ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

ভোটের-কথা

খুলনা-৫ আসন

আ’লীগে দ্বন্দ্ব, বিএনপি-জামায়াতে দূরত্ব

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫১৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২০, ২০১৮
আ’লীগে দ্বন্দ্ব, বিএনপি-জামায়াতে দূরত্ব খুলনা-৫ আসনে বিভিন্ন দলের মনোনয়নপ্রত্যাশীরা

খুলনা: আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে খুলনা-৫ আসনে বইছে নির্বাচনী হাওয়া। ডুমুরিয়া ও ফুলতলা উপজেলা নিয়ে গঠিত এ আসন। আসনটিতে আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে রয়েছে দ্বন্দ্ব। আর মনোনয়ন নিয়ে দূরত্ব দেখা যাচ্ছে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে।

আসনে জয় নিশ্চিতে যেমন আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব নিরসনের কথা বলা হচ্ছে, তেমনি বলা হচ্ছে মনোনয়ন নিয়ে জোট শরিক বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে সমঝোতার কথাও। অবশ্য, আওয়ামী লীগের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত এ আসনটিতে জামায়াতের উপস্থিতি থাকলেও বিএনপির দাবি, জামায়াতের সেই অবস্থান এখন আর নেই।

 

এ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীরা হলেন- ডুমুরিয়া উপজেলা সভাপতি মত্স্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী এবং বর্তমান সংসদ সদস্য নারায়ণ চন্দ্র চন্দ, গুটুদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান এবং খুলনা থেকে প্রকাশিত দৈনিক প্রবর্তনের সম্পাদক মোস্তফা সরোয়ার, বঙ্গবন্ধু পরিষদের খুলনা জেলা সহ-সভাপতি প্রফেসর ড. মাহাবুব উল ইসলাম এবং ফুলতলা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শেখ আকরাম হোসেন।  

মন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্রের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ রয়েছে তার বিরোধীদের। যেমন, ২০১৭ সালে এফসিডিআই প্রকল্পের আওতায় নারায়ণ চন্দ্র চন্দ খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলায় দুস্থদের মধ্যে ছাগল, হাঁস ও মুরগি বিতরণ করেন। সেই ছাগলগুলো রাতেই মারা যায়। ছাগল মরার প্রতিবেদন ফেসবুকে শেয়ার করে আইসিটি আইনের ৫৭ ধারায় আটক হন সাংবাদিক আব্দুল লতিফ। যা সারা দেশব্যাপী আলোচনার ঝড় তোলে।  

একই বছর খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলায় নারায়ণ চন্দ্র চন্দের বাড়িতে এক স্কুলশিক্ষককে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার অভিযোগ উঠেছিল। শেখ আনিচুর রহমান নামে ওই শিক্ষক সে ঘটনায় স্থানীয় শোভনা ইউপির চেয়ারম্যান সুরঞ্জিত বৈদ্যের বিরুদ্ধে ডুমুরিয়া থানায় লিখিত অভিযোগ দেন।

২০১৪ সালে খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার সরকারি ২১০টি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ রেখে তৎকালীন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। আর উপহার হিসেবে দেওয়া হয় রূপার তৈরি নৌকা। যা সেই সময় ব্যাপক আলোচিত হয়।  

এছাড়া বিএনপি নেতা ড. মামুন রহমানের অভিযোগ, তার কাছে মন্ত্রীর বিরুদ্ধে টাকার বিনিময়ে চাকরিতে নিয়োগের অভিযোগ করেছেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতারা।  

নিজের নির্বাচনী এলাকার অধিকাংশ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ও নেতাদের সঙ্গেও রয়েছে নারায়ণ চন্দের দ্বন্দ্ব।  

২০১৪ পুলিশের তালিকাভুক্ত চরমপন্থি নেতা শিপলু ভূঁইয়াকে দলে যোগদান করানোর পর ইউপি নির্বাচনে তাকে নৌকা প্রতীক পাইয়ে দেওয়ায় নারায়ণ চন্দ্রের বিরুদ্ধে খুলনা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনও করেছিলেন আওয়ামী লীগ নেতারা।  

বর্তমান এমপিকে ঘিরে এসব আলোচনাকে কাজে লাগিয়ে নতুন কেউ এ আসনে আসতে পারেন বলে মনে করছেন তৃণমূলের অনেক নেতাকর্মী।  

