ঢাকা, শুক্রবার, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

উপন্যাস

নীল উড়াল: পঞ্চত্রিংশ পর্ব

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭০৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ৭, ২০১৭
নীল উড়াল: পঞ্চত্রিংশ পর্ব নীল উড়াল

নায়ক ম্যাকগিল ভার্সিটির অধ্যাপক-লেখক-অভিবাসী বাংলাদেশি। ফরাসি সুন্দরী মার্গারেট সিমোনের প্রণোদনায় দেশে মাদকচক্র নিয়ে গবেষণাকালে ঘটনা মোড় নেয় রোমাঞ্চকর বাঁকে। আসে ধুরন্ধর বন্ধু-অসৎ ব্যবসায়ী এনামুল, সুন্দরী স্টাফ রোকসানা, মধুচক্রের জেনিফার-মলি-পরী, ক্লিনিকের অন্তরালের মিসেস খোন্দকার, রমনার শফি মামা ও ফুলি, ‘উড়াল যাত্রা’র সাইফুল, বিড়ালের কুতকুতে চোখের তরুণ সাংবাদিক ফরমানউল্লাহ এবং ছোটখালার রহস্যময় মেয়ে অন্তরা। প্রেম ও বেঁচে থাকার যুগল উড়ালে কাহিনী আবর্তিত হতে থাকে।

৩৫.
সাইফুল ভালো ব্যবস্থাই করেছে। ট্রেনে জানালার কাছে সিট পেয়েছি।

বেচারা সারাটা দিন বড় খেটেছে আমার জন্য। এই বাজারে কে কার জন্য করে! চেনা নেই জানা নেই তবু আমার সাহায্যের জন্যে কেমন ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আহা! তার সোনা বউ, ছেলে-মেয়েগুলো! ওদের জন্য বুকের মধ্যে কেমন করছে। আমি নিজেই এক পলাতক জীবনের পথে। কিছুই দিতে পারি নি। দিনের মজুরিটুকুও না। তবু কি আনন্দে সহমর্মিতার হাত বাড়িয়েছে। ওদের অন্নভরা ভালোবাসার হাত রাতের অন্ধকারে আলোর শিখার মতো জ্বলছে। নিশ্চয় সাইফুল এতোক্ষণে বাসায় পৌঁছেছে। বউ, ছেলে, মেয়ে নিয়ে তার সুখের জগত আলো করে আছে। আহা কি মায়াবী ওর ছেলে-মেয়ে দু’টি।

নীল উড়াল: চতুর্ত্রিংশ পর্ব

বিমানবন্দর স্টেশন পেরিয়ে যেতেই অন্ধকার গভীর হলো। আমার উপরও কম টেনশন আর ধকল যায় নি! ট্রেনের মৃদু দুলুনিতে চোখে তন্দ্রা নেমে আসছে। গভীর ঘুমের দেশে আমি। আমি পালাতে চাই না; বাড়ি যেতে চাই। সাইফুলের মতো বাড়ি। সুখের আলোকিত অঙ্গন। ঘুমের ঘোরে বুঝতে পারছি না, আমি নাকি সাইফুল, ট্রেনের শব্দের সঙ্গে সুর মিলিয়ে বাড়ি যাওয়ার গান গাইছে:
        বাড়ি যাবো, বাড়ি যাবো, বাড়ি...
        পথ ছাড়ো অন্ধকার, পথ ছাড়ো দূরত্বের দূরগামী পথ
        বাড়ি যাবো, বাড়ি...
        বৈশাখের বটবৃক্ষ তালুতে কপোল রেখে বলে, হায়,
        এ-ছেলেকে কিছুতেই ফিরতে দেয়া চলবে না; নগরীর পথ
        দালানের পরভৃত কোকিলের পঞ্চস্বর ডেকে বলে, শোন
        তোর কোন বাড়ি নেই,
        অন্তরঙ্গ উচ্চারণে যাকে বলে হোম
        সুইট হোম সে আজ ভেসে গেছে বিস্মৃতির যমুনার জলে।
        তোমার আসার জন্য কেউ নেই হাট করে ঘরের দরোজা,
        পলাতক সময়ের ঝুঁটিবাঁধা কাকাতুয়া
        দাঁড় ছেড়ে পালিয়েছে সেই কবে; ঘাটলার কাঠগুলো
        কবে কোন চোর
        নিয়ে গেছে অন্তঃপুরে চুলার হৃদয় জুড়ে শান্তি দেবে বলে।
        তবু বাড়ি যাবো, বাড়ি যাবো, বাড়ি...
        পথ ছাড়ো সুসময়, প্রতিশ্রুত সুখনিদ্রা, নিমগ্ন বালিশ
        পথ ছাড়ো জীবনযাপন ব্যথা, পথ করে দাও।
        আজ যাবো
        ঝিনাই নদীর জল হাঁটুতে কাপড় তুলে পার হবো
        মধ্যরাতে ডাক দেবো
        মা মাগো এসেছি আমি! সেই কবে গভীর নিশীথে
        তোমার নিমাইপুত্র ঘর ছেড়েছিল, আজ কাশী বৃন্দাবন
        তুলাধুনা করে ফের তোর দীর্ণ চৌকাঠে এসেছি।
        আমার কিছুই হলো না মা, লোকে বলে আমি ভীষণ নারাজ
        জীবনের তপ্ত গালে চুমু খেতে,
        আমি ভীতু জীবনের দ্রুতগাড়ি বৃদ্ধাঙ্গুলি তুলে কেন থামাতে পারি না,
        হিচহাইকিঙ করে কত লোক চলে গেলো দূরতম গন্তব্যে, তবুও
        আমি একা এখানে দাঁড়িয়ে আছি
        বাসভাড়া হয়েছে লোপাট অন্য কারো কলাবতী আঙুলের হাতে-
        তবু আমি বাড়ি যাবো, বাড়ি যাবো, বাড়ি
        এ বিশাল পৃথিবীতে এ মুহূর্তে অন্য কোন গন্তব্য তো নেই।
        পথ ছাড়ো অন্ধকার, পথ ছাড়ো দূরত্বের দূরগামী পথ
        বাড়ি যাবো, বাড়ি...

