ঢাকা, রবিবার, ২২ বৈশাখ ১৪৩১, ০৫ মে ২০২৪, ২৫ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

দুর্যোগ সতর্কীকরণ বাংলাদেশে হাজারো প্রাণ বাঁচিয়েছে

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০০৬ ঘণ্টা, জুলাই ২৫, ২০১৭
দুর্যোগ সতর্কীকরণ বাংলাদেশে হাজারো প্রাণ বাঁচিয়েছে ঘূর্ণিঝড় মোরা'র আগাম খবর পেয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে।

ঘূর্ণিঝড় মোরা (Cyclone Mora) চলতি বছরের ৩০ মে যখন বাংলাদেশে আঘাত হানে, তখন প্রবল ও ভয়ানক ঘূর্ণি হাওয়া বাংলাদেশের কৃষিজমিকে তছনছ করে দালানকোঠা ভেঙ্গেচুরে দিয়ে যায়। সংবাদমাধ্যমও তখন দ্রুতই সেই ধ্বংসযজ্ঞকে তুলে ধরে। তবে যা ছিল এর চেয়েও লক্ষ্য করবার মতো বিষয়, তা হচ্ছে জীবনহানি হয়েছিল তুলনায় খুবই কম; মাত্র ৯ জন। ৫ লাখেরও বেশি মানুষকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোগুলো ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডব ঠিকই মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়।

বাংলাদেশ তার জনগণের জানমালের সুরক্ষা দিতে এ পর্যন্ত অনেক কিছুই করেছে। আর বড় বড় দুর্যোগের বিরুদ্ধে তার এসব প্রচেষ্টা ব্যাপক সফলতা পেয়েছে।



ভৌগোলিক কারণেই বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকির মুখে থাকে। দেশটির অবস্থান উষ্ণ জলের সাগর বঙ্গোপসাগরের সামনে। সাগরটি এই এলাকায় অনেকটা ঘূর্ণিঝড় বা সাইক্লোন চলাচলের চোঙ্গা বা ফানেলের মতো কাজ করে। প্রতিবছরই ভয়ানক ঝড়-ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতের লক্ষ্যবস্তু বা ‘ষাঁড়ের চোখ’ (বুলস আই)  থাকে বাংলাদেশে।

সর্বোপরি, ইতিহাসের সবচে’ প্রলয়ংকরী ঝড়-ঘূর্ণিঝড়গুলোর কবলে পড়ে দুর্ভোগের শিকার হয়েছে বাংলাদেশ।
১৯৭০ সালে এক প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে তিন লাখ মানুষ প্রাণ হারায়। এরপর বাংলাদেশ তার দুর্যোগ সতর্কীকরণ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন করতে শুরু করে; অনেক বেশি আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ, লোকজনকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা প্রণয়ন, উপকূলীয় বাঁধ নির্মাণ, বাড়তি উপকূলীয় বনছায়া বা সবুজপ্রাচীর নির্মাণের পাশাপাশি ঘূর্ণিঝড়ের বিপদ ও ভয়াবহতা সম্পর্কে লোকজনকে সচেতন করার কার্যক্রমও শুরু করা হয়। ফলাফল এই: পরবর্তী প্রলয়ংকরী ঝড়গুলোতে জীবন ও সম্পদহানি হয়েছে অনেক কম ।  
বাংলাদেশের দুর্যোগ মোকাবেলা পরিকল্পনার একটি বড় স্তম্ভ হচ্ছে ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় প্রস্তুতি কার্যক্রম (Cyclone Preparedness Program)। যৌথভাবে এটির রূপরেখা প্রণয়ন করেছিল বাংলাদেশ সরকার, জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক রেডক্রস ও বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি।
ঘূর্ণিঝড় মোরা
এই কাযর্ক্রমের আওতায় বাংলাদেশ এর নাগরিকদের (আসন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ সম্পর্কে) অবহিত রেখেছে। বাংলাদেশ ঘূর্ণিঝড়ের সতর্কতা সংকেতের বিষয়ে মানুষকে সচেতন করে তুলতে ব্যাপক প্রচারণা শুরু  করে; একই সঙ্গে মানুষের কাছ-বরাবর তথ্য পৌঁছে দেবার জন্য নতুন উপায়ও বেছে নেয়। এসবের মধ্যে আছে আলোচনা সভা, পোস্টার, লিফলেট বিতরণ, প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন এবং ব্যক্তিগত যোগাযোগ। এসব সৃজনশীল প্রচেষ্টা বহু বছরব্যাপী কোটি কোটি লোককে শিক্ষিত-সচেতন করার পাশাপাশি বহু অমূল্য জীবন বাঁচিয়েছে।

ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কার্যক্রমের মধ্যে আরও অন্তর্ভূক্ত রয়েছে আগাম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা (warning system)। এটি পরিচালিত হয় সর্বাধুনিক আবহাওয়া-র‌্যাডার কেন্দ্রগুলো থেকে। ঢাকা, খেপুপাড়া ও কক্সবাজারে অবস্থিত কেন্দ্রগুলো থেকে প্রতি মিনিটে আবহাওয়ার খবরের আপডেট দেয়া হয়। এর ফলে সম্ভাব্য প্রলয়ংকরী ঝড় উপকূলে আঘাত হানার বহু আগেই তা শনাক্ত করা সম্ভব হয়।

