ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

পচা ধানেই হাঁসের মরণ!

এম আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭১৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৪, ২০১৭
পচা ধানেই হাঁসের মরণ! নেট দিয়ে ঘেরা খামার- ছবি- অনিক খান

অষ্টগ্রাম হাওর (কিশোরগঞ্জ) থেকে: বড় হাওরের বুক চিরে ডুবো সড়কের পাশের হাঁসের খামারগুলো এখন শূন্য। কিছু হাঁস মারা গেছে অকাল বানের মড়কে আর বাকিগুলোকে বাঁচাতে সরিয়ে নিয়েছেন খামারিরা। 

শূন্য খামারগুলো তাই খাঁ খাঁ করছে হাওরবাসীর হতাশার প্রতীক হয়ে।  

চৈত্রের অকাল ঢলে ফসল হারানোর হাহাকারের মাঝেই হাঁসের পালে মড়ক ‘মরার ওপর খাড়ার ঘা’ হয়ে এসেছে কলাপাড়া গ্রামের ভাগ্য বিড়ম্বিতদের জীবনে।

মরা হাঁসের দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে নেট দিয়ে ঘেরা খামারগুলো থেকে।  

হাওরের ভারী বাতাসে আতঙ্ক ছড়িয়েছে ক্ষেতে পচা ধান আর আগাছা, বিষাক্ত হয়ে উঠেছে সেগুলো। এমন কালচে পানির ধানক্ষেত থেকে তাই দূরে নিয়ে এখনো স্বচ্ছ থাকা পানিতে বেঁচে যাওয়া হাঁসগুলোকে চড়াচ্ছেন খামারিরা।  

কয়েক দিনে অষ্টগ্রাম বড় বাজার থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরের এ গ্রামেই মরেছে হাজারখানেক হাঁস। একদিনে আড়াইশ’ হাঁস মরায় দুর্গতদের তালিকার সামনের দিকে আছে খামারি সবুজ মিয়ার নাম। খামার মেরামত করছেন খামারিহাঁসের মড়কে নিজের শেষ অবলম্বনটুকুও হারানোর ভয়। ‘পচা ধান খেয়েই মূলত হাঁস মরে ভেসে উঠছে’- জটলার অনেকের মধ্য থেকে উৎকণ্ঠিত মতামত সবুজের।  

সঙ্কটের এ সময়টাতে হাঁসের ডিম আর হাঁস বিক্রি করে অন্তত চাল-চুলোর ব্যবস্থা হতো। ভাগ্য বিপর্যয়ে পড়ে হাসি নেই তাই খামারি সাবেদ মিয়ার (৩৫) মুখেও।  

তার খামারের হাজারখানেক হাঁসের মধ্যে মরেছে শ’খানেক। তিনিও মনে করেন, ‘ক্ষেতের পচে যাওয়া ধান-আগাছা আর পানি হাঁসগুলোকে মেরে ফেলছে’।  

তবে ডার্ক প্লেগ রোগও হাঁসের এ মড়কের কারণ হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।  

কলাপাড়ার উত্তর পাশে বড় হাওরের স্বপ্নের বোরো ফসল ঢলে তলিয়েছে। সে ধানের বেশিরভাগই উদ্ধার করা যায়নি। বুক সমান ঠাণ্ডা পানিতে ধান কেটে আনতে কাঁচির ফ্যাঁস দেওয়ারও সাহস করেননি হাওরের কৃষকেরা।  

সামনের দিনগুলোতে অনাহারের শঙ্কা ভর করছে। খোরাকির ধানটুকু পর্যন্ত হারানো অনেকের শেষ স্বপ্ন ছিল হাঁসের খামার। ফসল ফলানোর যন্ত্রণা খানিকটা ঘুচতো খামারে।  

কিন্তু নিয়ম ভেঙে আসা চৈত্রের ঘোর বর্ষা তাদের ভাসিয়েছে হতাশার অতল জলে।  

‘মরণ ছাড়া উপায় নেই’ ডুবে যাওয়া ধান তুলতে না পেরে বলছিলেন কৃষক জালাল মিয়া (৫০)। ১৪ একর জমিতে তিনি আবাদ করেছিলেন বোরো ফসল। এর মধ্যে উদ্ধার করে আনতে পেরেছেন মাত্র আধা একর জমির ধান।

কলাপাড়া গ্রামের হাওরের রাস্তার মুখে তার সঙ্গী আরো জনাবিশেক কৃষক। বিলীন ফসলি জমির পাশাপাশি অনেকের ডিম পাড়া অর্ধ শতাধিক হাঁসের খামারেও রীতিমতো স্বপ্নভঙ্গের বেদনা। বিষাদমাখা চেহারায় হাহাকারের সুর তাদের কণ্ঠেও।  

সদর ইউপি চেয়ারম্যান সৈয়দ ফারুক দেখতে এসেছেন সর্বশান্ত খামারিদের। তিনি বলেন, ‘ক্ষেতেই জমির ফসল পচে নষ্ট হয়ে দূষিত হচ্ছে পানি। নষ্ট ধান ক্ষেতের ঘাসও খামারিদের সর্বনাশের কারণ’।  

তার ভাষ্যে- খামারিরা সাধারণত হাওরের বুকেই হাঁস চড়ান। এসব হাঁস জমির ফসল কাটার পর ক্ষেতে পড়ে থাকা ধান ঠুকে ঠুকে খায়। কিন্তু  ধান পচে ক্ষেতের ঘাস পর্যন্ত বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পড়েছে।  

কাঁচা ধান পানিতে তলিয়ে অ্যামোনিয়া গ্যাসের দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। বিষাক্ত পানি আর ক্ষেতের ঘাসেই কয়েক দিনে হাওরে প্রায় হাজারখানেক হাঁস মরে গেছে। পথে বসেছেন শত শত খামারি। নেট দিয়ে ঘেরা শ‍ূন্য খামার পাশেই দাঁড়ানো জামাল মিয়া’র ভাষায়- আতঙ্কে খামারিরা খামারের আশেপাশে ধান ক্ষেতে হাঁসের পাল ছাড়ছেন না’।  

নিজেদের লগ্নির পাশাপাশি ঋণ নিয়ে খামারি হওয়া জামাল মিয়া বলেন, মড়কের ভয়ে অনেকেই হাঁস বিক্রি করে ফেলেছেন। কেউ কেউ আবার প্রতিষেধক ওষুধ সংগ্রহে দৌড়-ঝাঁপ করছেন।  

ইউপি চেয়ারম্যান ফারুক বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত খামারিদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ না নিলে সামনে সবাই হাঁস পালনে আগ্রহ হারাবেন। হাঁসকে বিপদমুক্ত রাখতে ওষুধের ব্যবস্থাও জরুরি।  

** হাওরে দুর্যোগে নেই পাউবো-এলজিইডি!
** ‘হাওর ভাত দেয় না, গৃহস্থরেই মারে’
** কলাগাছের ভেলাই যেন হাওরে ‘সোনার তরী’!
** হাওর বধূদের মুখেও আঁধার!
** হাওরে কৃষকদের দুর্দিনে মাথায় হাত চাটাই ব্যবসায়ীদের
** চোখ-নদীর জল একাকার হাওরের জলে!
** হাওরে বিদ্যুৎ যায় না, আসে!
** শুন্য হাতে ফিরছেন ‘জিরাতিরা’

বাংলাদেশ সময়: ১৩১০ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৪, ২০১৭ 
এমএএএম/জেডএস/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।