বায়োগ্যাসের সুবিধারও যেন শেষ নেই। এতে চুলা জ্বলে।
বাগেরহাট জেলার নয় উপজেলায় ৩শ ২৭টি বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট আছে। বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট হওয়ার কারণে পশুর খামার থেকে দূষণের হার কমেছে। জৈব সারের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। এ দিয়ে উৎপাদিত হচ্ছে বিষমুক্ত সবজি ও নানা ধরনের অর্থকরী ফসল। বায়োগ্যাসে রান্নার কারণে কমছে মা ও শিশুদের ধোঁয়াজনিত নানা রোগ ও শ্বাসকষ্ট।
ব্যায়োগ্যাস প্ল্যান্টের একমাত্র কাঁচামাল হচ্ছে পচনশীল বর্জ্য। বাগেরহাটের প্ল্যান্টগুলোতে ব্যবহৃত হয় পশুর বর্জ্য (গোবর)।
যেভাবে তৈরি হয় বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট:
খামারের পাশে বা সুবিধামত স্থানে মাটির নিচে একটি ট্যাংক স্থাপন করা হয়। ট্যাংকের পাশে উপরিভাগে থাকে একটি গোলাকার পাত্র। যে পাত্রে গোবর বা পচনশীল জিনিস (কাঁচামাল) ফেলা হয়। ঐ পাত্রের সাথে পাইপ দিয়ে ট্যাংকে সংযোগ দেয়া থাকে। এর পাশে থাকে আরেকটি হাউস বা চৌবাচ্চা। এটিও ট্যাংকের সাথে সংযুক্ত থাকে। ট্যাংকে জমে গ্যাস আর অন্য হাউসে জমা হয় বায়োগ্যাসের স্যালারি।
বাগেরহাটের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায় বায়োগ্যাস প্ল্যান্টগুলো গরুর খামারকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। খামারের মালিকদের পরিবারের প্রয়োজনীয় সব রান্নাবান্না হয় এ বায়োগ্যাসেই। ঘেরের মাছের খাবার ও গরুর খাবার রান্নাও হয় এই গ্যাসেই। যেসব খামারির গরুর সংখ্যা বেশি তারা ভাড়ায় পাশের বাড়িতে বায়োগ্যাসের সংযোগও দিয়েছেন। এতে করে তাদের বাড়তি আয়ও হচ্ছে।
সদর উপজেলার কোন্ডলা আদর্শ খামারের মালিক শেখ মুশফিকুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, আমি গরুর খামার করার পরে বর্জ্য নিয়ে চিন্তিত ছিলাম। আমার মাথায় আসে বায়োগ্যাস প্ল্যান্টের চিন্তা। একসময় আমি এ প্ল্যান্ট তৈরি করি। আমার কর্মচারীদের খাবার রান্নার জ্বালানি হয় এ গ্যাস দিয়ে। তারপরও গ্যাস অবশিষ্ট থেকে যায়। তাই পাশের বাড়ির লোকদের একটি গ্যাসসংযোগ দিয়েছি। আর বায়োগ্যাসের স্যালারি (অবশিষ্ট বর্জ্য) শুকিয়ে চাষের জমিতে ব্যবহার করি।
ভাড়ায় বায়োগ্যাসের ক্রেতাদের একজন মোয়াজ্জেম হোসেন। বাংলানিউজকে তিনি বলেন, আমি গ্যাসসংযোগ নিয়ে একটি চুলা ব্যবহার করি। মাসে পাঁচশত টাকা ভাড়া দিই। কাঠের জ্বালানির থেকে অনেক কম খরচে আমার রান্নাবান্নার সব কাজ হয়ে যায়।
বাগেরহাট শহরের দর্জি ডেইরি ফার্মের মালিক কামরুল দর্জি বলেন, আমার খামারে ও তার আশেপাশে কোনো গন্ধ-দুর্গন্ধ নেই। খামারের গোবর আমি বায়োগ্যাস প্ল্যান্টে ব্যবহার করি। আমাদের রান্নার সকল কাজ এ গ্যাসে হয়ে যায়।
বায়োগ্যাসে প্ল্যান্ট স্থাপনে কারিগরি সহযোগিতা দিচ্ছে বেসরকারি সংস্থা ‘গ্রামীণ শক্তি’। বাগেরহাটের আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক মো: আসাদুজ্জামান বলেন, পরিবেশ রক্ষা ও দূষণমুক্ত জ্বালানি ব্যবস্থা নিশ্চত করতে আমরা বিনামূল্যে খামারিদের বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট তৈরিতে কারিগরি সহযোগিতা দিয়ে থাকি। এক্ষেত্রে সরকারি সংস্থা ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড(ইডকল) থেকে আমরা একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ পেয়ে থাকি।
বাগেরহাটের অতিরিক্ত জেলা প্রাণিসম্পাদ কর্মকর্তা ডা: লুৎফর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, পশুর খামারের একটি বড় সমস্যা হচ্ছে দুর্গন্ধ ও পরিবেশ দূষণ। খামারের বর্জ্য বায়োগ্যাসের প্ল্যান্টে ব্যবহার করায় আর পরিবেশ দূষিত হচ্ছে না।
কৃষিসম্প্রসারণ অধিদপ্তর, বাগেরহাট-এর উপ-পরিচালক মো: আফতাব উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, বাগেরহাটে বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট তৈরির প্রবণতা ও আগ্রহ দিনদিন বাড়ছে। এটা কৃষিজমি ও ফসলের জন্যও উপকার বয়ে আনছে। কৃষিজমিতে বায়োগ্যাসের স্যালারি (উদ্বৃত্ত বর্জ্য) সার হিসেবে ব্যবহারের সুবাদে রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমেছে। যারা এ সার ব্যবহার করছেন তাদের জমির ফলনও বেড়েছে।
সিভিল সার্জন ডা. অরুণচন্দ্র মণ্ডল বাংলানিউজকে বলেন, রান্নার জ্বালানি হিসেবে বায়োগ্যাস ব্যবহারের ফলে মা ও শিশুরা অনেক রোগ থেকে মুক্ত থাকছেন। বায়োগ্যাসের ব্যবহার বৃদ্ধি পেলে মা ও শিশুদের মৃত্যুহারও কমবে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও গ্রামীণ পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. মোঃ রেজাউল করিম বাংলানিউজকে বলেন,বায়োগ্যাস ব্যবহারের ফলে জ্বালানি হিসেবে আর কাঠ-বাঁশ পোড়াতে হয় না। এতে করে পরিবেশ নিরাপদ থাকে। পশুর বর্জ্যের সঠিক ব্যবহার হয়। সরকারি উদ্যোগে ব্যাপকভাবে এবং বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট করতে পারলে আর্থিক ও পরিবেশগত দুই দিক থেকেই মানুষ লাভবান হবে। এছাড়াও কমিউনিটি বেজড বা এলাকাভিত্তিক বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট তৈরি করে পারিবারিক অবশিষ্ট্য বর্জ্য ব্যবহার করা যায়।
বাংলাদেশ সময়: ০৬৫২ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৩, ২০১৭
জেএম/