ঢাকা, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

উপন্যাস

নীল উড়াল: ত্রিংশ পর্ব

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩৫৬ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৬, ২০১৭
নীল উড়াল: ত্রিংশ পর্ব নীল উড়াল

নায়ক ম্যাকগিল ভার্সিটির অধ্যাপক-লেখক-অভিবাসী বাংলাদেশি। ফরাসি সুন্দরী মার্গারেট সিমোনের প্রণোদনায় দেশে মাদকচক্র নিয়ে গবেষণাকালে ঘটনা মোড় নেয় রোমাঞ্চকর বাঁকে। আসে ধুরন্ধর বন্ধু-অসৎ ব্যবসায়ী এনামুল, সুন্দরী স্টাফ রোকসানা, মধুচক্রের জেনিফার-মলি-পরী, ক্লিনিকের অন্তরালের মিসেস খোন্দকার, রমনার শফি মামা ও ফুলি, ‘উড়াল যাত্রা’র সাইফুল, বিড়ালের কুতকুতে চোখের তরুণ সাংবাদিক ফরমানউল্লাহ এবং ছোটখালার রহস্যময় মেয়ে অন্তরা। প্রেম ও বেঁচে থাকার যুগল উড়ালে কাহিনী আবর্তিত হতে থাকে।

৩০.
অভিজাত এলাকায় খাসা অফিস সাজিয়েছে এনামুল। পয়সা থাকলে যা হয়।

আজকাল অফিসের জৌলুস দিয়ে অর্থ, বিত্ত, শক্তি, প্রতিপত্তি প্রদর্শন করা হয়। এনামুল নিজেকে দেখানোর কাজটি বেশ যুৎসই ভাবেই করেছে। ওর অফিসে এলে যে কারও মাথা ঘুরে যাবে। ঢুকতেই উর্দি পরা সশস্ত্র গার্ড। মেটাল ডিটেক্টর। আর্চওয়ে গেট। নিরাপত্তার নিশ্চিদ্র ব্যবস্থা। তারপর লম্বা ফ্লোর জুড়ে সাজানো অফিস। কাঁচের ছোট ছোট কেবিন। ঝলমলে আলোর বাহারী বিন্যাসে দেখা যাচ্ছে দেওয়ালে টাঙানো দামি পেইনটিং। কয়েকজন সাদা চামড়ার বিদেশিকেও দেখা গেলো।

নীল উড়াল: ঊনত্রিংশ পর্ব

এনামুলের ব্যবসা দেশ-বিদেশে ছড়ানো। কত ধরনের লোক ওর প্রয়োজন হয়। আজকাল দেশের চেয়ে বিদেশ থেকেই ব্যবসা আসে বেশি। আর্থিক দুর্নীতির প্রলোভন ও প্ররোচনা বিদেশিরাই দিতে পারে ভালো।

কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, পশ্চিমা কোম্পানিগুলো অপ্রয়োজনীয় প্রজেক্ট ও সরঞ্জামাদি বিক্রি করার জন্য বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তাদের তদবির করে এবং লোভ দেখায়। এই কেনাকাটার টাকার ব্যবস্থা করা হয় পশ্চিমা কোনও দাতাসংস্থার ‘উন্নয়ন সহায়তার’ তহবিল থেকে। এভাবে দেশি-বিদেশি স্বার্থের সমন্বিত কর্মকাণ্ডের ফলে অপ্রয়োজনীয় উন্নয়ন প্রকল্পের নামে সহায়তার টাকা এনে সেটা ভাগ-বাটোয়ারা করা হয়। দুর্নীতির সংস্কৃতিকে চালু রাখার জন্য দেশি ও বিদেশি পার্টির মধ্যে দেন-দরবার ও যোগাযোগের কাজটি করে এনামুল এবং তার মতো নব্য লুটেরাদের প্রতিষ্ঠান।