গৃহ প্রত্যাবর্তনের স্বপ্নময় ঘুম ভাঙল প্রত্যুষে। পাহড়ের মাথার উপর দিয়ে ভোরের লাল আভা ফুটছে। ট্রেন চট্টগ্রামের কাছাকাছি। যাত্রীদের সবাই তন্দ্রামগ্ন। পাহাড়তলী স্টেশনে কি কারণে যেন ট্রেন থেমেছে। আমি কাল বিলম্ব না করে নেমে পড়ি। চট্টগ্রাম স্টেশনে যদি কেউ ওও পেতে থাকে। তার চেয়ে এখানেই নেমে যাওয়া ভালো। পকেটে হাত দিলাম মোবাইল ফোনের খোঁজে। মার্গারেটকে আমার অবস্থা জানানো দরকার। একি! ফোন কোথায়? মনে পড়েছে। তাড়াতাড়ি ট্রেন ধরতে গিয়ে সাইফুলের সিএনজিতেই ফোন ফেলে এসেছি। দেখা হলে চেয়ে নিতে হবে। ফোন ছাড়া যোগাযোগের কথা চিন্তাও করা যায় না। এখন কি হবে? সব নম্বর তো ফোনে সেভ করা। কারও সঙ্গেই যোগাযোগ করা যাবে না।

এই ফোনহীনতাও হঠাৎ আনন্দময় মনে হলো। আহ! আনন্দের শ্বাস নিলাম লম্বা করে। আমি এখন পৃথিবীর সবচেয়ে মুক্ত মানুষ। কেউ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবে না; আমিও কাউকে পাবো না। আমি এক বিচ্ছিন্নজন। মুক্তির আমেজে স্টেশনের বাইরে পথে নেমে দেখি. ফজরের নামাজ শেষে কিছু লোক রাস্তায় নেমেছেন। মর্নিং ওয়াকার। দোকান পাট বিশেষ খোলে নি। রাস্তার মোড়ে একটি অস্থায়ী চায়ের দোকান পেয়ে দাঁড়ালাম। কিছু খেয়ে নেওয়া দরকার। দুপুরের পর আর বিশেষ কিছু খাওয়া হয় নি। সকালের খোলা হাওয়ায় চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে শরীর মন চাঙ্গা হয়ে উঠল।
আস্তে আস্তে জেগে উঠছে শহর। বন্দর নগরী মানেই ব্যবসা আর কাজের ঠিকানা। ক্রমেই হাঁক-ডাক বাড়ছে। আমার এখন কি কাজ? আমি কি করবো? একটানা দাঁড়িয়ে থাকলে মানুষের চোখে পড়ার আশঙ্কা। একটি হোটেলে রুম ভাড়া নিয়ে ক’ দিন ঘাপটি মেরে থাকা যায়। সেটাও খুঁজে পাওয়ার রিক্সের মধ্যে। আমাকে এখন ‘রান অ্যাণ্ড মুভ’ পলিসিতে চলতে হবে। আপাতত ছুটে বেড়াতে হবে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায়। পকেটে খুঁজে দেখলাম-দিন সাতেক চলার মতো রসদ আছে।

চট্টগ্রাম শহরে যাওয়ার জন্য ছোট ছোট টেম্পু চলছে। যাত্রীদের আঞ্চলিক ভাষায় ডাকাডাকি করছে কিশোর হেলপার। একটিতে চড়ে বসি। প্রথমত চট্টগ্রামের ভিড়ের মধ্যে আগে লুকাই। তারপর অন্য চিন্তা। আমি এখন ‘রান অ্যান্ড মুভ’-এর আওতায়।

