ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

দ্য প্রেস্টিজ: মর্যাদার লড়াই | মোস্তাফিজ ফরায়েজী

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪৩৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৫, ২০১৭
দ্য প্রেস্টিজ: মর্যাদার লড়াই | মোস্তাফিজ ফরায়েজী দ্য প্রেস্টিজ: মর্যাদার লড়াই | মোস্তাফিজ ফরায়েজী

প্রতিযোগিতা শব্দটা যতোটা সহজ কার্যত তা অতো সহজ নয়। প্রতিযোগিতায় প্রতিদ্বন্দ্বীরা যদি হয় তীব্র প্রত্যয়ী তবে সেই প্রতিযোগিতা হয়ে উঠবে কঠিন ও আকর্ষণীয়। কোনো কিছু লাভ করার আকাঙ্ক্ষা প্রতিযোগীকে করে তোলে নেশাগ্রস্ত, ক্ষীপ্র। চলচ্চিত্রও তেমনি একটি প্রতিযোগিতার লড়াই।
 

একটি সিনেমার পর্দা ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। তার প্রতিদ্বন্দ্বী বর্তমান, অতীত কিংবা ভবিষ্যতের সব সিনেমা।

এখানে কোনটি টিকবে আর কোনটি হারিয়ে যাবে সেটা নির্ভর করে সিনেমাটির শক্তির উপর। একটি চলচ্চিত্র মানব মনকে কতটুকু আন্দোলিত করতে পারে সেটা মূলত চলচ্চিত্রের নির্মাণশৈলী ও অভিনয়ের উপর নির্ভর করে। তাই এই প্রতিযোগিতাময় চলচ্চিত্র ভুবনে সবাই সমান প্রাপ্তি পায় না।

ক্রিস্টোফার নোলান চলচ্চিত্র ভুবনে এক ভিনগ্রহবাসীর নাম। তিনি যেখানে হাত দিয়েছেন সেখান থেকেই তিনি এমন কিছু বের করে নিয়ে এসেছেন, যা দেখে দর্শকরা অবাক হয়েছে, সিনেমা আলোচকরা প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছে, অনেকটা ম্যাজিকের মতো। এই ক্রিস্টোফার নোলানই ২০০৬ সালে একটি রহস্যময় রোমাঞ্চকর সিনেমা আমাদের উপহার দেন, সেটি হলো ‘দ্য প্রেস্টিজ’।
 
দ্য প্রেস্টিজ একটি ব্রিটিশ-আমেরিকান চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রটির কাহিনী প্রকৃতপক্ষে সাধারণ হলেও এর গল্প বলার ঢং ব্যতিক্রম। ক্রিস্টোফার নোলানের ‘মেমেন্টো’ অবলম্বনে মুরুগাদসের ‘গজনি’ দেখলে স্পষ্ট বুঝতে পারবে, দৃশ্যপট সজ্জার গুরুত্ব। কীভাবে একটি গল্পকে শুধুমাত্র দৃশ্যপট সজ্জা করে আরও আকর্ষণীয় করা যায় সেটা মেমেন্টো দেখলেই বোঝা যাবে। দৃশ্যপট সজ্জার কাজটি নোলান খুব দক্ষতার সঙ্গে করতে পারেন। ইনসেপশন ও দ্য প্রেস্টিজ সিনেমা দু’টিতেও এটির ব্যবহার দেখা যায়। এক কথায় নোলানের গল্প বলার ধরনই আলাদা।
 
দ্য প্রেস্টিজ সিনেমাটি ম্যাজিক নির্ভর, এর কাহিনী আবর্তিত হয়েছে দু'জন ম্যাজিশিয়ান রবার্ট অ্যানজিয়ার ও আলফ্রেড বরডেনের মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে কেন্দ্র করে। এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব থেকে, তবে ধীরে ধীরে প্রকাশিত হতে থাকে তাদের মনের আকাঙ্ক্ষা। একসময় তাদের প্রতিযোগিতা জীবন নিয়ে খেলতে থাকে। ম্যাজিক নিয়ে খেলতে গিয়ে শেষপর্যন্ত পুরো সিনেমাটিই একটি ম্যাজিকে পরিণত হয়।
 
শুরুতেই দেখা যায় বরডেনের বাচ্চা মেয়ের সঙ্গে জন কাটার ম্যাজিক বিষয়ক আলোচনায় মগ্ন। সে তাকে শেখাতে থাকে ম্যাজিকের একটি সাধারণ তত্ত্ব। প্রতিটি ম্যাজিকের তিনটি অংশ থাকে- ১. দ্য প্লেজ ২. দ্য টার্ন ও ৩. দ্য প্রেস্টিজ। দ্য প্রেস্টিজ ধাপটা ম্যাজিকের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কেননা এই ধাপেই হারিয়ে যাওয়া কোনোকিছু ফিরিয়ে আনা হয়। দ্য প্রেস্টিজের জন্যই দর্শকরা অবাক হয়, হাততালি দেয়।
 
এর পরেই ঘটতে থাকে নানান ঘটনা। কাহিনী বিন্যাসে তিনটি বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে: বর্তমান, স্মৃতি ও ডায়েরি। বিষয় তিনটি দ্য প্রেস্টিজ চলচ্চিত্রে বিক্ষিপ্তভাবে এসেছে। এই বিক্ষিপ্ততাই চলচ্চিত্রটিকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে।
 
বর্তমানে দেখানো হয়েছে অ্যানজিয়ারকে হত্যার অভিযোগে বরডেনের বিচার। শেষপর্যন্ত বরডেনের ফাঁসির আদেশ হয়। কিন্তু ধীরে ধীরে খোলসা হতে থাকে এক সত্য, অ্যানজিয়ার জীবিত। একই সঙ্গে একটি মানুষ জীবিত এবং মৃত কীভাবে থাকতে পারে? কীভাবেই-বা পুরো সিনেমার জট খুলে যায় শেষ মুহূর্তে?
 