এনামুল বসেছে ফ্লোরের শেষ মাথায়। আড়াআড়ি একটি বড় ঘরে। তার সামনে ফুটবল খেলার মাঠের মতো বিশাল গ্লাস-কাট টেবিল। নানা রঙের কয়েকটি টেলিফোন, এলসিডি টিভি, ল্যাপটপ, ফ্রিজ দিয়ে অত্যাধুনিকভাবে সাজানো চেম্বার। দুর্নীতি, রাজনীতি, ক্ষমতা ব্যবহারের মাধ্যমে অবৈধ উপার্জনের চিত্রটি লুকিয়ে রাখে নি সে। জমি দখল, নদী দখল, চিংড়ি ঘের দখল, জাহাজ ভাঙা, মাদক দ্রব্য পাচার, স্মাগলিং ইত্যাদি কোনও ক্ষেত্রই নেই তার হাতের বাইরে। যেখানে টাকা ও লাভের হাতছানি সেখানেই এনামুল। ব্যবসাকে ধরে রাখতে সে আমর্স, সেক্স, ক্রাইম, পাওয়ার সব কিছুকেই সঙ্গে রেখেছে। বাংলাদেশের বৈধ-অবৈধ সুযোগ-সুবিধাগুলোকে হজম করার ক্ষমতা এনামুলে কুক্ষিগত।

রোকসানা আমাদেরকে এনামুলে চেম্বারে নিয়ে গেলো। এনামুল আমাদের জন্যই অপেক্ষা করছিলো। অতি আন্তরিকভাবে রিসিভ করতে সে তার দামি ও আরামদায়ক গদিওয়ালা চেয়ার ছেড়ে দরজার কাছে এগিয়ে এসে বললো:
-শেষ পর্যন্ত এলে বন্ধু গরিবের ঘরে!

এটা রসিকতা নয়, টিটকারি। ক্ষমতা ও শক্তির দম্ভ। আমি কোনও উত্তর দিলাম না। মার্গারেটও নিশ্চুপ। আমরা নিঃশব্দে চেয়ার টেনে বসি। আগ বাড়িয়ে কথা বলার দরকার নেই। এনামুল ডেকেছে, কেন ডেকেছে, সে-ই বলুক। আগে ওর মতলব বুঝি, তারপর না হয় উত্তর দেওয়া যাবে। ফালতু কথায় সময় নষ্ট করে কি দরকার! আমি হাতের ঘড়ির দিকে তাকালাম। আকারে-ইঙ্গিতে বোঝালাম, আমার তাড়া আছে, তোমার যা বলবার, তাড়াতাড়ি বলো।

আমার ইঙ্গিতে কাজ হলো। এনামুল ঠিকই ধরতে পেরেছে, আমি কি চাই। আমি বাজে প্যাঁচাল না করে সরাসরি কাজের কথায় আসতে চাই। সঙ্গে সঙ্গে এনামুল আমাদের দিক থেকে রোকসানার দিকে মুখ ফিরিয়ে বললো:
-দাঁড়িয়ে আছো কেন, খাবারের ব্যবস্থা করো। দামি খাবার। আমার অতি গুরুত্বপূর্ণ বন্ধু তার একান্ত বান্ধবীকে নিয়ে এসেছে। যাও যাও...।

এবারও এনামুল টিটকারি মেরে কথা বললো। আমরা তার কথা গ্রাহ্য করার কোনও কারণ দেখি না। এনামুলের তাড়া খেয়ে রোকসানা লাঞ্চের ব্যবস্থা করতে রুম থেকে বের হয়ে গেল।

এনামুল এখনও কাজের কথায় আসছে না। এটা ওটা অপ্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে রঙ্গ-রসিকতা করছে। করবেই তো। আমরা এখন ওর সামনে, ও যেভাবে খুশি খেলিয়ে নেবে। যেমন ইচ্ছা নিক। কোনও ক্ষতি নেই। আমি জানি, খেলার সবচেয়ে দামি কার্ডটি আমার হাতে। আসল চাল আমিই দেবো। এনামুল তার অভ্যাস মতোই  হাল্কা চালে কথা চালিয়ে যাচ্ছে। এর মানে খেয়ে-দেয়ে নে ব্যাটা, তারপর তোকে ধরবো। উৎকণ্ঠা বাড়িয়ে আমাদের নার্ভের উপর চাপ দিয়ে আগেই কাবু করে রাখার প্ল্যানও থাকতে পারে তার। থাকুক। আমরা নির্বিকার ও ভাবলেশহীন থাকলেই হলো। ওর অস্ত্র ওর দিকেই বুমেরাং-এর মতো ফিরে যাবে। উল্টো সে-ই উত্তেজিত হয়ে ভুল কদম ফেলে আমাদের সুবিধা করে দেবে।

