ঢাকা, শনিবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

আইন ও আদালত

‘বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা বঙ্গবন্ধুই সরিয়েছেন’

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯১৭ ঘণ্টা, মে ২৪, ২০১৭
‘বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা বঙ্গবন্ধুই সরিয়েছেন’

ঢাকা: ‘বঙ্গবন্ধু নিজেই বিচারকদের অপসারণের ব্যাপারে সংসদ থেকে ক্ষমতাটা নিয়ে গিয়েছিলেন। যেটা বঙ্গবন্ধু নিয়েছিলেন, আমরা মনে করি, তারই অনুসারী হিসেবে সেটা সমর্থন করা দরকার। যদি কেউ এটির বিরোধিতা করেন, তাহলে আমি মনে করি সেটি সঠিক হবে না’।

ষোড়শ সংশোধনীর রিট আবেদনকারীদের পক্ষে শুনানি শেষে বুধবার (২৪ মে) আইনজীবী মনজিল মোরসেদ এ কথা বলেন।

সংসদের মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণে আনা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল শুনানিতে যুক্তিতর্ক (আর্গুমেন্ট) উপস্থাপন শেষ করেছেন উভয়পক্ষ।

এরপর অ্যামিকাস কিউরিদের (আদালতের বন্ধু বা আইনি সহায়তাকারী)   মতামত নিচ্ছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। অ্যামিকাস কিউরি ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম মতামত দেওয়া শুরু করেছেন।

বৃহস্পতিবার (২৫ মে) পর্যন্ত শুনানি মুলতবি করেছেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে সাত বিচারপতির আপিল বেঞ্চ।

বুধবার আপিল শুনানির ষষ্ঠ কার্যদিবসে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। এরপর রিট আবেদনের পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন মনজিল মোরসেদ।

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘আমরা যুক্তিতে প্রথমেই ষোড়শ সংশোধনীর প্রেক্ষাপট তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। হঠাৎ করেই কেন এ সংশোধনী? আরেকটি যুক্তিতে বলেছি, অ্যাটর্নি জেনারেল আপিল বিভাগে বক্তব্য রেখেছিলেন যে, ১৫তম সংশোধনীটি ছিলো কাটিং অ্যাণ্ড পেস্টিং, কোনো আলোচনা হয়নি। এর জবাবে বলেছি- ১৫তম সংশোধনী যখন পাস হয়, তখন সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে পার্লামেন্টে আইন পাসের মাধ্যমে প্রোটেক্ট করা হয়েছিল। সে সমস্ত বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এটি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বিচার বিভাগের স্বাধীনতার বিষয়ে সোচ্চার ছিলেন। সেই হিসেবে তার নির্দেশেই ওই দিন সংশোধনী হয়েছিল’।

মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘অ্যাটর্নি জেনারেল শুনানিতে সব সময় বলার চেষ্টা করেন যে, ষোড়শ সংশোধনী করে বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে গেছেন। এ বিষয়ে আমরা বলেছি, বাহাত্তরের সংবিধানের মূল চেতনা  এবং যার নেতৃত্বে আমাদের স্বাধীনতার যুদ্ধ হয়েছে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যার নেতৃত্বে সংবিধান প্রণীত হয়েছিল। সেই সংবিধানের প্রণেতা, আমাদের জাতির পিতার নেতৃত্বেই জাতীয় সংসদ থেকে বিচারক  অপসারণের ক্ষমতাটা সংসদ থেকে নিয়ে আসার একটি আইন পাস হয়েছিল ৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে’।

‘যেটি বঙ্গবন্ধু নিয়েছিলেন। আমরা মনে করি, তারই অনুসারী হিসেবে সেটিকে সমর্থন করা দরকার। যদি কেউ এর বিরোধিতা করেন, তাহলে আমি মনে করি, সেটি সঠিক হবে না’।

মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘১৫তম সংশোধনীতে তো বিচারক অপসারণের বিষয়টি মীমাংসা হয়ে গেল। সবার সঙ্গে আলোচনা করে এ আইনটা করা হলো। হঠাৎ করে কিছুদিন পরেই জনগণের পক্ষ থেকে কোনো সভা-সেমিনারে কেউ কখনো কোনো দাবি তোলেননি যে, এ আইনটির পরিবর্তন করা দরকার। কিন্তু কয়েকটি প্রেক্ষাপট সৃষ্টি হয়েছিল’।

‘যেমন একটি মামলাকে কেন্দ্র করে আদালতের মন্তব্য নিয়ে স্পিকার রুলিং দিয়েছিলেন। স্পিকারের রুলিং নিয়ে আলোচনায় কয়েকজন সংসদ সদস্য সংসদে দাঁড়িয়ে বক্তব্য দিয়েছিলেন যে- ‘আমরা এই ক্ষমতটা সংসদে নিয়ে আসবো’। শুধুমাত্র এ ব্যাকগ্রাউন্ডের ওপরই এই ষোড়শ সংশোধনী করা হয়েছে’।

