ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

‘রাইড শেয়ারিং’ নীতিমালার নামে অনিয়ন্ত্রিত ফাঁকির সুযোগ!

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২৩১৭ ঘণ্টা, জুলাই ১০, ২০১৭
‘রাইড শেয়ারিং’ নীতিমালার নামে অনিয়ন্ত্রিত ফাঁকির সুযোগ! ‘রাইড শেয়ারিং’ নীতিমালার নামে অনিয়ন্ত্রিত ফাঁকির সুযোগ!

ঢাকা: দু’দিন পরেই শেষ হচ্ছে স্মার্টফোন অ্যাপস্‌ভিত্তিক ‘রাইড শেয়ারিং’ নীতিমালার মতামত গ্রহণ। এরই মধ্যে প্রকাশিত খসড়া নীতিমালা অনুসারে অনেক বিষয়েই ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকার সুযোগ থাকছে অ্যাপস্‌ প্রতিষ্ঠানগুলোর।

বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) নিয়ন্ত্রণ আরোপের বদলে নীতিমালায় উল্টো অনিয়মের পথ খোলা রাখছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।

খসড়া নীতিমালা অনুসারে, উবারের মতো রাইড শেয়ারিং অ্যাপস্‌ভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলো সেবাগ্রহীতাদের কাছ থেকে টাকা আদায় করে নিলেও যার খবর জানতে পারবে না সরকারের যান নিয়ন্ত্রণ সংস্থাটি।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রকাশিত (খসড়া) নীতিমালায় বেজায় খুশি উবারসহ অন্যান্য অ্যাপস্‌ প্রতিষ্ঠানগুলো। নীতিমালার অনেক বিষয়ই তাদের পক্ষে গেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

এ নীতিমালার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত উবারকে রাইড শেয়ারিং কোম্পানি বিবেচেনায় নিয়েই তা প্রণয়ণ করা হয়েছে। বিবেচনায় নেওয়া হয়নি আশাতীতভাবে বিস্তার লাভ করা মোটরসাইকেলে রাইড শেয়ারিং অ্যাপস্‌গুলোকে। এছাড়া সবগুলো অনুচ্ছেদেই উবারের দিকে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। বাকি মোটরগাড়ির অ্যাপস্‌ সম্পর্কে ‍পুরো অন্ধকারে রয়েছে বিআরটিএ।

এমনকি এ ধরনের সেবাদানকারী সংস্থাগুলোর সম্পর্কে ধারণাও নেই রাষ্ট্রীয় এ সংস্থার। নীতিমালা তৈরির সময় তাদের কারও সঙ্গে কথাও বলেনি বিআরটিএ। এ পরিস্থিতিতে মোটরসাইকেল ভিত্তিক অ্যাপস্ প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের মতো করে চলার সুযোগ পেয়ে যেতে পারে।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, খসড়া নীতিমালা অনুসারে বড় অংকের মুনাফা ঘরে নেওয়ার সুযোগ রয়েছে উবারের। যার কোনো ধারণাই করতে পারেনি বিআরটিএ।

 
বিআরটিএ’র তৈরি খসড়ায় দেখা গেছে, অ্যাপস্‌ প্রতিষ্ঠানগুলোকে কমপক্ষে ২০০টি মোটরযান নিয়ে ব্যবসা শুরু করতে হবে। সর্বোচ্চের কোনো সীমা নির্ধারণ করা হয়নি। এই মুহূর্তে ঢাকায় কেবল উবারেরই অ্যাপস্‌ ব্যবহারকারী গাড়ির সংখ্যাই তিন হাজারেরও বেশি বলে জানা গেছে।

নীতিমালা অনুসারে, অ্যাপস্‌ভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিআরটিএতে দিতে হচ্ছে গাড়িপ্রতি ১ হাজার ২০০ টাকা। ২০০ গাড়ির জন্য ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা জমা দিলেই ব্যবসার অনুমতি পাবে কোম্পানিগুলো!

কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলো অনুমোদনের পর অতিরিক্ত গাড়ি চালালে তার নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারির কোনো ব্যবস্থার কথা বলেনি বিআরটিএ। এতে জালিয়াতির আশঙ্কা করছেন পরিবহন খাতের সংশ্লিষ্টরা।

তাদের মতে, রাইড শেয়ারিং সংস্থাগুলো ২০০ গাড়ির অনুমতি নিয়ে কয়েকগুণ বেশি গাড়ি চালালেও তা ধরতে পারবে না বিআরটিএ। এতে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাবে। অন্যদিকে, অননুমোদিত গাড়িতে ভ্রমণে যাত্রীদেরও ভোগান্তিতে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

বর্তমানে উবারের গাড়ি সংখ্যা কেবল ঢাকাতেই তিন হাজারের বেশি। আর এ সংখ্যা যে ক্রমশ বাড়ছে তা নিজেই জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

এক হিসেবে দেখা গেছে, যদি ৩ হাজার উবার কার দিনে ১০টি করে ট্রিপ দেয়, তাহলে ট্রিপ রাইড হয় দিনে ৩০ হাজার। প্রতি রাইডে ২০০ টাকা করে পেলে দিনে ৩০ হাজার রাইড থেকে আয় হবে ৯০ লাখ টাকা। সেখান থেকে ২০ শতাংশ কেটে নেবে উবার। ফলে শুধু একদিনেই ঢাকায় উবারের আয় হবে ১৮ লাখ টাকা।
 