বেশিক্ষণ উদ্দেশ্যহীন কথায় মগ্ন থাকতে পারলো না এনামুল। রোকসানা এসে জানালো, ‘লাঞ্চ রেডি। পাশের কনফারেন্স রুমে খাবার সাজানো হয়েছে। ’ খাবার মানে যথেচ্ছ আয়োজন। ওয়েস্ট ইনের সম্ভ্রান্ত খাবার। এনামুলের চাপাচাপির পরেও আমি খুব সামান্যই খেলাম। মার্গারেট নাম কা ওয়াস্তে সঙ্গ দিল। বিশেষ কিছু মুখে নিল বলে মনে হলো।
খাওয়ার শেষে এনামুল নাটকীয় ভঙ্গিতে রোকসানাকে বললো:
-মিস মার্গারেটকে নিয়ে তুমি তোমার রুমে অপেক্ষা করো। ঠিক তিরিশ মিনিট পর আসবে। এর মধ্যে আমার রুমে কাউকে আসতে দেবে না। আমরা দুই বন্ধু একান্তে কিছু কথা বললো।
একই নাটকীয়তায় মার্গারেটের দিকে চেয়ে বললো:
-প্লিজ ম্যাডাম। জাস্ট আধ-ঘণ্টা। কিছু মনে করবেন না। একটু কষ্ট করে অপেক্ষা করুন।

কাউকে কিছু কথা বলার সুযোগ না দিয়ে এনামুল আমার হাত ধরে টেনে ওর চেম্বারে চলে এলো। এসেই রুমে দরজা বন্ধ করে দিল। এখন রুমে শুধু এনামুল আর আমি। আমি কিছুটা বিরক্তই হলাম:
-কি ব্যাপার এনামুল? আমরা এক সঙ্গে এসেছি, মার্গারেটকে আলাদা করলি কেন?
এনামুল মিটিমিটি হেসে বললো:
-দরকার আছে। ও তুই বুঝবি না। বিজনেস সিক্রেট। কোনও টেনশন করবি না। তিরিশ মিনিটেই কথা শেষ হয়ে যাবে। তারপর তোর মার্গারেট আবার তোরই হবে।

একটা বিশ্রী রকমের কুৎসিত হাসি হাসলো এনামুল। আমার গা ঘিন ঘিন করে উঠল। ওকে প্রচণ্ড ঘৃণা করতে ইচ্ছা করছে। এনামুল আমার মনোভাব বুঝলো। কিন্তু সে সেটা আমল দিল না। আমাকে চেয়ারে বসিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে বললো:
-আয়, কথা শুরুর আগে একটি সিনেমা দেখে নিই।
আমি রাগ চেপে রাখতে পারলাম না। রাগত স্বরেই বলি:
-এসব কি হচ্ছে, সিনেমা দেখার জন্য আমি এসেছি?
সে নির্বিকার ভাবে বললো:
-তা আসিস নি। তবে দেখা ভালো।

ড্রয়ার থেকে একটি সিডি বের করে টিভিতে প্লেস করতে করতে সে আরও বললো:
-দেখ, আমি সিনেমা কেন-ধর্ম, সেক্স, পলিটিক্স নিয়েও কথা বলি না।
সে ঘাঁড় ফিরিয়ে আমার বিস্মিত চেহারা দেখে বলতেই লাগলো:
-কেন বলি না জানিস? ধর্ম পবিত্র ব্যাপার, আমার মতো পাপীর মুখে মানায় না। সেক্স লুকিয়ে রাখলেও সবাই করে, এটা বলার মতো কিছু নয়। আর পলিটিক্স? এর মধ্যে কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা বুঝার উপায় নেই। অতএব বলা বিপদজ্জনক। তাহলে আমি কি বলি? আমি বলি ব্যবসার কথা। ব্যবসা ছাড়া অন্য কোনও কথা আমার কাছে নেই। এই যে ছবি দেখছি, এটাও আসলে ব্যবসার মধ্যেই আছি। ব্যবসা ছাড়া আমার জগতে আর কিছু নেই।
টিভি চালাতে চালাতে সে বললো:
-এই সিনেমাও ব্যবসার বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। দেখ। দেখ।

