মেয়েটিও শিশু। এরপরও কান্না থামানোর চেষ্টার কমতি নেই।
ঘুমধুম জিরো পয়েন্টে তখন প্রখর রোদ। গায়ে রোদ পড়ে রেদোয়ান নামে তিন বছর বয়সী শিশুর ফর্সা রঙ তখন চিকচিক করে উঠল যেন। এই নিষ্পাপ শিশুটির জীবনে ঈদের দিন সকালে মিয়ানমারের তুমব্রু সীমান্তবর্তী গ্রাম উত্তরপাড়া ডেকুবেনিয়ায় নেমে আসে এক ঘোর অন্ধকার।
যখন নতুন কাপড় পরে বাবার হাত ধরে ঈদে নামাজে যাওয়ার কথা ঠিক সেই সময় তার বাবাকে গুলি করে মিয়ানমারের খুনে সেনারা। মাকে ধর্ষণ করে পরে গুলি করে মেরে ফেলা হয়।
পরে প্রতিবেশীরা শিশুটি ও তার বাবা জোবায়েরকে আহত অবস্থায় নিয়ে পালিয়ে আসে। পথে অতিরিক্ত রক্তক্ষণের তার মৃত্যু হয়।
এখন সস্পর্কে দাদা-দাদি হয় এমন এক দম্পতির কাছে রয়েছে রেদোয়ান। গাছপালা কেটে উজাড় করা পাহাড়ের উপর ঘুমধুম সীমান্তবর্তী অস্থায়ী ক্যাম্পে হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীর সঙ্গে রেদোয়ানও রয়েছে।
মৃত্যু সম্পর্কে জ্ঞান-বোধ এখনও হয়নি রেদোয়ানের। 'বাবা-মা' শব্দটি শুনলে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে সবার দিকে। থেকে থেকে কান্না করে ‘মা মা’ বলে এই অবুঝ শিশুটি। তখন তাকে থামানো অনেক কষ্টকর হয়ে পরে।
শিশুটির সঙ্গে কথা বলার সময় সেখানে এসে জড়ো হয় তাঁবু টাঙিয়ে থাকা অন্য রোহিঙ্গারাও। সম্পর্কে চাচা শরিয়তুল্লাহ নামে এক রোহিঙ্গা যুবক বলেন, আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি(আরসার) সদস্য দাবি করে ঈদের সকালে রেদোয়ানের বাবাকে গুলি করা হয়। মাকে ধর্ষণ-নির্যাতন করে মেরে ফেলা হয়। আর আত্মীয় স্বজন যারা ছিল তাদেরও কুপিয়ে মারা হয়।
'আমরা তুমব্রু সীমান্ত দিয়ে ঘুমধুম ক্যাম্পে আসি। রেদোয়ানের বাবাকে আহত অবস্থায় নিয়ে আসি। পথে মারা গেলে ক্যাম্পে কবর দেওয়া হয়। যে দাদা-দাদির কাছে রয়েছে তারা আপন নয়, শিশুটি এখন এতিম। '
কেফায়েতুল্লাহ নামে আরেক রোহিঙ্গা যুবক এগিয়ে এসে জানান, তার কাছে রেদোয়ানের বাবার গুলিতে আহত অবস্থার ভিডিও রয়েছে।
ভিডিওতে দেখা যায়, আহত অবস্থায় পড়ে থাকা জোবায়েরকে সবাই ধরাধরি করে নিয়ে আসছেন। পেটে গুলি লেগেছে, সেখান থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে।
ঘুমধুম জিরো পয়েন্টের সবচেয়ে উঁচু পাহাড়ে শিশু রেদোয়ানের পালয়িতা দাদাদাদি আশ্রয় গেড়েছেন।
স্যানিটেশনের ব্যবস্থা না থাকায় ঘুমধুম অস্থায়ী ক্যাম্পে যত্রতত্র মলমূত্র পড়ে থাকতে দেখা গেলে। কাদা পানি মাড়িয়ে ষাটোর্ধ্ব দুই নরনারীর কাছে পৌঁছার পর জানা গেল তাদের দুই ছেলেকেও মেরে ফেলা হয়েছে। আর দুই মেয়ে স্বামী সহ পালিয়ে এসেছে। তাদের খবর তারা জানেন না।
দাদা নুর বাশার বলেন, 'আমাদেরও কেউ নাই। ছেলেদের মেরে ফেলেছে। মেয়েদের খুঁজে পাচ্ছি না। ওরে (রেদোয়ান) বুকে করে এনেছি। বাপ-মা হারা পোলাটা। আর একটু হলে ওকেও মারত। আমরা আর বাঁচবো কয়দিন। ওরে কে দেখবে জানি না। '
জাতিসংঘ শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) তথ্যমতে, রাখাইনে সাম্প্রতিক সহিংসতার পর বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গার ৮০ শতাংশের বেশি নারী ও শিশু। জাতিসংঘের হিসেবেই আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে ৬০ শতাংশই শিশু।
আরও পড়ুন>>
** সব হারিয়ে রোহিঙ্গা নারীদের সম্বল কোলের সন্তান!
বাংলাদেশ সময়:১৯৪০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৮, ২০১৭
এমসি/জেএম