ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

অধরা জগতের দূর নীলিমায় ‘সুয়া চান পাখি’

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩৫৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৪, ২০১৭
অধরা জগতের দূর নীলিমায় ‘সুয়া চান পাখি’ বারী সিদ্দিকী

উত্তর-পূর্ব বাংলার উড়াল পঙ্খির দেশের তিনি ছিলেন গানের একটি ‘সুয়া চান পাখি’। হিজলে তমালে ছাওয়া আদিঅন্তহীন হাওরের বুক থেকে গান নিয়ে তিনি ছড়িয়ে দিয়েছিলেন সারা বাংলায়। জল ছলছল লিলুয়া বাতাসে ভেসে সেই অপরূপ গানে গানে স্পর্শ করেছিলেন সমগ্র বাংলাদেশ এবং বিশ্বব্যাপী বাংলাভাষী মানুষদের। মরমী গানের ‘সুয়া চান পাখি’ বারী সিদ্দিকী এখন চলে গেছেন অধরা জগতের দূর নীলিমায়।

বাংলার আত্মা থেকে আহরিত গানকে করেছিলেন তিনি জীবনের ধ্রুবতারা। কথা ও সুরের সঙ্গে একাকার হয়ে মিশে যেতেন বেদনার প্রহরে প্রহরে।

তার গান শুধু গান মাত্র ছিল না, ছিল হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া রাশি রাশি বেদনার পুঞ্জিভূত মেঘমালা। আধুনিক ও যান্ত্রিক জীবনে আত্মা ও মননের বেদনার কথা মানুষ যখন ভুলেই যাচ্ছিলেন, তখন তিনি গেয়েছিলেন মর্মবেদনার গান। আত্মার হাহাকার হয়ে উচ্চারণ করেছিলেন মানুষের প্রেম ও বিরহের অপরূপ কথামালা।

নেত্রকোনা অঞ্চলেরই আরেক গুণীজন হুমায়ূন আহমেদের হাত ধরে বারী সিদ্দিকীর উত্থান হলেও তিনি নিজেকে নিবিড়ভাবে তৈরি করেছিলেন গানের জন্য। অসাধারণ সুরেলা বাঁশি বাজাতেন তিনি। দেশে-বিদেশে নিয়েছেন গানের তালিম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ উচ্চশিক্ষা ও আধুনিক জীবনের যাবতীয় আয়োজনকে তিনি মিশিয়ে দিয়েছিলেন মরমী গানের ঝরনাধারায়। নিজেকে পরিণত করেছিলেন একজন সাধকের পরিচয়ে। হয়ে উঠেছিলেন একজন নাগরিক বাউল।

গানকে নিয়ে বারী সিদ্দিকী অসামান্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং চর্চা করেছেন। সুর ও কথাকে নানা সাঙ্গীতিক ধারায় অবগাহন করিয়েছেন। যারা তার একক অনুষ্ঠান টিভিতে কিংবা সরাসরি দেখেছেন, তারা জানেন, কেমন সুনিপুণ কুশলতায় তিনি সুরের ইন্দ্রজাল বিস্তার করতে পারঙ্গম ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন সত্যিকারের সঙ্গীতজ্ঞ।

গানের দেশ প্রাণের দেশ বাংলাদেশকে যারা পরিচিত করিয়েছেন বিশ্ব ভুবনের সামনে, বারী সিদ্দিকী তাদের মধ্যে অন্যতম একজন। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে লোকজ ও মরমী সঙ্গীতের মরা নদীতে প্রাণের স্রোত এনেছিলেন তিনি। গ্রামীণ বাউল বা দেহতত্ত্ব বা বিরহের গানগুলোকে তিনি নিয়ে এসেছিলেন আধুনিক আঙিকের নাগরিক সমাবেশে। অগ্রসর প্রাযুক্তিক মাধ্যমে লোকায়ত গানের একটি সম্মানজনক জায়গা তৈরি করেছিলেন তিনি। বাংলার চিরায়ত গানগুলোকে লোকপ্রিয় এবং বহুলগীত করতেও তার অবদান অনন্য।

বাংলাদেশের নিজস্ব গানগুলোকে সংরক্ষণ ও জনপ্রিয় করতে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে কাজ করেছেন বহু নিবেদিতপ্রাণ গুণী শিল্পী। এই তালিকায় অগ্রবর্তী আব্বাসউদ্দিন, আবদুল আলীম, শাহ আবদুল করিম কিংবা সমকালীন ফরিদা পারভিনের সঙ্গে তার নাম উচ্চারিত হয়। তিনি ধ্যানীর মতো নিবেদনের প্রমাণ রেখেছেন সঙ্গীতের সাধনা ও বিকাশের কাজে। আপাদমস্তক একজন শিল্পী ও গায়কের স্বোপার্জিত পরিচয়ের স্বাধীন অস্তিত্বে তিনি নিজেকে পূর্ণ ও সফল করেছিলেন।

গায়ক, শিল্পী, সঙ্গীতকার বারী সিদ্দিকীর মধ্যে সমাবেশ ঘটেছিলো বহু গুণের। একজন সম্পূর্ণ সঙ্গীত-ব্যক্তিত্বের উজ্জ্বল প্রতিচ্ছবি ছিলেন তিনি। তিনি ছিলেন বহু মানুষের হৃদয়-স্পর্শকারী অনন্য শিল্পী। সাধারণ জনপ্রিয়তা লাভের জন্য তিনি মোটেও আগ্রহী ছিলেন না এবং এমন কোনো চেষ্টাও তিনি এক্ষেত্রে করেন নি। কিন্তু তার গান, তার কণ্ঠ, তার দরদী গায়কী আবেগ মানুষের মনে তাকে ঠাঁই দিয়েছে। তিনি পরিণত হয়েছেন তার কালের জনপ্রিয়তম সঙ্গীত আইকনে। তার প্রয়াণেই তিনি নিঃশেষ হয়ে যাবেন না। তিনি বেঁচে থাকবেন বাংলা গানের সুর ও ছন্দে, তার সুললিত কণ্ঠশৈলীর মাধুর্যে বাংলা গানের শ্রোতারা কোনো কোনো রাতে অপেক্ষা করবেন, রাতটি যেন শেষ না হয়। গভীর অন্ধকারে প্রকৃতির শরীরে তারা কান পেতে থাকবেন। হয়তো তখন বারী সিদ্দিকীর কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে কোনো কোনো  বিরহী হৃদয় বেদনার সুরে গাইবে, ‘রজনী হইস না অবসান/আজ নিশিতে আসতে পারে বন্ধু কালাচাঁন। ’

বাংলা গানের মরমী শ্রোতারা রাত জেগে অপেক্ষা করতেই থাকবেন। বন্ধু কালাচাঁন হয়ে বারী সিদ্দিকীর ফিরে আসার জন্য।

শিল্পী বারী সিদ্দিকী আর নেই

বাংলাদেশ সময়: ০৯৪৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৪,২০১৭
এমপি/বিএস 
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।