এনামুল ঘর অন্ধকার করে দিল। আস্তে আস্তে টিভি পর্দায় আলো ফুটে উঠল।
আমি মুখ হা করে দেখলাম, পর্দায় আমাকে আর রোকসানাকে দেখা যাচ্ছে। সেদিন ভোর-সকালে অফিস যাওয়ার পথে রোকসানা আমার ফ্ল্যাটে এসেছিল, গোপন ক্যামেরায় পুরো ঘটনাটিই ধারণ করা হয়েছে। আমি আর দেখতে পারছি না। টেবিলে রাখা রিমোর্ট হাতে নিয়ে টিভি বন্ধ করে দিলাম।
এনামুল অবাক হওয়ার ভান করলো:
-কি রে! ভালো লাগছে না? বন্ধ করে দিলি যে! আমার তো বেশ ভালো লাগছে। এডাল্ট ফিল্মের আমেজ পাচ্ছি।

আমি কোনও কথা বলতে পারছি না। বোবা হয়ে গেছি মনে হলো। ষড়যন্ত্রেরও একটা সীমা আছে। এনামুল কোনও সীমা বা নিয়মই মানছে না।
আমার মৌনতায় বিচলিত না হয়ে সে বললো:
-দেখলি, আমার কাণ্ড জ্ঞান কতো প্রখর। ব্যবসা করলেও বন্ধুর ইজ্জত বুঝি। তোর বিদেশি বান্ধবীকে বুদ্ধি করে সরিয়ে দিলাম। তোর স্বার্থ আমার চেয়ে ভালো কে দেখবে বল!

ভণ্ডামী আর কাকে বলে? ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে কুরুচিপূর্ণ ষড়যন্ত্রের পর ব্যাটা ভণ্ডামী করছে। ওর কথায় কান না দিয়ে আমি ঝিম মেরে আছি। তাহলে কি সেই সকালের ব্যাপারটা পূর্ব-পরিকল্পিত। সাজানো। রোকসানার অভিনয়। অবশেষে আমি মুখ খুলি:
-এই ছবির কথা রোকসানা জানে?           
এনামুল উত্তর দিতে দেরি করলো না:
-পাগল হয়েছিস নাকি? সব কথা ও জানলে আমার চাকরি করবে সে? করবে না। আমাকেই উল্টা ওর চাকরি করতে হবে। আমি সবার সব কথা জানবো। আমার সব কিছু অন্যরা জানবে না। তাহলেই তো মানুষকে খাটাতে পারবো। ব্যবসাও করতে পারবো।
আমি দৃঢ়ভাবে জানতে চাই:
-এসবের মানে কি? আমাকে ফাঁসাতে চাস বুঝলাম। মেয়েটি তোর লোক। ওকেও কেন ফাঁদে ফেলেছিস? আমাকে আটকানোর জন্য ওকে নোংরাভাবে ব্যবহার করছিস কেন?
এনামুল বললো:
-সবাইকেই আটকে রাখতে হয় রে। ধরা না থাকলে কেউই কথা শুনতে চায়? এটা হলো ধরাধরির দুনিয়া।

হট্টহাসিতে ফেটে পড়ল এনামুল। আমি প্রসঙ্গ পাল্টে প্রশ্ন করি:
-কি চাস তুই? আমাকে ব্ল্যাকমেল...।
কথা শেষ করতে পারি নি। এনামুল থামিয়ে দিয়ে বললো:
-এসব তুচ্ছ অভিযোগ আমাকে করবি না। ওসব কাজের আলাদা লোক আছে আমার। আসলে ব্লাকমেল, খুন-খারাবি-রক্তপাত আমার ধাঁতে সয় না। আমি ওগুলো অন্যকে দিয়ে করাই। এই দেখ...

