ঢাকা, শনিবার, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

আন্তর্জাতিক

থাই গুহার উদ্ধার অভিযানের শুরু থেকে শেষ

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫৩৮ ঘণ্টা, জুলাই ১১, ২০১৮
থাই গুহার উদ্ধার অভিযানের শুরু থেকে শেষ গুহায় আটকে পড়া কিশোরদের উদ্ধার অভিযানের কিছু মুহূর্ত।

মরণপণ প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে বন্যায় তলিয়ে যাওয়া থাইল্যান্ডের থাম লুয়াং গুহা থেকে ১২ কিশোর ফুটবলার ও তাদের ২৫ বছর বয়সী কোচকে উদ্ধার করেন ডুবুরিরা। উদ্ধার অভিযানের তৃতীয় দিন মঙ্গলবার (১০ জুলাই) গুহা থেকে শেষ চারজন কিশোর ও কোচকে বের করে আনা হয়। এবার ফিরে দেখা যাক ১৭ দিন অন্ধকার গুহায় আটকে থাকা কিশোরদের উদ্ধার গল্পের শুরু থেকে শেষটুকু।

২৩ জুন শনিবার, ১২ সদস্যের ওয়াইল্ড বোয়ার ফুটবল টিম প্র্যাকটিস শেষে থাইল্যান্ডের চিয়াং রাই প্রদেশের থাম লুয়াং গুহায় প্রবেশ করে। ফুটবল টিমের সবার বয়স ১১ থেকে ১৬ বছর।

সঙ্গে ছিল তাদের ২৫ বছর বয়সী কোচ।

অত্যন্ত সরু এবং সাপের মতো আঁকাবাঁকা গুহাটি প্রায় ১০ কিলোমিটার (৬ মাইল) গভীর। এর আগেও দলটি থাম লুয়াং গুহায় ঘুরতে এসেছিল, কিন্তু এবার ঘটে যায় মারাত্মক বিপদ। ভারী বৃষ্টিতে গুহা থেকে বের হওয়ার পথ বন্ধ হয়ে যায়।

কিশোরদের দলটি বাড়ি ফিরতে ব্যর্থ হলে ধরে নেওয়া হয় তারা নিখোঁজ।  শুরু হয় অনুসন্ধান।  

অনুসন্ধানে বের হওয়া একদল উদ্ধারকর্মী গুহার প্রবেশ মুখের কাছে ওই কিশোরদের সাইকেল, ফুটবল বুট ও জিনিসপত্র পড়ে থাকতে দেখে। বোঝা যায় এই গুহাতেই ঢুকেছিল তারা। তারা সেখানে বেঁচে আছে নাকি মারা গেছে কিছুই বোঝার উপায় নেই।  দ্রুত গুহামুখে ছুটে যান স্বেচ্ছাসেবক ও মিডিয়াকর্মীরা। কিন্তু অনুসন্ধান ও উদ্ধার অভিযান আরও জটিল করে তোলে ভারী বৃষ্টিপাত।
গুহার প্রবেশ পথে কিশোর ফুটবলারদের রেখে যাওয়া সাইকেল।  ছবি: সংগৃহীত
রোববার ২৪ জুন, খবর পেয়ে এরইমধ্যে গুহামুখে ভিড় করেছেন কিশোরদের অভিভাবকরা। নিখোঁজ সন্তানদের জন্য দিন-রাত প্রার্থনায় থাকতে দেখা যায় তাদের।

তিনদিন পর স্থানীয় অনুসন্ধানকারীদের সাহায্য করতে সেখানে পৌঁছায় রয়াল থাই নেভির সদস্যরা। অনুসন্ধান অভিযান পর্যবেক্ষণ করতে আসেন সরকারি কর্মকর্তারা। যেভাবেই হোক ফুটবল দলকে খুঁজে বের করা হবে বলে সবাইকে আশ্বস্ত করেন থাই ডেপুটি প্রাইম মিনিস্টার।

আটকে পড়া কিশোরদের অবস্থান খুঁজে বের করার জন্য বিকল্প পথের সন্ধান চালানো হয়। তাছাড়া পাহাড়ের বিভিন্ন পয়েন্টে ড্রিল করে ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা করে কর্তৃপক্ষ।
চলছে আটকে পড়া কিশোরদের খোঁজে অনুসন্ধান।  ছবি: সংগৃহীত
২৭ জুন বুধবার, উদ্ধারকারীদের সহায়তার জন্য বিভিন্ন দেশ থেকে ডুবুরি ও সার্ভাইভাল স্পেশালিস্টরা থাম লুয়াং গুহায় ছুটে আসেন। সন্তানদের ভাগ্যে কী ঘটেছে, তখনও জানতেন না অভিভাবকরা। খারাপ আবহাওয়া আরও চিন্তিত করে তোলে তাদের। আর অতিরিক্ত পরিশ্রমের কারণে নিস্তেজ হয়ে যেতে দেখা যায় উদ্ধারকারী দলের কয়েকজনকে।