তবে অভিযোগের বিষয়ে আলাপ করলে মন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ বাংলানিউজকে বলেন, ‘যে সব ইউপি চেয়ারম্যানরা আমার বিরোধিতা করে, তারা বিএনপি থেকে এসেছেন। এদের দিয়ে আমরা কখনো কোনো নির্বাচন করিনি। তারা হাইব্রিড, এটা আমার নেত্রী ও দলের সাধারণ সম্পাদক বলেছেন। আমি যদি নির্বাচনে ফেল করি, তাহলে ওদের একজনকেও পাওয়া যাবে না। ’

টাকার বিনিময়ে চাকরি দেওয়ার অভিযোগের জবাবে তিনি বলেন, ‘যারা অভিযোগ করেছেন তারা প্রমাণ করুক। আমি যতোটা স্বচ্ছ হয়ে অবস্থান করেছি, এমন আর কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। সুনির্দিষ্ট করে কেউ একজন বলুক, আমি টাকার বিনিময়ে চাকরি দিয়েছি। কেউ যদি চাকরি দেওয়ার কথা বলে আমার নাম করে টাকা চায়, তবে তারা আমার কাছে না শুনে দেয় কেন?’

বিএনপি নেতা ড. মামুন রহমানের কাছে সংখ্যালঘু নেতাদের অভিযোগ করার বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘মামুন অভিযোগ নেওয়ার কে?’

নারায়ণ চন্দ্র তার মনোনয়ন নিয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, ‘যেহেতু আমি এমপি আছি, তাই নির্বাচনে অংশগ্রহণে আমার প্রস্তুতি ভালো। অতীতে যেকোনো সময়ের থেকে এ এলাকায় বেশি উন্নয়ন হয়েছে। কাজের সততা যতোটুকু সম্ভব আমি রাখি। যেভাবে কাজ করেছি, তাতে মনোনয়ন না পাওয়ার কোনো কারণ দেখি না। ’

আসনটিতে আওয়ামী লীগের আরেক মনোনয়নপ্রত্যাশী মোস্তফা সরোয়ার বাংলানিউজকে বলেন, ‘দল যদি মনোনয়ন দেয়, আমি নির্বাচন করবো। এলাকার মানুষ পরিবর্তন চায়। নতুন নেতৃত্ব চায়। মনোনয়ন দেওয়ার মালিক প্রধানমন্ত্রী ও দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা। আমি মনোনয়ন প্রত্যাশী। যাচাই-বাছাই করে দলের সভানেত্রী যে সিদ্ধান্ত নেবেন, আমি মেনে নেবো। মনোনয়ন না দিলেও যাকে দেবে তার পক্ষে কাজ করবো। ’

এ আসনে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীরা হলেন- দলের নির্বাহী কমিটির সদস্য জামিরা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মামুন রহমান ও বিএমএর সাবেক মহাসচিব, জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি ডা. গাজী আবদুল হক ও ডুমুরিয়া উপজেলা বিএনপির সভাপতি খান আলী মুনসুর।  

গুঞ্জন আছে, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে ড. মামুন রহমানের ভীষণ সখ্য রয়েছে। যে কারণে তার অনুসারীরা মনে করেন, সামনের নির্বাচনে মামুন রহমানই মনোনয়ন পাবেন বিএনপি থেকে।  

খর্ণিয়া ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক চার বারের ইউপি মেম্বার মোল্লা আবুল কাশেম বাংলানিউজকে বলেন, ‘এ আসনে আগে দুইবার জামায়াতকে ছাড় দেওয়া হয়েছে। এবার আর নয়। এ আসন বিএনপিকে দিতে হবে। জামায়াতের কারণে আমাদের ইউনিয়ন বিএনপি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গোলাম পরওয়ার এমপি থাকা অবস্থায় তার লোকজন আমাদের অনেক ক্ষতি করেছে। আগামীতে আমরা তৃণমূল নেতাকর্মী সমর্থকরা বিএনপি প্রার্থীকে ভোট দিতে চাই। ’