এনামুল ওর হাত আমার চোখের সামনে বাড়িয়ে বললো:
-আমার হাতে কোনও অপরাধের কালো দাগ, রক্তের লাল দাগ নেই। পরিষ্কার হাত। সরকার বদলাবে, ক্ষমতা বদলাবে  আমার কিছু হবে না। আমি নিজেকে সব সময় সাফ-সুরত রাখি।
আমি ওর হাত সরিয়ে বলি:
-তাহলে কি চাস?
এনামুল চেয়ার টেনে  টান টান হয়ে বসলো। আমার মুখোমুখি হয়ে স্পষ্ট ভাষায় বললো:
-তোকে ফিল্ম দেখিয়ে এটাই জানাচ্ছি যে, তোর গতিবিধির সকল খবর আমাদের নখ দর্পণে। তোর গবেষণায় পাওয়া সকল তথ্য আমার চাই। তুই এ বিষয়ে আর কিছুই বলবি না, লিখবি না।
আমি জিজ্ঞেস করি:
-কেন?
সে বলে:
-কারণ বাংলাদেশের ক্ষমতার শীর্ষে বহু দানব-মানুষ আছে, যারা ভদ্র মুখোশ এঁটে বসে আছে। কেউ তাদের আসল চেহারা চিনতে পারছে না। কোনও দিন পারবেও না। ওরা তাদের মুখোশ রক্ষা করার জন্য এক কথায় এক শ’ খুন করতে পারে। তুই তাদের মুখোশ ধরে টানাটানি করছিস।
আমি সোজাসাপ্টা বলি:  
-আমি তো ব্যক্তিগতভাবে কাউকে কিছু বলছি না। আমার লড়াই সিস্টেমের বিরুদ্ধে...।
যেন অত কথা শোনার সময় এনামুলের নেই। আমাকে থামিয়ে দিয়ে কর্কশ কণ্ঠে বললো:
-এসব ব্যক্তি আর সিস্টেমের প্যাঁচে কাজ হবে না। পুরো সিস্টেম এখন তোর বিরুদ্ধে। সিস্টেমের প্রতিটি ব্যক্তি এখন তোর শত্রু। তুই ওয়ান ম্যান আর্মি হয়ে সবার বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারবি না। বেঘোরে মারা যাবি।

আমি আর সহ্য করতে পারছি না। রাগে বলেই ফেলি:
-তাহলে মারছে না কেন? মেরে ফেলুক আমাকে। লেটা চুঁকে যাক। অবশ্য সে চেষ্টা করেও সফল হয় নি।
আমি সেমিনারে পর গুলি করার বিষয়টি ইঙ্গিত করে এনামুলের অভিব্যক্তি দেখার জন্য ওর মুখের দিকে তাকালাম। সে কোনও রাখ-ঢাক না করেই বললো:
-ব্যর্থতার প্রশ্নই আসে না। আরও তিনটি টিম স্ট্যান্ড বাই ছিল। তোকে মারার হলে মেরে ফেলা যেতো। ভয় দেখানোর দরকার ছিল। সেটাই করা হয়েছে।  
আমি জানতে চাই:
-ভয় দেখানোর ঝামেলা কেন-সরাসরি খতম করে আমার মতো তুচ্ছ প্রতিপক্ষকে সরিয়ে দিলেই হয়!
এনামুল হাসলো। তারপর স্পষ্টভাবে বললো:
-না, এটা সম্ভব নয়। কারণ তোর সঙ্গে এসে জুটেছে একটি বিদেশি মেয়ে এবং তার আন্তর্জাতিক সংস্থা। তোকে হত্যা করা হলেও সব তথ্য ওদের মাধ্যমে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে যেতে পারে। সেটা করা যাবে না। অতএব তোকে বাঁচিয়ে রেখে সব তথ্য আদায় করতে হবে।
আমি এবার একটু কঠিন স্বরেই বলি:
-যদি না দিই।
এনামুল আরও কঠিন গলায় বললো:
-তখন কি হবে জানি না। সব সিদ্ধান্ত আমার একার উপর নির্ভর করে না। তবে আমার মনে হয়, শেষ পর্যন্ত তোকে সমঝোতা করতেই হবে। নইলে স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকতে পারবি না। তোর জীবন অতিষ্ঠ হয়ে যাবে এবং এক পর্যায়ে তোর ভবলীলাও সাঙ্গ হবে।
আমি স্থির থাকতে না পেরে জোরালো কণ্ঠে জানতে চাই:
-তুই কি আমাকে হুমকি দিচ্ছিস?
এনামুল এখন অনেক শীতল। স্বাভাবিক গলায় বললো:
-না, না, হুমকি, ব্ল্যাকমেল-এসব এখন আর চলবে না। এখন অ্যাকশন শুরু হয়ে গেছে। ডাইরেক্ট অ্যাকশন। সমঝোতা কর অথবা যুদ্ধে অবতীর্ণ হ। আজকের পর আমি আর তোর কোনও দায়িত্ব নিতে পারবো না। আমাদের হয়ত আর দেখাও হবে না। আমরা তখন দুই ক্যাম্পে থাকবো।