এমন পর্যায়ে মরণপণ অনুসন্ধান অভিযান শুরু করে কর্তৃপক্ষ। গুহায় আটকে থাকা ফুটবল টিমের ছবি এঁকে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করেন অনেকে। আর এরইমধ্যে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে সেখানে ছুটে আসেন সাংবাদিকরা। অনুসন্ধান অভিযানের সর্বশেষ খবরটি প্রকাশ পেতে থাকে বিশ্ব মিডিয়ায়। অপরিচিত ১৩টি মুখ বেঁচে থাকুক এবং নিরাপদে বেরিয়ে আসুক, এমন প্রার্থনায় বসে যান হাজার হাজার মাইল দূরে অবস্থানরত মানুষেরাও।
গুহার কাছে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করছেন পরিবারের সদস্যরা।  ছবি: সংগৃহীত
৩০ জুন শনিবার, থাম লুয়াংয়ে আটকে থাকা অবস্থায় একটি সপ্তাহ পেরিয়ে যায়। বৃষ্টি একটু থামলে ডুবুরিরা গুহার আরেকটু গভীরে প্রবেশ করতে সক্ষম হন। প্রয়োজনীয় রসদ ও অক্সিজেন ট্যাংক নিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অন্ধকার গুহার সরু আঁকাবাঁকা পথ ধরে এগিয়ে চলতে থাকেন তারা।

২ জুলাই সোমবার, নাটকীয় এক খবর প্রকাশ পায় বিশ্ব মিডিয়ায়। হারিয়ে যাওয়া কিশোর ও তাদের কোচকে জীবিত অবস্থায় খুঁজে পান ডুবুরিরা। গুহা মুখ থেকে প্রায় ৪ কিলোমিটার (২.৫ মাইল) গভীরে একটি পাথরের ওপর অবস্থান নিয়েছিল ফুটবল দলটি। অন্ধকার গুহায় তারা এই নয়দিন কীভাবে বেঁচে ছিল ভেবে অবাক হন অনেকে। নতুন উদ্যম ফিরে পান উদ্ধারকারীরা।

থাই নেভি সিলের প্রকাশিত একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, কোচসহ কিশোর ফুটবলাররা সবাই সুস্থ আছে। কিন্তু উদ্ধার অভিযান তখনও অনেক জটিলতার মুখে। ওই স্থানে চিকিৎসা সামগ্রী ও খাবার সরবরাহ করা হয় এবং কিশোরদের সেখান থেকে নিরাপদে বের করে আনার সর্বোত্তম পন্থাগুলো খতিয়ে দেখা হয়।
গুহার ভেতর কিশোর ফুটবলাররা।  ছবি: সংগৃহীত
লাখ লাখ গ্যালন পানি পাম্পের সাহায্যে গুহা থেকে বের করা হয়। কিন্তু বৃষ্টির মৌসুমে তেমন কার্যকর ফলাফল পাওয়া যায়নি এতে। বলা হয়, সেখান থেকে বেরিয়ে আসার জন্য ডুব সাঁতার শিখতে হবে কিশোরদের, অথবা গুহার ভেতর আরও চারমাস অপেক্ষা করতে হবে। গুহায় অবস্থানের জন্য খাবার, চিকিৎসার পাশাপাশি অক্সিজেনও বিরাট এক সমস্যা।

এদিকে আটকে পড়া কিশোরদের কাছে অক্সিজেন ট্যাংক পৌঁছে দিতে গিয়ে প্রাণ হারান সামান গুনান (৩৮) নামের থাই নেভির এক সদস্য।
সামরিক মর্যাদায় বয়ে নেওয়া হচ্ছে সামান গুনানের মরদেহ।  ছবি: সংগৃহীত
৮ জুলাই রোববার, উদ্ধার অভিযানের প্রধান ঘোষণা দেন, আজ হতে চলেছে কেয়ামতের দিন। অভিযানে চরম ঝুঁকি থাকার পরও যেকোনো উপায়ে  সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে প্রস্তুত আটকে পড়া কিশোররা।  

সকাল ১০ টায় শুরু হয় উদ্ধার অভিযান। প্রথমদিন চারজনকে উদ্ধার করেন ডুবুরিরা। উদ্ধারের পর অ্যাম্বুলেন্সে করে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তাদের। রাত হয়ে যাওয়ায় অভিযান স্থগিত করে পরদিন আবার শুরু হয়।

অপারেশনটি ছিল খুবই জটিল। সেখান থেকে বেরিয়ে আসার জন্য কোথাও লাফাতে হয়েছে, কোথায় বেঁয়ে বেঁয়ে উঠতে হয়েছে, আবার কোথাও দড়ি ধরে ডুব সাঁতার দিতে হয়েছে  কিশোরদের। সোমবার (৯ জুলাই) আরও চার কিশোরকে গুহা থেকে সফলভাবে বের করে আনা হয়। মঙ্গলবার (১০ জুলাই) নিরাপদে বের করে আনা হয় কোচসহ বাকি পাঁচজনকে।
উদ্ধার হওয়ার খবর প্রকাশিত হলে অনন্দ প্রকাশ করছেন অনেকে।  ছবি: সংগৃহীত
১৭ দিন মাটির নিচে আটকে থাকা সবাইকে নিরাপদে উদ্ধারের পর উদ্ধার অভিযানে অংশ নেওয়া সবাই একে-অপরের সঙ্গে হাত মেলান এবং আনন্দ উদযাপন করেন। দুশ্চিন্তা দূর হয় ওই কিশোরদের অভিভাবক ও পরিবারের। উদ্ধারকারী ডুবুরিদের রুদ্ধশ্বাস অভিযান ও সফলতার খবর প্রকাশিত হয় বিশ্বের প্রায় সব দেশের মিডিয়ায়। কিশোর ফুটবলার ও উদ্ধার অভিযানে অংশ নেওয়া ডুবুরিদের সাহসিকতার গল্প ভেসে বেড়াতে শুরু করে বিশ্ববাসীর মুখে মুখে।

বাংলাদেশ সময়: ১১৩০ ঘণ্টা, জুলাই ১১, ২০১৮
এনএইচটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।