লন্ডনে অবস্থানরত ড. মামুন রহমান বাংলানিউজকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের আমলে জামায়াত দুর্বল হয়ে গেছে। খুলনা-৫ আসন এবার জামায়াতকে ছাড়তে হবে। যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে জামায়াতের নেতারা কোণঠাসা হয়ে পড়ায় তাদের অবস্থান আর আগের মতো নেই। রাজনীতিতে জামায়াতের একটা প্রভাব ছিলো, ভোট ব্যাংক ছিলো। কিন্তু সেই অবস্থা নেই, যার প্রমাণ হয়ে গেছে সম্প্রতি সিলেট সিটির ভোটে। ধর্মীয় এলাকা হওয়ায় সিলেট জামায়াতের ঘাঁটি ছিল। কিন্তু সেখানেও এবার ভোট পায়নি তারা। ’

মন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘আমি গত মাসে কলকাতায় দুই সপ্তাহ কাটিয়ে এসেছি। তখন ডুমুরিয়ার বহু সংখ্যালঘু নেতারা আমার সঙ্গে দেখা করেছেন। তারা বলেছেন, নারায়ণ চন্দ্র চন্দ অনেককে চাকরি দিয়েছেন। বিনা টাকায় চাকরি দেননি। পাঁচ থেকে সাত লাখ করে টাকা নিয়ে চাকরি দিয়েছেন। টাকা সংগ্রহ করতেন তার ছেলে। ’ 

অপরদিকে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার এ আসনে মনোনয়ন চাইবেন বলেও জানা গেছে।  

২০ দলীয় জোট থেকে মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করে গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘সাবেক এমপি হিসেবে এই এলাকার মাটি মানুষের সঙ্গে আমার গভীর সম্পর্ক রয়েছে। ইতোমধ্যে তৃণমূল পর্যায়ে গণসংযোগসহ নির্বাচনী এলাকায় সময় পেলেই ছুটে আসি। ’

জামায়াতের নিবন্ধন না থাকায় কী মার্কা নিয়ে নির্বাচন করবেন- এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আগে নির্বাচনী পরিবেশ কী হয়, সেটা দেখি। তারপর পরিস্থিতি অনুযায়ী দলীয় সিদ্ধান্ত মোতাবেক কী প্রতীক নিয়ে ইলেকশন করবো তা তখন বলা যাবে। তবে ভোটারদের মধ্যে আমার অবস্থান আগের থেকে অনেক সুসংহত। আশা করি, নির্বাচন নিরপেক্ষ হলে ডুমুরিয়া-ফুলতলাবাসী আমার পক্ষেই রায় দেবেন। ’

এ আসনে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের খুলনা জেলা শাখার প্রশিক্ষণ সম্পাদক মাওলানা মুজিবর রহমানের প্রার্থী হিসেবে নাম ঘোষণা করা হয়েছে। তবে জাতীয় পার্টি (জাপা) বা অন্যান্য দলের কারও নাম শোনা যাচ্ছে না।  

১৯৭৩ সালের প্রথম সংসদ নির্বাচনে এ আসন থেকে নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের প্রার্থী এনায়েত আলী সানা। ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হন আওয়ামী লীগ নেতা সালাউদ্দিন ইউসুফ। ’৮৬ সালের নির্বাচনে জাপার আবদুল গফফার নির্বাচিত হন এ আসনে। ১৯৯১ সালে ফের আওয়ামী লীগের সালাউদ্দিন ইউসুফ নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালে এ আসনে পুনরায় নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের সালাউদ্দিন ইউসুফ। কিছুদিন পর সালাউদ্দিন ইউসুফ মারা গেলে উপ-নির্বাচনে জয়লাভ করেন ডুমুরিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নারায়ণ চন্দ্র চন্দ। ২০০১ সালের নির্বাচনে এ আসনে জামায়াতের মিয়া গোলাম পরওয়ার জয়লাভ করেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনেও বিজয়ী হন নারায়ণ চন্দ্র চন্দ। ২০১৪ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন নারায়ণ চন্দ্র।

জেলা নির্বাচন অফিসের তথ্যানুযায়ী, খুলনা-৫ আসনের ডুমুরিয়া উপজেলায় মোট ভোটার ২ লাখ ৪২ হাজার ১৯৭ জন। আর ফুলতলা উপজেলায় মোট ভোটার ১ লাখ ২৯ হাজার ৩ জন।

বাংলাদেশ সময়: ১১০৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২০, ২০১৮
এমআরএম/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।