এই ব্যবস্থাটি অগ্নিপরীক্ষার মুখে পড়ে ২০০৭ সালে যখন ঘূর্ণিঝড় সিডর বাংলাদেশের উপকূলীয় নিম্নাঞ্চলের ওপর দিয়ে ব্যাপক ভয়াবহ তাণ্ডব চালিয়ে যায়। প্রচণ্ড গতিতে ধেয়ে আসা ওই প্রলয়ংকরী ঝড়টি মোকাবেলার জন্য প্রয়োজন ছিল দ্রুত সাড়া দেওয়ার ব্যবস্থা করা। বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এবং স্বেচ্ছাসেবকরা অনতিবিলম্বে সর্বশক্তি নিয়ে তা মোকাবেলায় ঝাঁপিয়ে পড়েন। ৩০ লাখেরও বেশি মানুষকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া হয়; এছাড়া আরো হাজার হাজার মানুষ জরুরি আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে আশ্রয় লাভে সক্ষম হয়। আগাম সতর্কতামূলক প্রস্তুতি এবং ঝুঁকিহ্রাস কার্যক্রমের সুবাদে লাখো লাখো মানুষের জীবন রক্ষা পায়।

ব্যাপক হারে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ ঘূর্ণিঝড়-সংশ্লিষ্ট প্রাণহানি উল্লেখযোগ্য হারে কমাতে সহায়ক হয়েছে। ২০০৭ সালের আগে বাংলাদেশে আশ্রয়কেন্দ্র ছিল ১ হাজার ৫শ’। এদের প্রতিটি প্রায় ৫ হাজার লোককে আশ্রয় দিতে সক্ষম। এরপর বাংলাদেশ বাড়তি আরো ২ হাজার আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করেছে।  

উপকূলীয় অঞ্চলে গাছপালা লাগিয়ে সবুজ বেষ্টনী নির্মাণের ফলেও ঘূর্ণিঝড়ের বিরূপ প্রভাব নাটকীয়ভাবে কমে এসেছে। সিডর নামের ঘূর্ণিঝড়ের সময় বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় ম্যানগ্রোভ বনভূমিও (সুন্দরবন) সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি এবং জীবনহানি অনেকাংশে কমিয়েছে। বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা আরো ১ হাজার ২শ’ কিলোমিটার এলাকায় ম্যানগ্রোভ বনায়ন সম্প্রসারণের কাজ করে চলেছেন।  

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৮ সালে নির্বাচনে জেতার পর তিনি ও তার সরকার প্রকাশ্যে একথা বলে আসছিলেন যে, জলবায়ুর পরিবর্তনের সঙ্গে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের অস্তিত্ব অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ ব্যুরোকে তিনি একটি পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রণালয়ে রূপান্তরিত করেন। এর ওপর ন্যস্ত করা হয় ঝুঁকিহ্রাস সংক্রান্ত দায়িত্ব, যেসবের মধ্যে রয়েছে মানবিক সহায়তা কর্মসূচি পরিচালনা, সরকার ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর (এনজিও) নেওয়া জরুরি সাড়াদান কার্যক্রমের মধ্যে সমন্বয় সাধন।
ঘূর্ণিঝড় মোরা
নিশ্চিতভাবেই বলা চলে, এসব সত্ত্বেও দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য নেওয়া পরিকল্পনায় এখনও অনেক ফাঁকফোকর রয়ে গেছে। উদারণস্বরূপ, জুন মাসে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে মৌসুমী বৃষ্টিপাতের কারণে সৃষ্ট ভূমিধসে ১৬০ জনেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম নামে পরিচিত যে অঞ্চলটিতে এই বিপর্যয়টি ঘটেছে সেখানে বনউজাড় করে ভুলভাবে ঘরবাড়ি বানানো হয়েছে।  

একথা অনস্বীকার্য যে, জলবায়ু পবির্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ –এ দুয়ের মিলিত প্রভাবের কারণে বাংলাদেশ হয়ে আছে বিশ্বের সবচে’ ঝুঁকিপ্রবণ দেশগুলোর একটি। তবে একথাও ঠিক যে, এসব দুর্যোগ মোকাবেলায় সারাবিশ্বে বাংলাদেশেরই রয়েছে সবচেয়ে ব্যাপক বিস্তৃত কার্যক্রম। দুর্যোগের প্রতি মনোযোগ ও দৃঢ় প্রত্যয়ের সুবাদে মানুষ ও প্রকৃতির সর্বনাশা তাণ্ডব মোকাবেলায় বাংলাদেশ তার চেয়ে বহুগুণে ধনী প্রতিবেশীদের চেয়ে অনেক বেশী প্রস্তুত। ডিপ্লোম্যাট ম্যাগাজিন থেকে

সজীব ওয়াজেদ: বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা

বাংলাদেশ সময়: ১৬০০ ঘণ্টা, জুলাই ২৫, ২০১৭
জেএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।