগত সংঘাতে ক্ষত-বিক্ষত ও রক্তাক্ত হওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে শ্রীলঙ্কা যে সামাজিক-জাতিগত সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি স্থাপনের পথে বিশেষ কিছু অর্জন করেছে, সেটা বলা যায় না। সাংবিধানিক-রাজনৈতিক কাঠামোয় জাতি ও ধর্মগত সংখ্যালঘুদের অধিকার ও স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নটিও সামরিক শক্তি আর জাতিগত প্রাধান্যের মাধ্যমেই মোকাবেলা করতে চাচ্ছে শ্রীলঙ্কা। ফলে থেমে থেমে সেখানে জাতিগত বৈরিতা ছড়িয়ে পড়ছে এবং সংখ্যালঘু নির্যাতনের নানা ঘটনা সামনে চলে আসছে। সর্বশেষ বৌদ্ধ-মুসলিম উত্তেজনা যার প্রমাণ।

শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে জাতিগত বৈরিতার অবসান ঘটাতে না পারলে আবারও দেশটিতে সংঘাতময় পরিস্থিতির উদ্ভব হওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তামিল সঙ্কট ও সংঘাত দেশটিকে শুধু রক্তাক্ত ও যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করেনি, আর্থ-সামাজিক দিক থেকেও পিছিয়ে দিয়েছিল। সেই ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার পথে আবার আরেকটি সংঘাত শ্রীলঙ্কার জন্য মোটেও শুভ ফল বয়ে আনবে না।

শ্রীলংকায় বৌদ্ধ-মুসলিম উত্তেজনা, ১০ দিনের জরুরি অবস্থা
বাংলাদেশ সময়: ২১১৯ ঘণ্টা, মার্চ ০৬, ২০১৮
এমপি/জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।