দেখা গেছে, জন্মস্থান সানফ্রান্সিসকো সিটিতে উবার রাইডপ্রতি টাকা দেয় ওখানকার কর্তৃপক্ষকে। কিন্তু বাংলাদেশে উবার ২০০ গাড়ির অনুমোদন নিয়ে বেশি গাড়ি পরিচালনা করলেও তা ধরার ব্যবস্থা নেই।

নীতিমালার ৩ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, একজন গাড়িচালক একটিমাত্র অ্যাপস্‌ কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে গাড়ি চালাবেন। অন্য অ্যাপস্‌ ব্যবহার করতে পারবেন না। যা বিশ্বে প্রচলিত রাইড শেয়ারিং ধারণার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। অন্য দেশগুলোতে একজন রাইড শেয়ারকারী তার প্রয়োজনে দিনে যেকোনো অ্যাপস্‌ ব্যবহারের সুযোগ পান তার স্মার্টফোন থেকেই।

আবার নীতিমালার ৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‍ মোটরগাড়ির চালক কোনো একটি অ্যাপস্‌ প্রতিষ্ঠানে নিবন্ধনের ৩ মাসের মধ্যে তা ত্যাগ করে অন্য অ্যাপসে যেতে পারবেন না। এটি এ সংক্রান্ত বৈশ্বিক ধারণার পরিপন্থী। কারণ, তারা যে সময় যে অ্যাপসে অনুরোধ পাবেন সেই অ্যাপসের অনুরোধকারী সেবা গ্রহীতাকে গন্তব্যে নিয়ে যাবেন- এটিই বিশ্বে প্রচলিত। এ অবস্থায় একটি অ্যাপস্‌ ছেড়ে অন্য অ্যাপসে যেতে বাঁধার মুখে পড়তে হবে তাদের।

আবার একটি অ্যাপস্‌ ছেড়ে যেতে হলে ওই অ্যাপস্‌ থেকে ‘ডিএনলিস্টমেন্ট সার্টিফিকেট’ নিতে হবে। যা পৃথিবীর কোনো দেশের রাইড শেয়ারিং নীতিমালায় নেই।

অনুচ্ছেদ ১ এর ১১ নম্বরে বলা হয়েছে, রাইড শেয়ারের জন্য একটি গাড়ি এক বছরের পুরনো হতে হবে।   অর্থাৎ একজন নতুন গাড়ির মালিককে অ্যাপস্‌টি ব্যবহার করতে এক বছর অপেক্ষা করতে হবে। যা একটি অদ্ভুত নীতি বলেই মনে হচ্ছে অনেকের কাছে।

একজন মোটরসাইকেল বাইকার নীতিমালার এ অনুচ্ছেদ নিয়ে প্রতিবাদ করে বলেন, ‘যখন ইচ্ছা তখন ওই অ্যাপস্‌ ব্যবহার করে রাইডারকে সেবা দেবো। এখানে একটি অ্যাপসে ৩ মাস পড়ে থাকার মানে কি?’

অনুচ্ছেদ ৪ এর ৯ নম্বরে শুধু মোটরগাড়ি চালকের নাম-ঠিকানা জাতীয় পরিচয়ত্রসহ বিস্তারিত চাওয়া হয়েছে। যিনি আরোহী বা যাত্রী তার কোনো তথ্য চাওয়া হয়নি। এ অবস্থায় আরোহী গাড়ি ব্যবহার করে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঘটিয়ে ফেললে তা ধরতে পারার কোনো কৌশল বিআরটিএতে নেই।

বাংলাদেশে মোটরসাইকেলে রাইড শেয়ারের ধারণা প্রথম নিয়ে আসে শেয়ার এ মোটরসাইকেল (স্যাম)। স্যাম ছাড়াও এখন পাঠাও, আমরা বাইক, ইয়েস বাইক, ঢাকা মটো মোটরসাইকেলে রাইড শেয়ারিং অ্যাপস্ হিসেবে সেবা দিচ্ছে। স্যাম ছাড়া বাকি অ্যাপস্‌গুলো চালক ও আরোহীর বিস্তারিত তথ্য নিচ্ছে না।  

তাদের কারও সঙ্গে যোগাযোগও নেই বিআরটিএ’র। যে সুযোগে তারা তাদের মতো করেই এ সেবা দিয়ে যাবে। যেখানে নিয়ন্ত্রণ আরোপের নীতিমালার নামে অনিয়ন্ত্রিত চলার সুযোগ খুলে যাচ্ছে বলে অভিযোগ করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বিআরটিএ’র পরিচালক শেখ মো. মাহবুব-ই-রব্বানী রাইড শেয়ারিং অ্যাপস্‌ প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম জানাতে পারেননি। নীতিমালা তৈরিতে তার ভূমিকা একজন সদস্য মাত্র ছিলো উল্লেখ করে তিনি বলছেন, এটি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। মতামত শেষে চূড়ান্ত হবে।

মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, আগামী বৃহস্পতিবারের (১৩ জুলাই) পর আন্ত:মন্ত্রণালয় সভা করে নীতিমালাটির চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হবে।

বাংলাদেশ সময়: ০৫১৫ ঘণ্টা, জুলাই ১১, ২০১৭
এসএ/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।