স্মৃতি ও ডায়েরিতে মূলত তাদের অতীত উঠে আসে। যেখানে একটি ভুলের জন্য বরডেন অ্যানজিয়ারের স্ত্রীকে হত্যার দায়ে দায়গ্রস্ত। প্রতিশোধ পরায়ণ অ্যানজিয়ার বরডেনকে শাস্তি দেওয়ার জন্য উতলা হয়ে ওঠে। কিন্তু কিছু সময় পরেই প্রতিশোধ নয় প্রতিযোগিতাই তাদের দ্বন্দ্বের মূল বিষয়ে পরিণত হয়। কে কতো বড় ম্যাজিশিয়ান এটা প্রমাণের নেশায় মত্ত হয়ে ওঠে দু’জনে। প্রতিযোগিতা তীব্র হয়ে ওঠে যখন বরডেন একটি নতুন ম্যাজিকের কৌশল নিয়ে হাজির হয়। অ্যানজিয়ার সেই কৌশল নকল করে তার ‘দ্য গ্রেট ডানটন’ ম্যাজিক শো করতে থাকে। তবে এক তীব্র মানসিক অতৃপ্তি তাকে কুরে কুরে খায়, কেননা ম্যাজিকের প্রেস্টিজে সে অনুপস্থিত। তার ধারণা, বরডেন এমন এক কৌশল পেয়েছে যাতে করে সে প্রেস্টিজের স্বাদও পেয়ে থাকে। তার এই ভুল ধারণাই তাকে বিজ্ঞানী টেসলার কাছে নিয়ে যায়। টেসলা অ্যানজিয়ারকে এমন এক যন্ত্র বানিয়ে দেয় যা দিয়ে যেকোনো কিছুর ডুপ্লিকেট বানানো সম্ভব।
 
চলচ্চিত্রটিতে তিনটি নারী চরিত্রের ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। একটি অ্যানজিয়ারের স্ত্রী জুলিয়া, তার সহযোগী ও প্রেমিকা অলিভিয়া এবং বরডেনের স্ত্রী সারাহ বরডেন। সিনেমাটিতে এই তিনজন নারীর প্রভাব অনস্বীকার্য। আবার জন কাটারের উপস্থিতি সবাইকে মনোযোগী করে তুলবে। ফ্যালোন চরিত্রটিকে পুরো সিনেমাজুড়ে সবাই অগ্রাহ্য করলেও, শেষ মুহূর্তে ফ্যালোনই হয়ে উঠবে সিনেমাটির মূল চরিত্র।
 
ক্রিস্টোফার প্রিস্টের উপন্যাস অবলম্বনে সিনেমাটির চিত্রনাট্য রচনা করেন জোনাথল নোলান ও ক্রিস্টোফার নোলান। সিনেমাটিতে মিউজিক দিয়েছেন ডেভিড জুলিয়ান। সিনেমাটি অ্যানজিয়ার ও বরডেন চরিত্রে অভিনয় করেছেন বর্তমান সময়ে হলিউডের দু’জন প্রসিদ্ধ অভিনেতা হিউ জ্যাকম্যান এবং ক্রিস্টিয়ান বেল। এছাড়া বরাবরের মতো মাইকেল কেইন জন কাটার চরিত্রে তার দারুণ অভিনয় দক্ষতা দেখিয়েছেন।
 
সিনেমাটির মূল আকর্ষণ এর কাহিনীজট কিংবা টুইস্ট। প্রতি মুহূর্তে এমন এক টুইস্টের অবতারণার চেষ্টা চলেছে যা অগ্রাহ্য করেই দর্শক সিনেমাটি উপভোগ করতে থাকবে। তবে একটি নির্দিষ্ট মুহূর্তে চমকে উঠতে হবে সবাইকে, কেননা এই টুইস্ট প্রতিদ্বন্দ্বিতার মোড়ক থেকে আমাদেরকে বের করে ম্যাজিকের জগতে ফেলবে।

সিনেমাটির প্রেস্টিজ হচ্ছে কাহিনীজটের গ্রন্থিমোচন। যেহেতু পুরো সিনেমাটিই একটি ম্যাজিক সেহেতু এখানে দ্য প্রেস্টিজ লুকিয়ে রাখার সুযোগ নেই। তাইতো ক্রিস্টোফার নোলান সিনেমাটির দ্য প্রেস্টিজ অংশটুকু শেষমুহূর্তে দর্শকের সামনে উন্মোচন করেছেন। এই প্রেস্টিজ দেখে কেউ হাত তালি দেবে, কেউ আবেগে আপ্লুত হবে, কেউ বা ম্যাজিশিয়ানদের বিসর্জন ও সংগ্রামের কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়বে।
 
বাংলাদেশ সময়: ১০৩৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৫, ২০১৭
এসএনএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।