‘এছাড়া দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ও আদালত অবমাননা আইনে সরকারি কর্মচারীদের সুবিধা দেওয়া হয়েছিলো। আমরা রিট মামলা করায় হাইকোর্ট সেগুলো অবৈধ ঘোষণা করেন। এর কিছুদিন পরেই নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনা ঘটে। সেখানেও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা জড়িত ছিলেন। হাইকোর্টের নির্দেশেই এটি অগ্রসর হয়েছে। এ সমস্ত সামগ্রিক বিষয়গুলোর কারণে প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিলো’।

ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম ছাড়াও অন্য তিন অ্যামিকাস কিউরি জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ড. কামাল হোসেন, আবদুল ওয়াদুদ ভূঁইয়া ও এম আই ফারুকী আগেও লিখিত মতামত জমা দিয়েছেন।

গত ০৮ ফেব্রুয়ারি নিয়োগ পাওয়া ১২ জন অ্যামিকাস কিউরির অন্য ৮ জন হলেন- এ এফ হাসান আরিফ, আজমালুল হোসেন কিউসি, রফিক-উল হক, রোকনউদ্দিন মাহমুদ, টিএইচ খান, এ জে মোহাম্মদ আলী, ফিদা এম কামাল ও শফিক আহমেদ।

আপিল শুনানির প্রথম দু’দিনে গত ০৮ ও ০৯ মে প্রথম দু’দিনে হাইকোর্টের দেওয়া রায় পড়ে শোনান এবং ২১ ও ২২ মে পরের দু’দিনে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা। মঙ্গলবার (২৩ মে) থেকে দু’দিন যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।

২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে নিতে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আনা হয়। বিলটি পাসের পর ২২ সেপ্টেম্বর তা গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়।

সংবিধানের এ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ওই বছরের ০৫ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের নয় আইনজীবী হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। এ রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে একই বছরের ০৯ নভেম্বর এ সংশোধনী কেন অবৈধ, বাতিল ও সংবিধান পরিপন্থী ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট।

২০১৫ সালের ২১ মে রুলের শুনানি শুরু হয়। রিট আবেদনকারীদের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।

এছাড়া অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে শুনানি করেন শীর্ষ আইনজীবী ড. কামাল হোসেন, এম আমীর-উল ইসলাম, রোকনউদ্দিন মাহমুদ ও আজমালুল হোসেন কিউসি।

গত বছরের ১০ মার্চ এ রুলের শুনানি শেষে ০৫ মে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে রায় দেন বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী, বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বিশেষ বেঞ্চ।

এর মধ্যে গত বছরের ২৫ এপ্রিল অসদাচারণের জন্য সুপ্রিম কোর্টের কোনো বিচারকের বিরুদ্ধে তদন্ত ও তাকে অপসারণের প্রক্রিয়া নির্ধারণ করে ‘বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট বিচারক (তদন্ত) আইন’ এর খসড়ার নীতিগত অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা।

ষোড়শ সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করে দুই বিচারপতির দেওয়া রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি গত বছরের ১১ আগস্ট সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়। ০৮ সেপ্টেম্বর অবৈধ বলে দেওয়া রায়ের সঙ্গে দ্বিমত পোষণকারী বিচারপতি  মো. আশরাফুল কামালের রায় প্রকাশিত হয়।

গত ০৪ জানুয়ারি এ বিষয়ে আপিল করেন রাষ্ট্রপক্ষ। ০৮ ফেব্রুয়ারি আপিল বিভাগ অ্যামিকাস কিউরিদের নিয়োগ দিয়ে ০৭ মার্চ শুনানির দিন ধার্য করেন। ওইদিন সময়ের আবেদন জানিয়ে আরও দু’মাস বাড়িয়ে নেন রাষ্ট্রপক্ষ।

১৯৭২ সালে প্রণীত মূল সংবিধানে উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের কাছে ছিল। ১৯৭৫ সালের ২৪ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে এ ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে অর্পণ করা হয়। পরে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা দেওয়া হয় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে।

মার্শাল প্রক্লামেশনে করা পঞ্চম সংশোধনীতে এক্ষেত্রে ৯৬ অনুচ্ছেদে পরিবর্তন আনা হয়েছিল। ষোড়শ সংশোধনীতে সেটা বাতিল করে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়া হয় সংসদকে।

বাংলাদেশ সময়: ১৫১৫ ঘণ্টা, মে ২৪, ২০১৭
ইএস/এএসআর

** ষোড়শ সংশোধনীর আপিলে অ্যামিকাস কিউরিদের মতামত গ্রহণ চলছে
** ‘জুডিশিয়ারি শতগুণ বেটার’
** ‘সংবিধানের এ টু জেড ব্যাখ্যা করতে পারি’

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।