টেম্পু এসে থেমেছে নিউ মার্কেটের সামনে। বেশ কিছু খাবার হোটেল খদ্দেরে পূর্ণ। একটি হোটেলে বসে ভালো করে নাস্তা সেরে নিলাম। নাস্তার পর চা খেতে খেতে ভাবলাম, চট্টগ্রাম থেকে দুই দিকে সরে যাওয়া যায়-পাহাড়ে বা সমুদ্রে। পাহাড়ের দিকে যেতে হলে রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি বা বান্দরবান যেতে হবে। সমুদ্রের পথ চলে গেছে কক্সবাজার, টেকনাফে। পাহাড় এখন কিছুটা বিপজ্জনক। বাঙালি-পাহাড়ি দ্বন্দ্বে উতপ্ত। আছে নানা রকমের গুপ্ত বাহিনীও। সে কারণে আইন-শৃঙ্খলার বেশি কড়াকড়ি। পাহাড়ে যাওয়া এখন নিরাপদ হবে না। তাহলে সমুদ্রই ডাকছে আমাকে।

কক্সবাজার পর্যন্ত গিয়ে দেখি জায়গার নামের সঙ্গে পরিবেশের দারুন মিল। পর্যটকদের বাজার জমে আছে। বাজারই বটে! এখানে লুকানোর জায়গা কোথায়? খোঁজ পাওয়া গেল, টেকনাফ হয়ে প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন যাওয়া যাবে। দুপুরের আগে রওয়ানা দিলে সেন্টমার্টিন যাওয়ার শেষ জাহাজ পাওয়া যাবে। তারপর পরের দিন দুপুরের আগে আর কোনও আসা-যাওয়ার জাহাজ নেই। অর্থাৎ বিকেলের পর থেকে সেন্টমার্টিনের সঙ্গে শুধু বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডই নয়, সারা পৃথিবীর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। আমি তো যোগাযোগহীনই থাকতে চাই। কেউ আমাকে পাবে না। আমিও কাউকে পাবো না। মজার লুকোচুরি হবে।

ড্রাইভার কথা রেখেছে। পাগলা ঘোড়ার মতো কখনও সমুদ্রের ধার দিয়ে, আবার কখনও অনুচ্চ পাহাড়ের কোল ঘেঁষে বাস যখন টেকনাফের ঘাটে এনে থামালো, তখন সেন্টমার্টিনের শেষ জাহাজ ছাড়ি ছাড়ি করছে। দৌড়ে জাহাজে উঠে এক কোণে বসে রইলাম। জাহাজে সাকুল্যে শত তিনেক যাত্রী হবে। অধিকাংশই স্টাডি ট্যুরের ছাত্র-ছাত্রী। কিছু আছে হানিমুন কাপল। সন্দেহজনক কোনও চেহারায় কাউকে চোখে পড়ল না। জাহাজ নাফ নদী ছেড়ে গভীর সমুদ্রে এলে আমি উঠে জাহাজের ডেকে এসে দাঁড়ালাম। কিছু সি-গাল আমাদের জাহাজের পিছু পিছু উড়ে উড়ে আবার ফিরে গিয়েছে তটরেখায়। পেছনে ক্রমশ মিলিয়ে যাচ্ছে টেকনাফের স্থলরেখা। পশ্চাতে টেকনাফ, বায়ে মায়ানমার আর ডানে কক্সবাজারকে রেখে জাহাজ গভীর সমুদ্র ভেঙে চলেছে সেন্টমার্টিন। বাতাসে নোনা টান। সূর্য ঝুলে গেছে পশ্চিম দিগন্তের দিকে। তাপহীন রোদের আলোয় ঝলমলে অতলান্ত নীল চারদিক থেকে ঘিরে ধরছে। সূর্যের চলে যাওয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বদলাচ্ছে আকাশের রঙ। চারদিকে খোলা আকাশে চলছে রঙের মাতাল খেলা। নীল সমুদ্রের বিশাল প্লেটে আকাশ থেকে চুঁইয়ে পড়ছে লাল আবীর। দিগন্তের কাছে সমুদ্রের গর্জনশীল জলরাশি লালে লাল। সূর্যাস্তের আগ-মুর্হূতে দেখা গেলো সেন্টমার্টিনের আবছা সবুজ। মাথা উঁচু নারকেল-সুপারি বীথির শরীরে রঙের আলতো ছোঁয়া রাতের আহ্বানে ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছে। হঠাৎ টুক করে সীমানাবিহীন সমুদ্রের বুকে ডুবে গেল ম্লান-লাল সূর্য। মনে হলো সমুদ্র আর আকাশের মিতালীতে রাতের কালো অন্ধকার গ্রাস করছে আমাদের পুরোটা জাহাজ। সন্ধ্যার বিগত আলো-আঁধারীর রহস্যময় চাদর জড়িয়ে জাহাজ সেন্টমার্টিনে ভিড়লো। প্রকৃতির আলো-ছায়ার আড়াল নিয়ে আমি মিশে গেলাম দ্বীপের গহীন নিঝুমে।  

বাংলাদেশ সময়: ১২৪৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ৭, ২০১৭
জেডএম/     

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।