এনামুলের এতো নির্মম কথার উত্তর আমি দিতে পারছি না। সে আমার নিরবতার সুযোগে বললো:
-আমাকে না বলে আমার ফ্ল্যাট থেকে চলে গেছিস। গবেষণা, তথ্য সংগ্রহ, সেমিনার করলি-আমি কিছুই বলি নি। এখনও সময় আছে, আমার কথা মেনে নে, তোকে উপযুক্ত টাকা বিনিময় হিসাবে দেওয়া হবে। ডলারে পেমেন্ট চাইলে সেটাও পাবি। যদি নাম কামাতে চাস তো কিছু পুরস্কারের ব্যবস্থাও করে দেবো। তোকে কোলে করে কানাডায় পৌঁছেও দেবো। আর কি চাস, বল, পাবি।
আমি ঘৃণা ভরে বলি:
-আমার কিচ্ছু চাই না। আপাতত এখান থেকে চলে যেতে চাই। তোর মতো অতি নিকৃষ্ট একজন আমার বন্ধু ছিল, ভাবতেও আমার বমি হচ্ছে।

আমি চেয়ার ছেড়ে উঠার উপক্রম করতেই এনামুল আমাকে বসিয়ে দিয়ে বললো:
-‘ছিল’ বলছিস কেন? বন্ধু এখনও আছি এবং থাকবো। তবে আমরা একই পক্ষে থাকবো না, এটাই সমস্যা। শোন তোকে একটি কবিতা শোনাই। জানিস তো, কুকুরের কাছ থেকেও প্রভুভক্তি, পাহারাদারি এমন এমন আঠারোটি বিষয় মানুষ শিখতে পারে। আমার কাছ থেকেও না হয় একটি কবিতা শিখলি!

ঠাট্টার হাসি হাসতে আসতে কথাগুলো বললো এনামুল। তারপর ছাত্রজীবনের মতো ভরাট গলায় আবৃত্তি করলো। আহা, কি ছিল যৌবনে, ত্যাগী, আদর্শবাদী, সংস্কৃতিবান! আর আজ? ওর জন্য আমার খুব কষ্ট হচ্ছে এখন।

এনামুল পড়ছে:
    দুঃখ হলো এক গিটার যে বাদকের আঙুল কেটে
    নিজের তারে বাধার পরীক্ষা করে;
    সুখ এমন বাড়িঅলা, ঘর খালি নেই তবু টু লেট
    নামায় না; দুঃসময় এমন বিরাট গেট
    যার ভেতর দিয়ে দেখা যায় বন্ধুর আসল মুখ;
    আর প্রেম হলো এমন বালিশ, মাঝেমাঝে
    যাকে খাওয়াতে হয় রোদের আদর, না হলে
    দুর্গন্ধ ছোটে; আর বিরহ একটি ফেলে যাওয়া সুটকেস
    যার চাবি চলে গেছে মালিকের সাথে, ডুপ্লিকেট নেই...

এনামুল আবৃত্তি থামিয়ে জড়ানো কণ্ঠে বললো::
-অনেক বড় কবিতা। পুরোটা মনে নেই।
ওর মুখ ম্লান। কার জন্য ম্লান? পুরোনো কবিতার নাকি শত্রু হয়ে যাওয়া বন্ধুর জন্য? নাকি অন্য কারও জন্য? কে জানে!

বাংলাদেশ সময়: ০৯৫০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৬, ২০১৭
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।